কাজিরবাজার ডেস্ক :
কোম্পানিগুলোর প্রস্তাবনার বিপরীতে ইতোমধ্যে গ্যাস এবং বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর গণশুনানি শেষ হয়েছে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত শুনানিতে বিভিন্নভাবে গ্যাস এবং বিদ্যুতের দাম বাড়ার ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোন ধরনের ঘোষণা আসছিল না এতদিন। অবশেষে মঙ্গলবার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানালেন, বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করতে দেশে বাড়বে বিদ্যুতের দাম। তবে বাড়লেও তা সব পর্যায়ের মানুষের জন্যই সহনীয় পর্যায়ে রাখারও আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। এতে করে জনগণের খুব একটা দুর্ভোগ তৈরি হবে না বলেও মনে করেন তিনি। মন্ত্রী বলেন, আমি দাম কমবে বলিনি, আমি বলেছি সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ দেব। আগে যে দামে বিদ্যুৎ দেয়া যেত, এখন সে দাম কিন্তু নেই। বিশ্বে জ্বালানির দাম অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু আমাদের অবস্থা কিন্তু এখনও অনেক স্থিতিশীল।
সম্প্রতি নিজেদের দেশ থেকে ক্রুড অয়েল কেনার যে প্রস্তাবনা রাশিয়া দিয়েছিল তা গ্রহণ করা হচ্ছে না বলেও জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, বাংলাদেশ দেশের একমাত্র তেল পরিশোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারিতে লাইট ক্রুড অয়েল বা হালকা অপরিশোধিত তেল পরিশোধন করে। কিন্তু রাশিয়া যে ক্রুড অয়েল রফতানি করতে চাইছে, তা অনেকটা ভারি। ফলে এই তেল দেশে পরিশোধন করা সম্ভব নয়। তাই আপাতত এটি আনা হচ্ছে না।
মঙ্গলবার বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানের উদ্বোধনীতে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় পিডিবির সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে সরকার নতুন জ্বালানির খোঁজ করছে উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাপী পরীক্ষামূলক নতুন জ্বালানি হাইড্রোজেন দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাব্যতা জরিপ করা হবে। এজন্য সরকার একটি নীতিমালাও করেছে। নসরুল হামিদ বলেন, ১৩ বছর আগে যে দামে বিদ্যুত পাওয়া যেত একই দামে এখন বিদ্যুত দেয়া সম্ভব নয়। ব্যবসায়ীসহ সবাইকে চিন্তা করতে হবে, তারা বিদ্যুৎ পাচ্ছে কিনা এবং সাশ্রয়ী মূল্যে পাচ্ছে কিনা। সবার জন্য সহনীয় পর্যায়ে রেখেই বিদ্যুতের দাম বাড়বে দাবি করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, বিদ্যুতের দাম সাশ্রয় করতে আমাদের আরও কমপক্ষে পাঁচ-ছয় বছর সময় লাগবে। এই মুহূর্তে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার সময়ও আসেনি। এরজন্যও আরও পাঁচ ছয় বছর অপেক্ষা করতে হবে।
পিডিবির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর ফোরাম ফর এনার্জি রিপোর্টার্স বাংলাদেশ ও পিডিবির যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল আপাতত কেনা সম্ভব হচ্ছে না। তবে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি ছাড়াও আমরা অনেক দেশ থেকে অনেক অফার পাচ্ছি। রাশিয়ার ক্রুড আমাদের ক্রুডের সঙ্গে ম্যাচ করে না। আমরা এ্যারাবিয়ার মারমার ব্যবহার করি, যা অনেকটা হালকা। আমাদের ক্রুড অয়েলের কোনও সঙ্কটও নেই। ফলে এ মুহূর্তে অন্য দেশের মতো মজুদের চিন্তা করছি না। তবে বিশ্ববাজারে তেলের দাম ওঠানামা করছে। সেটা আমরা নিয়মিত মনিটরিং করছি।
