সেলিম হাসান কাওছার গোলাপগঞ্জ থেকে :
৫০ শয্যাবিশিষ্ট গোলাপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। সরকারি এ হাসপাতালটি উপজেলার বারোকোর্ট এলাকায়। এটি ধারাভহর হাসপাতাল নামেও পরিচিত। সরকারি এই হাসপাতালে যথেষ্ট লোকবল থাকলেও সেবার মান একইবারে নিষ্কিয় হয়ে পড়েছে। উপজেলার ৩ লাখ ১৬ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসাস্থল হাসপাতালটি। সরেজমিন ৩০ তারিখ থেকে গতকাল শনিবার পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে হাসপাতালটিতে অবস্থান নিয়ে এমন নাজুক অবস্থা চোখে পড়ে। সরকারি এই হাসপাতালটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ যন্ত্রাংশ থাকলেও উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা অসহায় রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা না দিয়েই সিলেট ওসমানীতে রেফার্ড করা হয়। হাসপাতালের ইসিজি, আল্ট্রাসনোগ্রাপ, এক্স-রেসহ সব চিকিৎসা যন্ত্রপাতির কক্ষ খোলা থাকলেও কাউকে দেখা যায়নি। অপারেশন থিয়েটার ছিল তালাবদ্ধ। নার্সদের ভূমিকায় ওয়ার্ডবয়। আর ডাক্তারদের ভূমিকায় নার্স। রোগীদের ওয়ার্ডে ঘন্টার পর ঘন্টা নার্সদের দেখা নেই। অথচ ওই হাসপাতালে প্রধান কর্মকর্তাসহ ১৮ জন ডাক্তার, নারী নার্স ১২ ও নার্স (ব্রাদার) ৪ জন রয়েছেন। কয়েকজন পুরুষ নার্স (ব্রাদার) রয়েছেন সার্বক্ষণিক ডাক্তারের ভূমিকায়। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির সেবা ও মান বাড়ানোর জন্য জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকারের সদ্য সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এমপির মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা উন্নতি করার লক্ষ্যে ৩০ শয্যা থেকে ৫০ শয্যাবিশিষ্টে উন্নীত করলেও সেবাদানকারী ডাক্তাররা তাদের প্রাইভেট চেম্বার ও প্রাইভেট হাসপাতাল নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। সরকারি আইন অনুযায়ী সকাল ৮টায় হাসপাতালে উপস্থিত হওয়ার কথা থাকলেও ১৮জন ডাক্তাদের মধ্যে ১৫/১৬ জনের দেখা মেলে না ১১টা পর্যন্ত। ডাক্তারদের মধ্যে হাতেগুণা কয়েকজন ছাড়া অনেকের দেখাই মিলে না। সরকারি হাসপাতালের এই চাকরীর সাইবোর্ডকে পুঁজি করে তারা প্রাইভেট চেম্বার ও নিজেদের প্রাইভেট কাজ নিয়ে ব্যস্ত। অনেক নার্স (ব্রাদার) ও ডাক্তাররা গোলাপগঞ্জ উপজেলা হাসপাতালে যোগদানের পর বিলাশ বহুল গাড়ি বাড়ীর মালিকও বনেছেন। হাসপাতালের জরুরী বিভাগে ২৪ ঘন্টার মধ্যে ১৮ ঘন্টা ডাক্তারের দায়িত্বে থাকেন নার্স ও ওয়ার্ডবয়। গেল মাসের ৩১ জানুয়ারি হাসপাতালে সকাল ৮টায় অবস্থান নিয়ে দুপুর ১২টায় ডাক্তারের ভূমিকায় দেখা যায় এক নার্স ও ওয়ার্ডবয়কে। ইমার্জেন্সি এক রোগীকে সিলাইসহ জাবতীয় টিটমেন্ট করতে দেখে মোবাইলে ভিডিও ধারণ করতে গিয়ে তাদের রোশানলের শিকার হতে হয়েছে স্থানীয় এক সাংবাদিককে। নিউজ করার জন্য আমাদের হাসপাতালে ডুকতে হলে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে আসতে হবে।
গতকাল শনিবার (২ফেব্র“য়ারী) দুপুর ১২টা ৬মিনিটে হাসপাতালে উপস্থিত হন হাসপাতাল ইনচার্জ ডাঃ তউহিদ আহমেদ। এর আগে অনুপস্থিত ওই হাসপাতাল ইনচার্জের রুম খালি দেখে বেশ কয়েকটি ফটো ও ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়।
এ সময় অনেক বহিরাগত দালালদেরও দেখা মিলে। সরেজমিন (৩০ জানুয়ারি) সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত দেখা মিলেনি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পঃ পঃ কর্মকর্তা ডাঃ তউহিদ আহমদ, নতুন ভবনের মেডিকেল অফিসার ডাঃ এমরান আহমদ, ডাঃ শাহিনুর ইসলাম, ডাঃ মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ রহমান, ডাঃ মোহাম্মদ মোখলেছুর রহমানসহ অনেক ডাক্তারকে। ৩০ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্র“য়ারী সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মেডিকেল অফিসার ডাঃ এমরান আহমদ, ডাঃ শাহিনুর ইসলাম, সহ-পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা এম.এ.