পেনশন পাবে ৮ কোটি ৩২ লাখ মানুষ ॥ খসড়া আইন মন্ত্রীসভায় উঠবে ২ জুন ॥ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণ হবে

14

কাজিরবাজার ডেস্ক :
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণে প্রায় আট কোটি ৩২ লাখ মানুষকে সাবর্জনীন পেনশন ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সরকারী চাকরিজীবী ছাড়া যাদের বয়স ১৮ থেকে ৫০ বছর এমন সব নাগরিক পেনশন সুবিধার আওতায় আসবেন। এ ক্ষেত্রে সমাজের স্বল্প আয়ের পিছিয়েপড়া অনগ্রসর নাগরিকদের সবচেয়ে বেশি সুবিধা দেয়ার চিন্তাভাবনা করছে সরকার। নিম্ন আয়সীমার নিচের নাগরিকদের অথবা দুস্থ চাঁদাদাতার ক্ষেত্রে পেনশন তহবিলে মাসিক চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে দিয়ে দেবে। সবার জন্যই পেনশন নিশ্চিত করতে জোর প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এ লক্ষ্যে ‘সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন-২০২২’ শিরোনামের খসড়া আইনটি আগামীকাল ২ জুন অনুমোদনের জন্য মন্ত্রীসভায় উত্থাপন করা হবে। এ ছাড়া আগামীকাল অর্থবছরের নতুন বাজেটে সবার জন্য পেনশন সুবিধা চালু করার বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এর আগে গত ফেব্রুয়ারি মাসে সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা দ্রুত চালু করতে নির্দেশনা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী অর্থবছর থেকেই সবার জন্য পেনশন সুবিধা চালু করার লক্ষ্যে কাজ শুরু করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত একটি রোডম্যাপ প্রণয়ন করেছে অর্থবিভাগ।
জানা গেছে, অর্থনীতিতে নির্ভরশীল মানুষের বর্তমান হার ৭.৭ শতাংশ, যা ২০৫০ সালে যথাক্রমে ২৪ শতাংশ এবং ২০৭৫ সালে ৫৮ শতাংশে বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। পর্যায়ক্রমে গড় আয়ু বেড়ে ৮৫ বছর হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এতে ভবিষ্যতে নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা বহুগুণে বৃদ্ধি পাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে বাংলাদেশের সামনে। এ অবস্থায় ১৮ কোটি জনসংখ্যার দেশে সরকারী চাকরি করছেন মাত্র ১৪ লাখ মানুষ। এসব সরকারী কর্মচারী-কর্মকর্তাদের পেনশন সুবিধা রয়েছে। বাকি ১৮ থেকে ৫০ বছরের বেশিরভাগ মানুষ কৃষি, বেসরকারী খাত, ব্যবসায়ী কিংবা অন্যান্য পেশায় জড়িত রয়েছেন। মূলত এদের কোন পেনশন নেই। ফলে অবসর জীবন কিংবা বার্ধক্যজনিত কারণে যারা অভাবগ্রস্ত হবেন, তাদের জীবিকার বিষয়টি বড় ভাবনার বিষয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর এ কারণেই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা দ্রুত চালু করতে কাজ করছে অর্থবিভাগ। আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এ সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিক ঘোষণাসহ একটি রূপরেখা তুলে ধরবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। যদিও সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা নিয়ে এর আগে একটি সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, পেনশন ব্যবস্থা সম্পর্কে সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে বলা আছে- বার্ধক্যজনিত কারণে যারা অভাবগ্রস্ত হবেন, তাদের এই সুবিধা দেয়া হবে। এই অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য সাহায্যের প্রয়োজন হবে। এই সাহায্য পাওয়া রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার। আর এ কারণে সবার জন্য পেনশন ব্যবস্থা চালু করা হবে। এদিকে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২১ সালের খসড়া হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা ৮ কোটি ৪৬ লাখ ৫৯ হাজার ৫১০। এর মধ্যে সরকারী চাকরিজীবী ১৪ লাখের বেশি। তাদের বাদ দিলে আগামী এক বছরে সরকারকে প্রায় ৮ কোটি ৩২ লাখের বেশি মানুষকে সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার আওতায় আনতে হবে। প্রত্যেকে ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতিমাসে নির্দিষ্ট হারে চাঁদা পরিশোধ করে ৬০ বছর পর থেকে আজীবন প্রতিমাসে পেনশন পাবেন। