ইউক্রেন যুদ্ধ যেভাবে বদলে দিচ্ছে তেলের বাজার

3

কাজিরবাজার ডেস্ক :
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন বৈশ্বিক তেলের বাজারের খোলনলচে বদলে দিয়েছে। ইউরোপের চাহিদা পূরণে উদ্যোগী হচ্ছে আফ্রিকান সরবরাহকারীরা। অন্যদিকে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ফলে বিপাকে পড়ছে রাশিয়া। তাদের জন্য এখন জাহাজযোগে এশিয়ায় তেল সরবরাহ ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে।
প্রায় এক দশক আগে মার্কিন শেল বিপ্লব বাজারের আকার বদলে দেয়। ওই ঘটনার পর বিশ্বব্যাপী তেল বাণিজ্যে বড় পরিবর্তন আসে ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে। তবে চীনসহ এশিয়ার দেশগুলোতে রফতানি অব্যাহত রাখতে পারলে দৃশ্যত রাশিয়ার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলা করা সহজ হবে।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে কথিত বিশেষ সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া। এরপর থেকেই একের পর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে দেশটি। বিশেষ করে রুশ তেল আমদানিতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা রাশিয়াকে ইউরোপ থেকে আরও দূরে সরিয়ে দেওয়ার পথে প্ররোচিত করেছে। এমন বাস্তবতায় রাশিয়ার কাছ থেকে ছাড়কৃত দামে অপরিশোধিত তেল সংগ্রহে নজর দিচ্ছে চীন ও ভারতের মতো দেশগুলো।
প্যারিসভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল মাসে রাশিয়ার রফতানির পরিমাণ ইউক্রেনে হামলার আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে। মার্চে ১৪ বছরের মধ্যে ব্যারেলপ্রতি দাম সর্বোচ্চ ১৩৯ ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার পর অবশেষে এটি ১১০ ডলারের কাছাকাছি পর্যন্ত নেমে স্থিতিশীল হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদি রাশিয়ার ওপর পরবর্তী ধাপের নিষেধাজ্ঞায় দেশটির তেল নিষিদ্ধের পদক্ষেপ নেয়, তাহলেও এশিয়ার চাহিদার ফলে মস্কোর ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব অপেক্ষাকৃত কম হবে।
বেসরকারি ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান জুলিয়াস বেয়ারের নরবার্ট রাকার বলেন, পশ্চিমারা এশীয় ক্রেতাদের ওপর কূটনৈতিক চাপ না দিলে আমরা রুশ তেলের সরবরাহের ব্যবধান বাড়ার চিত্র দেখতে পাবো না।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার আওতায় রাশিয়ার মালিকানাধীন বা দেশটির পতাকাযুক্ত জাহাজগুলোকে বিভিন্ন বন্দরে ভিড়ানোর ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। ফলে কৌশলগতভাবে এই প্রক্রিয়া এড়িয়ে গিয়ে এশিয়ায় রুশ তেল সরবরাহের ব্যয় বাড়বে। এছাড়া নিষেধাজ্ঞা এড়াতে রুশ জাহাজ থেকে অন্য দেশের পতাকাবাহী জাহাজে স্থানান্তর করা হলে সাগরে তেল ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিও বেড়ে যাবে।