রহমান, উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা সহকারী মনিদীপা দাস, অনেক ডাক্তারদের রুম তালাবদ্ধ দেখা যায়। ৩০ তারিখে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রোগীদের ওয়ার্ডে ঘন্টার পর ঘন্টা কয়েকজন সংবাদকর্মী অবস্থান নিলে একজন ডাক্তার বা নার্সদের দেখা মিলেনি। ৩১ তারিখ সকাল ১০টায় নতুন ভবনের রোগীদের ওয়ার্ডে এক ঝলক একজন ডাক্তারের দেখা মিলে। ২ ফেব্র“য়ারী সকাল ১১ টায় হাসপাতালের নতুন ২ নম্বর ভবনের জেনারেল পুরুষ ওয়ার্ডের রোগীদের কর্তব্যরত সেবিকার রুমটি তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। এ সময় রোগীদের সাথে আলাপ করা হলে তারা বলেন, ডাক্তারসাব সকালে এক ঝলক এসেছিলেন। আর উনার দেখা মিলেনি। গোলাপগঞ্জ পৌরসভার ঘোগারকুল গ্রামের লতিব আলীর ছেলে মিনহাজ আহমদ (৬০) এর সাখে দুপুর ১২টায় আলাপ করা হলে তিনি বলেন, সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ডাঃ মোহাম্মদ মুখলেছুর রহমানের জন্য অপেক্ষা করছি। এখনও আসেননি। কবে আসবেন জানি না। কাউকে জিজ্ঞাসা করলে বলছেন জানি না। সকাল ১১টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টায় মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট বিশ^জিৎ চক্রবর্তীর অফিসে দেখা মিলেনি। উনার পরিবর্তে দায়িত্ব পালন করছিলেন অন্য ডিপার্টমেন্টের এক মহিলা। উনার কাছে বিশ^জিৎ চক্রবর্তীর না থাকার বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন ওটা আমি বলতে পারি না। আপনার অফিস ওটা কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের রুমে ইন্টারনেটের সমস্য তাই উনার রুমেই কাজ করছি। ৩০ জানুয়ারি দুপুর সাড়ে ১২টা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পঃ পঃ কর্মকর্তা ডাঃ তউহিদ আহমদের না থাকার বিষয়টি পাশের রুমে থাকা একাউন্টেড কানাই লাল দাশের সাথে আলাপ করা হলে তিনি বলেন, স্যার সিলেটে মিটিংয়ে গেছেন। পাশের দু’তিনটি রুম তালাবদ্ধ কোনটিতে সিট খালি কেনো জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুইজন ছুটিতে। আর একজন বিয়ে করতে গেছেন। উপজেলার রণকেলী গ্রামের পরিবেশবাদী আব্দুল লতিব সরকার (৬৫) বলেন, অগ্রণী ব্যাংকের অফিসার আমার ছেলে আবিদ হোসেন সিদ্দিকিকে নিয়ে গত শুক্রবার ওই হাসপাতালে ভর্তি হই। সকাল আর রাতে ডাক্তাররা একঝলক এসে ফাইলে সাইন করে যেতেন। বাকি কাজগুলো ওয়ার্ডবয় সামলাতেন। ওয়ার্ডের সকল রোগীদের দেখে ১০ মিনিটে চলে যেতেন। তাদের তাড়াহুড়ো দেখে মনে হতো বিমানের ফ্লাইট মিছ হচ্ছে। দাঁড়িপাতন গ্রামের মৃত হাজী ইব্রাহীম আলীর ছেলে লুৎফুর রহমান (৫৫) একই রকম অভিযোগ করে বলেন-নার্স নাই ডাক্তার নাই আয়াকে সব সামলাতে হয়।
এছাড়াও উপজেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা রোগীরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বিভিন্ন বিভাগের কর্মরত ডাক্তারদের অনুপিস্থিতির বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,৫টাকার টিকিট কিনে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষমান থাকতে হয়। এক পর্যায়ে ওয়ার্ডবয়রা বলে যান, স্যার আসবে না। এ রকম চলতে থাকলে সরকারের মহতী উদ্যোগ বিফলে যাবে। সেবার মান বাড়ানোর জন্য সরকার ৩০ শয্যা থেকে ৫০ শয্যাবিশিষ্টে উন্নীত করলেও কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে তা ভেস্তে যাচ্ছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পঃ পঃ কর্মকর্তা ডাঃ তউহিদ আহমদের সাথে আলাপ করা হলে তিনি দেরিতে আসার বিষয়টি অস্বীকার করেন। এ বিষয়ে গোলাপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মামুনুর রহমানের সাথে আলাপ করা হলে তিনি বলেন, ডাক্তারদের উপস্থিতিসহ সকল বিষয়ে আমি জেলা সিভিল সার্জনের সাথে আলাপ করে আইনগত ব্যবস্থা নেবো।
এ ব্যাপারে সিলেট জেলা সিভিল সার্জন হিমাংশু লাল রায়ের সাথে আলাপ করা হয়ে তিনি বলেন, এসবের দায়ভার শুধু সিভিল সার্জনের না। সকল সমস্যা সমাধান করতে উপজেলা প্রশাসন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। আমার একজনের পক্ষে সকল সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। সরকার হাসপাতালের ডাক্তারদের এ আইন করার পর থেকে ৭০% ডাক্তাররা যথা সময়ে হাসপাতালে উপস্থিত হচ্ছেন। এ উপজেলার বিষয়টি বলতে পারছি না। তবে উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে নিয়ে দু’একদিনের মধ্যে ব্যবস্থা নেবো। তাছাড়া কোন কারণ ছাড়া ডাক্তাররা হাসপাতালে অনুপস্থিত থাকলে আমাকে জানানোর জন্য অনুরোধ করছি।