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ১৮-৫০ বছর বয়সীদের জন্য সার্বজনীন ব্যবস্থা দ্রুত উন্মুক্ত করতে কাজ শুরু করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা কার্যকর করতে একটি রোডম্যাপ প্রণয়ন করা হয়েছে। তাতে আগামী মার্চ থেকে সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার পাইলটিং শুরু করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলছে। শুধু তাই নয়, সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করতে একটি অথরিটি গঠনের আইনের খসড়া তৈরি করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মতামত সংগ্রহ করেছে অর্থ বিভাগ। সম্প্রতি অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব আবদুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় খসড়াটি চূড়ান্ত করা হয়েছে।
জানা গেছে, আগামীকাল ২ জুন আইনের খসড়াটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রীসভায় উপস্থাপন করা হবে। সেখানে অনুমোদন পেলে জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনেই এটি বিল আকারে পাস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এরপরই দ্রুতগতিতে অথরিটি গঠন করার পরিকল্পনা রয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের। এর পরপরই জরুরীভাবে দক্ষ ও টেকনিক্যাল লোক নিয়োগ দেয়া হবে, যারা সার্বজনীন পেনশনের বিভিন্ন ধরনের প্রোডাক্ট তৈরি করবেন। এই সময়ের মধ্যেই সার্বজনীন পেনশন বিধিমালা প্রণয়ন করা হবে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ সম্পন্ন করে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির মধ্যে পেনশন প্রোডাক্ট তৈরি করা হবে। এ ছাড়া খসড়া আইনে প্রবাসী বাংলাদেশীদেরও সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত রাখার কথা বলা হয়েছে। এ ব্যবস্থার আওতায় মাসিক ও ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে চাঁদা দেয়া যাবে এবং অগ্রিম ও কিস্তিতেও চাঁদা জমা দেয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্রকে ভিত্তি ধরে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী সকল বাংলাদেশী সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। এই ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তির পর চাঁদাদাতা ধারাবাহিকভাবে কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দিয়ে মাসিক পেনশন পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবেন এবং চাঁদাদাতার বয়স ৬০ বছর পূর্তিতে পেনশন তহবিলে পুঞ্জিভূত মুনাফাসহ জমার বিপরীতে পেনশন দেয়া হবে।
কিভাবে পেনশন পাওয়া যাবে : ৬০ বছর বয়স থেকে পেনশনারগণ আজীবন, অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত পেনশন সুবিধা ভোগ করবেন। তবে পেনশনে থাকাকালীন অবস্থায় বয়স ৭৫ বছর হওয়ার আগে মৃত্যুবরণ করলে পেনশনারের নমিনি বাকি সময়কালের (মূল পেনশনারের বয়স ৭৫ বছর পর্যন্ত) মাসিক পেনশন পাবেন। এ ছাড়া, কেউ সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা পরিশোধ করার আগেই মৃত্যুবরণ করলে, জমা করা অর্থ মুনাফাসহ তার নমিনিকে ফেরত দেয়া হবে। পেনশন তহবিলে জমা করা অর্থ কোন পর্যায়েই এককালীন উত্তোলনের সুযোগ থাকবে না। তবে চাঁদাদাতা তার জমা করা অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসেবে উত্তোলন করতে পারবে, যা ধার্যকৃত ফিসহ পরিশোধ করতে হবে। ফিসহ পরিশোধ করা পুরো অর্থ চাঁদাদাতার নিজ এ্যাকাউন্টেই জমা হবে। পেনশনের জন্য নির্ধারিত চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করে কর রেয়াত দেবে সরকার। মাসিক পেনশন হিসেবে পেনশনার যে টাকা পাবে, তাও আয়করমুক্ত থাকবে। নিম্ন আয়সীমার নিচের নাগরিকদের অথবা দুস্থ চাঁদাদাতার ক্ষেত্রে, পেনশন তহবিলে মাসিক চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে দিতে পারবে। এ বিষয়ে সরকার সময় সময় প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারবে। প্রতিটি চাঁদাদাতার জন্য একটি পৃথক ও স্বতন্ত্র পেনশন হিসাব থাকবে। চাকরিরত চাঁদাদাতারা চাকরি পরিবর্তন করলেও নতুন কর্মস্থলের বিপরীতে আগের হিসাব স্থানান্তর হবে। নতুন প্রতিষ্ঠানে যোগদান করলেও নতুন হিসাব খোলার দরকার হবে না।