এ সময় নতুন জ্বালানির খোঁজের বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, হাইড্রোজেন দিয়ে বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্র অনেকদিন থেকে চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে ইইউ এ কাজে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের জন্য তহবিল গঠন করেছে। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে একটি হাইড্রোজেন পাওয়ার প্ল্যান্ট চালুও করেছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি হিসেবে হাইড্রোজেন ভবিষ্যত দুনিয়ার জ্বালানি হবে বলে মনে করা হচ্ছে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, সামনে বড় পরিবর্তন আসছে, হাইড্রোজেন পলিসি করতে যাচ্ছি। ভবিষ্যতে এই জ্বালানি দিয়ে বিদ্যুত উৎপাদন হতে পারে। এখনও ফিজিবিলিটি করা হচ্ছে। যাচাই-বাছাই চলছে। ৪১ সালের মধ্যে ৪১ শতাংশ বিদ্যুত আনতে হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে। এজন্য ব্যাপক বিনিয়োগ করতে হবে।
নসরুল হামিদ বলেন, পিডিবির আজ ৫০ বছর হলো। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে যাত্রা শুরু করে পিডিবি। ওয়াপদাকে ভেঙ্গে দুটি সংস্থা করা হয়। তার একটি পিডিবি। বঙ্গবন্ধুর এই দূরদর্শী চিন্তার কারণে আজ আমরা এইখানে। উনি বুঝতে পেরেছিলেন গ্রামে বিদ্যুতের সুবিধা বাড়াতে হবে। বিদেশ থেকে কেন্দ্র এনে প্রথম বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করেছিলেন। নানা সমস্যার মধ্যে তিনি এসব উদ্যোগ নেন। তিনি বুঝেছিলেন ওই সময় কলকারখানার উন্নয়ন করতে হবে। স্বাধীনতার তিন বছরের মধ্যে ঘোড়াশাল বিদ্যুত কেন্দ্রসহ বেশ কয়েকটি কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। ৫০০ মেগাওয়াট থেকে আজ ২৫ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতায় উন্নীত হয়েছি আমরা। এরমধ্যে নানা ঘটনা ঘটেছে। নানা প্রতিকূলতা পার হয়ে এসেছি আমরা। আজকে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বিদ্যুত বিভাগ শতভাগ সফল। প্রধানমন্ত্রীর পরিশ্রম, দুর্দান্ত সাহস এবং দূরদর্শী চিন্তার কারণে আমরা আজ শতভাগ বিদ্যুত দিতে পারছি।
তিনি বলেন, এখন আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ সাশ্রয়ী বিদ্যুত দেয়া এবং সেটা নিরবচ্ছিন্নভাবে সরবরাহ করা। এদিকে আগামীতে সারাবিশ্বে বিদ্যুতের দামে একটি বড় পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। এর দাম নির্ভর করে জ্বালানির দামের ওপর। আমরা বিদেশ থেকে তেল আনি, গ্যাস আনি। এ ক্ষেত্রে এখন দামের একটি বড় প্রভাব পড়ছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ুক না কেন, আমরা এফিশিয়েন্ট কিনা, কত দ্রুত বিদ্যুৎ দিতে পারব। স্বল্প সময়ে বিদ্যুৎ দিতে তেলভিত্তিক কেন্দ্র করা হলেও এখন তা থেকে সরে আসতে শুরু করেছি। এখন যাদের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে, তাদের থেকে বিদ্যুৎ প্রয়োজন না হলে নেবো না। দীর্ঘমেয়াদী রামপাল থেকে, এস আলমসহ বেশকিছু বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে আমরা বিদ্যুত পাব। এসব থেকে আমরা সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুত পাব। তার মানে আমরা এখন সাশ্রয়ী ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের দিকে এগুচ্ছি। তিনি দাবি করেন, চলতি বছর ঝড়-বন্যায়ও বিদ্যুৎ বিভাগ ভালভাবে কাজ করেছে। দ্রুত কাজ করা হয়েছে। তিনি বলেন, বিদ্যুত বিভাগ স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছে। এটা অনেক বড় অর্জন। সহযোগিতা পেলে আরও ভালর দিকে যেতে পারব। প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমদানি করা বিদ্যুতের পরিমাণ আমরা বাড়াতে চাই। নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আনা হবে। ৫-৭ বছরে এসব পার্শ্ববর্তী দেশসহ বেশকিছু এলাকা থেকে বিদ্যুত আনতে পারব।
এ সময় পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, আজ থেকে ৫০ বছর আগে পিডিবি গঠন করা হয়। অনেক চড়াই-উতড়াই পার হয়ে আজকে এই জায়গায় এসেছে। আধুনিক, যুগোপযোগী, এবং প্রযুক্তিসহ একটি আধুনিক সংস্থা গঠন করার ব্যাপারে আমরা গুরুত্ব দিয়ে কাজ শুরু করছি। এফইআরবির চেয়ারম্যান শামীম জাহাঙ্গীরের সভাপতিত্বে, নির্বাহী পরিচালক রিশান নসরুল্লাহর সঞ্চালনায় এ সময় বিদ্যুৎ বিভাগ এবং পিডিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।