ট্যাংকার ট্র্যাকার পেট্রো-লজিস্টিকস এবং অন্যান্য তথ্য অনুযায়ী, সামগ্রিকভাবে সমুদ্রের মাধ্যমে এশিয়ায় রাশিয়ান তেলের প্রবাহ বছরের শুরু থেকে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ বেড়েছে।
এক জাহাজ থেকে অন্য জাহাজে স্থানান্তরের বিষয়টি সামগ্রিক সমুদ্র বাণিজ্যের একটি ছোট অংশ।
পেট্রো-লজিস্টিকের প্রেসিডেন্ট মার্ক গেরবার রয়টার্সকে বলেন, ‘বাল্টিক সাগরের প্রবেশ পথে ডেনমার্কের পানিসীমায় শিপ-টু-শিপ (এসটিএস) স্থানান্তর সাধারণ বিষয় ছিল। সেটি এখন আর হচ্ছে না।’ মূলত নিষেধাজ্ঞা ও বিক্ষোভ এড়াতে এ ধরনের ক্ষেত্রে ডেনমার্ক উপকূলের প্রতি আর আগ্রহী নয় মস্কো।
ভূমধ্যসাগরে ট্যাংকারের মাধ্যমে দিনে রাশিয়ার প্রায় চার লাখ ব্যারেল তেল স্থানান্তরিত হচ্ছে। এর বেশিরভাগই যাচ্ছে এশিয়ার দেশগুলোতে। ফলে অঞ্চলটিতে দৈনিক সরাসরি পাঠানো রুশ তেলের পরিমাণ দাঁড়ায় ২ দশমিক ৩ মিলিয়ন ব্যারেল। জানুয়ারিতে ইউক্রেনে আগ্রাসনের আগে এর পরিমাণ ছিল প্রায় ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন ব্যারেল।
রাশিয়ান তেল আফ্রাম্যাক্স বা সুয়েজম্যাক্স ট্যাংকারগুলোতে লোড করা হয়, যা ১০ লাখ ব্যারেলের কম তেল বহন করে। পরে এগুলো সমুদ্রের বড় জাহাজে স্থানান্তর করা হয়, যেগুলো ২০ লাখ ব্যারেল পর্যন্ত বহনে সক্ষম। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই প্রক্রিয়া শিপিংকে আরও ব্যয়বহুল করে তোলে।
সমুদ্রপথে সরবরাহ রাশিয়ার মোট রফতানির একটি অংশ মাত্র। পাইপলাইনের মাধ্যমেও জ্বালানি সরবরাহ করে থাকে দেশটি। এপ্রিলে দেশটির দৈনিক মোট অপরিশোধিত তেল ও তেলজাত পণ্য রফতানির পরিমাণ ৮০ লাখ ব্যারেল বেড়ে যুদ্ধের আগের অবস্থায় পৌঁছেছে।
পশ্চিম আফ্রিকার অপরিশোধিত তেল
রাশিয়ান তেলের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ইউরোপীয় রিফাইনাররা পশ্চিম আফ্রিকার অপরিশোধিত তেল আমদানির দিকে ঝুঁকছেন। পেট্রো-লজিস্টিকের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮-২০২১ সালের গড়ের তুলনায় গত এপ্রিলে এটি ১৭ শতাংশ বেড়েছে।
এইকনের তথ্য অনুযায়ী, উত্তর-পশ্চিম ইউরোপে মে মাসে দৈনিক আসা ছয় লাখ ৬০ হাজার ব্যারেল তেলের বেশিরভাগই এসেছে নাইজেরিয়া, অ্যাঙ্গোলা ও ক্যামেরুন থেকে। নাইজেরিয়ান আমেনামের তিনটি কার্গোর মাধ্যমে এগুলো সরবরাহ করা হয়েছে; যেখানে গত ফেব্রুয়ারিতে এ ধরনের কার্গোর সংখ্যা ছিল মাত্র একটি।
গারবারের মতে, ভারতে পশ্চিম আফ্রিকার অপরিশোধিত তেলের পরিমাণ প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। এপ্রিল মাসে এটি দুই লাখ ৮০ হাজার বিপিডিতে (ব্যারেল পার ডে) পৌঁছেছে। আগের মাসে এর পরিমাণ ছিল পাঁচ লাখ ১০ হাজার বিপিডি। ভারত রুশ সরবরাহের প্রতি মনোযোগী হওয়ার ফলে এমন চিত্র দেখা গেছে।
পেট্রো-লজিস্টিকস জানিয়েছে, উত্তর আফ্রিকা থেকে ইউরোপে সরবরাহ ৩০ শতাংশ বেড়েছে। এরমধ্যে মিসর থেকে উত্তর-পশ্চিম ইউরোপে যাওয়া তেলও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও ইউরোপে সরবরাহ বাড়িয়েছে।