জানা গেছে, খসড়া আইনে অর্থমন্ত্রীকে চেয়ারম্যান করে ১৫ সদস্যের একটি গবর্নিং বোর্ড গঠনের কথা বলা হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নরসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের রাখার কথা বলা হয়েছে। গবর্নিং বোর্ড পেনশন তহবিলের অর্থ সরকারী সিকিউরিটি, কম ঝুঁকিপূর্ণ অন্যান্য সিকিউরিটিজ, লাভজনক অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের জন্য নির্ধারিত গাইডলাইন অনুমোদন এবং কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও দিক-নির্দেশনা দেবে। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে জাতীয়ভাবে সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তনের অঙ্গীকার করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার অনুযায়ী এই কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। এ প্রসঙ্গে অর্থনৈতিক বিশ্লেষক মামুন রশীদ সম্প্রতি বলেন, সার্বজনীন পেনশন একটি ভাল উদ্যোগ। আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, দরিদ্র নাগরিকদের ক্ষেত্রে পেনশন স্কিমে মাসিক জমার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে দিতে পারে। এতে করে গরিব মানুষের পেনশন সুবিধা নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ আরও বাড়বে। তিনি বলেন, সবার স্বার্থেই সার্বজনীন পেনশন দ্রুত চালু হওয়া প্রয়োজন।
জানা গেছে, বিশ্বের অনেক দেশে এরই মধ্যে কার্যকর করা হয়েছে সার্বজনীন পেনশন। তবে, পেনশন ব্যবস্থার উৎকর্ষে বিভিন্ন দেশের মধ্যে রয়েছে বিস্তর তারতম্য। বর্তমানে বিশ্বের সর্বোত্তম পেনশন ব্যবস্থা পরিচালনার খ্যাতি অর্জন করেছে আইসল্যান্ড। এ ছাড়া ভাল করছে নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, ইসরাইল, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ে, নিউজিল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, কানাডা, জার্মানি, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশ। সুদক্ষ ব্যবস্থাপনা, সুশাসন, বয়স্ক সব জনগোষ্ঠীকে পর্যাপ্ত অবসর সুবিধার আওতায় আনা, রাষ্ট্রীয় উদার আর্থিক সমর্থন নিশ্চিতের কারণেই দেশগুলো বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে। এমনকি, প্রতিবেশী দেশ ভারতও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। দেশটির কয়েকটি রাজ্যে কার্যকরভাবে পরিচালিত হচ্ছে সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা। সুনির্দিষ্ট আইনী কাঠামোর মধ্যে থেকে সেখানে লাভজনক বিভিন্ন উদ্যোগে লগ্নি করা হচ্ছে পেনশন তহবিল। এ থেকে রাষ্ট্রও লাভবান হচ্ছে।
কাজিরবাজার ডেস্ক
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণে প্রায় আট কোটি ৩২ লাখ মানুষকে সাবর্জনীন পেনশন ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সরকারী চাকরিজীবী ছাড়া যাদের বয়স ১৮ থেকে ৫০ বছর এমন সব নাগরিক পেনশন সুবিধার আওতায় আসবেন। এ ক্ষেত্রে সমাজের স্বল্প আয়ের পিছিয়েপড়া অনগ্রসর নাগরিকদের সবচেয়ে বেশি সুবিধা দেয়ার চিন্তাভাবনা করছে সরকার। নিম্ন আয়সীমার নিচের নাগরিকদের অথবা দুস্থ চাঁদাদাতার ক্ষেত্রে পেনশন তহবিলে মাসিক চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে দিয়ে দেবে। সবার জন্যই পেনশন নিশ্চিত করতে জোর প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এ লক্ষ্যে ‘সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন-২০২২’ শিরোনামের খসড়া আইনটি আগামীকাল ২ জুন অনুমোদনের জন্য মন্ত্রীসভায় উত্থাপন করা হবে। এ ছাড়া আগামীকাল অর্থবছরের নতুন বাজেটে সবার জন্য পেনশন সুবিধা চালু করার বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এর আগে গত ফেব্রুয়ারি মাসে সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা দ্রুত চালু করতে নির্দেশনা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী অর্থবছর থেকেই সবার জন্য পেনশন সুবিধা চালু করার লক্ষ্যে কাজ শুরু করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত একটি রোডম্যাপ প্রণয়ন করেছে অর্থবিভাগ।
জানা গেছে, অর্থনীতিতে নির্ভরশীল মানুষের বর্তমান হার ৭.৭ শতাংশ, যা ২০৫০ সালে যথাক্রমে ২৪ শতাংশ এবং ২০৭৫ সালে ৫৮ শতাংশে বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। পর্যায়ক্রমে গড় আয়ু বেড়ে ৮৫ বছর হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এতে ভবিষ্যতে নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা বহুগুণে বৃদ্ধি পাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে বাংলাদেশের সামনে। এ অবস্থায় ১৮ কোটি জনসংখ্যার দেশে সরকারী চাকরি করছেন মাত্র ১৪ লাখ মানুষ। এসব সরকারী কর্মচারী-কর্মকর্তাদের পেনশন সুবিধা রয়েছে। বাকি ১৮ থেকে ৫০ বছরের বেশিরভাগ মানুষ কৃষি, বেসরকারী খাত, ব্যবসায়ী কিংবা অন্যান্য পেশায় জড়িত রয়েছেন। মূলত এদের কোন পেনশন নেই। ফলে অবসর জীবন কিংবা বার্ধক্যজনিত কারণে যারা অভাবগ্রস্ত হবেন, তাদের জীবিকার বিষয়টি বড় ভাবনার বিষয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর এ কারণেই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা দ্রুত চালু করতে কাজ করছে অর্থবিভাগ। আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এ সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিক ঘোষণাসহ একটি রূপরেখা তুলে ধরবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। যদিও সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা নিয়ে এর আগে একটি সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, পেনশন ব্যবস্থা সম্পর্কে সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে বলা আছে- বার্ধক্যজনিত কারণে যারা অভাবগ্রস্ত হবেন, তাদের এই সুবিধা দেয়া হবে। এই অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য সাহায্যের প্রয়োজন হবে। এই সাহায্য পাওয়া রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার। আর এ কারণে সবার জন্য পেনশন ব্যবস্থা চালু করা হবে। এদিকে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২১ সালের খসড়া হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা ৮ কোটি ৪৬ লাখ ৫৯ হাজার ৫১০। এর মধ্যে সরকারী চাকরিজীবী ১৪ লাখের বেশি। তাদের বাদ দিলে আগামী এক বছরে সরকারকে প্রায় ৮ কোটি ৩২ লাখের বেশি মানুষকে সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার আওতায় আনতে হবে। প্রত্যেকে ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতিমাসে নির্দিষ্ট হারে চাঁদা পরিশোধ করে ৬০ বছর পর থেকে আজীবন প্রতিমাসে পেনশন পাবেন। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ১৮-৫০ বছর বয়সীদের জন্য সার্বজনীন ব্যবস্থা দ্রুত উন্মুক্ত করতে কাজ শুরু করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা কার্যকর করতে একটি রোডম্যাপ প্রণয়ন করা হয়েছে। তাতে আগামী মার্চ থেকে সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার পাইলটিং শুরু করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলছে। শুধু তাই নয়, সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করতে একটি অথরিটি গঠনের আইনের খসড়া তৈরি করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মতামত সংগ্রহ করেছে অর্থ বিভাগ। সম্প্রতি অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব আবদুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় খসড়াটি চূড়ান্ত করা হয়েছে।
জানা গেছে, আগামীকাল ২ জুন আইনের খসড়াটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রীসভায় উপস্থাপন করা হবে। সেখানে অনুমোদন পেলে জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনেই এটি বিল আকারে পাস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এরপরই দ্রুতগতিতে অথরিটি গঠন করার পরিকল্পনা রয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের। এর পরপরই জরুরীভাবে দক্ষ ও টেকনিক্যাল লোক নিয়োগ দেয়া হবে, যারা সার্বজনীন পেনশনের বিভিন্ন ধরনের প্রোডাক্ট তৈরি করবেন। এই সময়ের মধ্যেই সার্বজনীন পেনশন বিধিমালা প্রণয়ন করা হবে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ সম্পন্ন করে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির মধ্যে পেনশন প্রোডাক্ট তৈরি করা হবে। এ ছাড়া খসড়া আইনে প্রবাসী বাংলাদেশীদেরও সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত রাখার কথা বলা হয়েছে। এ ব্যবস্থার আওতায় মাসিক ও ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে চাঁদা দেয়া যাবে এবং অগ্রিম ও কিস্তিতেও চাঁদা জমা দেয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্রকে ভিত্তি ধরে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী সকল বাংলাদেশী সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। এই ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তির পর চাঁদাদাতা ধারাবাহিকভাবে কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দিয়ে মাসিক পেনশন পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবেন এবং চাঁদাদাতার বয়স ৬০ বছর পূর্তিতে পেনশন তহবিলে পুঞ্জিভূত মুনাফাসহ জমার বিপরীতে পেনশন দেয়া হবে।
কিভাবে পেনশন পাওয়া যাবে : ৬০ বছর বয়স থেকে পেনশনারগণ আজীবন, অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত পেনশন সুবিধা ভোগ করবেন। তবে পেনশনে থাকাকালীন অবস্থায় বয়স ৭৫ বছর হওয়ার আগে মৃত্যুবরণ করলে পেনশনারের নমিনি বাকি সময়কালের (মূল পেনশনারের বয়স ৭৫ বছর পর্যন্ত) মাসিক পেনশন পাবেন। এ ছাড়া, কেউ সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা পরিশোধ করার আগেই মৃত্যুবরণ করলে, জমা করা অর্থ মুনাফাসহ তার নমিনিকে ফেরত দেয়া হবে। পেনশন তহবিলে জমা করা অর্থ কোন পর্যায়েই এককালীন উত্তোলনের সুযোগ থাকবে না। তবে চাঁদাদাতা তার জমা করা অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসেবে উত্তোলন করতে পারবে, যা ধার্যকৃত ফিসহ পরিশোধ করতে হবে। ফিসহ পরিশোধ করা পুরো অর্থ চাঁদাদাতার নিজ এ্যাকাউন্টেই জমা হবে। পেনশনের জন্য নির্ধারিত চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করে কর রেয়াত দেবে সরকার। মাসিক পেনশন হিসেবে পেনশনার যে টাকা পাবে, তাও আয়করমুক্ত থাকবে। নিম্ন আয়সীমার নিচের নাগরিকদের অথবা দুস্থ চাঁদাদাতার ক্ষেত্রে, পেনশন তহবিলে মাসিক চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে দিতে পারবে। এ বিষয়ে সরকার সময় সময় প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারবে। প্রতিটি চাঁদাদাতার জন্য একটি পৃথক ও স্বতন্ত্র পেনশন হিসাব থাকবে। চাকরিরত চাঁদাদাতারা চাকরি পরিবর্তন করলেও নতুন কর্মস্থলের বিপরীতে আগের হিসাব স্থানান্তর হবে। নতুন প্রতিষ্ঠানে যোগদান করলেও নতুন হিসাব খোলার দরকার হবে না।
জানা গেছে, খসড়া আইনে অর্থমন্ত্রীকে চেয়ারম্যান করে ১৫ সদস্যের একটি গবর্নিং বোর্ড গঠনের কথা বলা হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নরসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের রাখার কথা বলা হয়েছে। গবর্নিং বোর্ড পেনশন তহবিলের অর্থ সরকারী সিকিউরিটি, কম ঝুঁকিপূর্ণ অন্যান্য সিকিউরিটিজ, লাভজনক অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের জন্য নির্ধারিত গাইডলাইন অনুমোদন এবং কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও দিক-নির্দেশনা দেবে। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে জাতীয়ভাবে সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তনের অঙ্গীকার করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার অনুযায়ী এই কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। এ প্রসঙ্গে অর্থনৈতিক বিশ্লেষক মামুন রশীদ সম্প্রতি বলেন, সার্বজনীন পেনশন একটি ভাল উদ্যোগ। আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, দরিদ্র নাগরিকদের ক্ষেত্রে পেনশন স্কিমে মাসিক জমার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে দিতে পারে। এতে করে গরিব মানুষের পেনশন সুবিধা নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ আরও বাড়বে। তিনি বলেন, সবার স্বার্থেই সার্বজনীন পেনশন দ্রুত চালু হওয়া প্রয়োজন।
জানা গেছে, বিশ্বের অনেক দেশে এরই মধ্যে কার্যকর করা হয়েছে সার্বজনীন পেনশন। তবে, পেনশন ব্যবস্থার উৎকর্ষে বিভিন্ন দেশের মধ্যে রয়েছে বিস্তর তারতম্য। বর্তমানে বিশ্বের সর্বোত্তম পেনশন ব্যবস্থা পরিচালনার খ্যাতি অর্জন করেছে আইসল্যান্ড। এ ছাড়া ভাল করছে নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, ইসরাইল, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ে, নিউজিল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, কানাডা, জার্মানি, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশ। সুদক্ষ ব্যবস্থাপনা, সুশাসন, বয়স্ক সব জনগোষ্ঠীকে পর্যাপ্ত অবসর সুবিধার আওতায় আনা, রাষ্ট্রীয় উদার আর্থিক সমর্থন নিশ্চিতের কারণেই দেশগুলো বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে। এমনকি, প্রতিবেশী দেশ ভারতও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। দেশটির কয়েকটি রাজ্যে কার্যকরভাবে পরিচালিত হচ্ছে সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা। সুনির্দিষ্ট আইনী কাঠামোর মধ্যে থেকে সেখানে লাভজনক বিভিন্ন উদ্যোগে লগ্নি করা হচ্ছে পেনশন তহবিল। এ থেকে রাষ্ট্রও লাভবান হচ্ছে।