বন্যায় সিলেটে অনেক রাজনৈতিক দল, নেতা ও জনপ্রতিনিধিকে খুঁজে পাওয়া যায়নি ॥ ত্রাণ তৎপরতায় এগিয়ে বিভিন্ন দলের ১৮ নেতা

175

সোয়েব বাসিত :
সিলেটে বন্যায় জনগনের পাশে ছিলেন না অধিকাংশ সিটি কাউন্সিলর। নগরীর যে সব এলাকা বন্যা কবলিত ঐ সব এলাকার কাউন্সিলররাও ছিলেন ধরা ছোয়ার বাইরে। হাতে গুনা কয়েকজন কাউন্সিলরকে মাঠে দেখা গেলেও ত্রাণ তৎপরতা ছিলো একেবারেই “নাম কা ওয়াস্তে”। এ নিয়ে চরম ক্ষুব্ধ সংশিষ্ট ওয়ার্ডের ভোটার সহ সাধারণ মানুষ। কাউন্সিলর দের পাশাপাশি বন্যায় মাঠে দেখা যায়নি এমন কিছু রাজনৈতিক দল ও সংগঠনকে যাদের সরকার বিরোধী নানা ইস্যুতে রাজপথে প্রায়ই তৎপর থাকতে দেখা যায়। এ তালিকায় বাম ঘরানার বাসদ, ন্যাপ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদসহ আরো বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও সংগঠন রয়েছে।
এছাড়া বঙ্গবীর কাদের সিদ্দীকির কৃষক শ্রমিক জনতালীগ, মেজর ইব্রাহিম এর কল্যাণ পার্টি, মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য ডঃ রেজা কিবরিয়া ও ভিপি নুরের গণ অধিকার পরিষদ, ডাঃ ইরানের লেবার পার্টি সহ আরো কিছু দলের কোন নেতা-কর্মীকে সিলেটে বন্যা কবলিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। গত ১৭ মে থেকে সৃষ্ট বন্যায় দুর্গত মানুষের পাশে সবার আগে আট ঘাট বেধে নেমে পড়ে সরকারী দল আওয়ামী লীগ। এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিলো না প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও। তবে ত্রাণ বিতরণ ও দুর্গত মানুষের জন্য নিরলস কাজ করার এগিয়ে ছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ দুই নেতা। এদের একজন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন আর অপর জন সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং বর্তমানসহ সভাপতি আসাদ উদ্দিন আহমদ। আবার এই দুই নেতা মধ্যে ত্রাণ বিতরণের সংখ্যা গত দিয়ে এগিয়ে ছিলেন অধ্যাপক জাকির। তিনি ৩০টির অধিক ত্রাণ বিতরণ করেছেন। মহানগর আওয়ামীলীগের শীর্ষ এই দুই নেতা সরকারী বেসরকারী ছাড়াও নিজ উদ্যোগসহ বিভিন্ন সংস্থা এবং সংগঠনের পক্ষ থেকে ত্রান বিতরণের পাশাপাশি দুর্গত এলকা পরিদর্শন ছাড়াও প্রতিনিয়ত খোঁজ খবর নিয়েছেন বানবাসি মানুষের। তবে এই দুই নেতা ছাড়াও মহানগর আওয়ামীলীগের সভাপতি মুক্তিযুদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ, সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, মহনগর আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ডাঃ আরমান আহমদ শিপলু, জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খান ও ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেছেন। বিএনপি নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তৎপর ছিলেন মহানর বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক এমদাদ হোসেন চৌধুরী। তবে এ ক্ষত্রে ব্যতিক্রম ছিলো জেলা বিএনপি। নবগঠিত জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কইয়ুম ও সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট এমরান আহমদ আহমদ সিলেট নগরী ছাড়াও সিলেটের বিভিন্ন জেলা উপজেলায় ত্রাণ বিতরণ ও দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে অনেকটাই নজর কেড়েছেন। ছাত্র ও যুব সংগঠন গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি তৎপর দেখা গেছে মহানগর যুবলীগকে। তবে খুঁজে পাওয়া যায়নি যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও স্বেচ্ছাসেবকলীগকে।
মহানগর যুলীগের সভাপতি আলম খান মুক্তি ও সাধারণ সম্পাদক মুশফিক জায়গিরদার কাজ করছেন দুর্গতদের জন্য। এছাড়া জেলা যুবলীগের সভাপতি ভিপি শামীম বেশ কিছু জায়গায় ব্যক্তি বিশেষের উদ্যোগে ত্রাণ দিয়েছেন। ছাত্র সংগঠন গুলোর মধ্য ছাত্রলীগ ও ছাত্র শিবিরকে খুব একটা তৎপর দেখা না গেলে কিছু কিছু জায়গায় ত্রাণ দিয়েছে ছাত্রদল। যদিও বিতরণের চাইতে তাদের মূল উদ্দেশ্যই ছিল স্যোসাল মিডিয়ায় প্রচার ত্রাণ বিতরণের ধরণ দেখে এমনটাই মনে হয়েছে। ইসলামী ছাত্র সংগঠনের মধ্যে তালামিযের ইসলামীয়ার কিছু ত্রাণ তৎপরতা চালিয়েছে জকিগঞ্জ কেন্দ্রীক। বন্যায় ইসলামি দলগুলোর মধ্যো জামাতে ইসালামি। খেলাফত মজলিস ইসলামি আন্দলন ও ফুলতলীর আনজুমানে আল-ইসলাহ উপজেলা ভিত্তিক কিছু কিছু জায়গায় ত্রাণ দিয়েছে। জামাতের আমির ডাঃ শফিকুর রহমান, সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়েরকে কানাইঘাট জৈন্তা গোয়াইনঘাটে ও ছাতকে ত্রাণ বিতরণ করতে দেখা গেছে। আর আল ইসলাহর মাওলানা ইমাদ উদ্দিন ফুলতলিকে নৌকা দিয়ে জকিগঞ্জের বন্যা দুর্গতদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ত্রাণ দিয়েছেন। এর বাইরে ইসলামের দাবিদার অন্য দলগুলো ছিলো একেবারেই নিরব। বিশেষ করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে আলোচিত হেফাজতে ইসলামকে ভয়াবহ এ বন্যায় কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এ বন্যায় ছিলো একেবারেই লোক চক্ষুর অন্তরালে। তবে জেলা জাতীয় পার্টির আহবায়ক কুনু মিয়াকে তার নির্বাচনি এলাকা গোলাপগঞ্জের দু একবার ত্রাণ দিতে দেখা গেছে। তবে এ ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম ছিলেন সাবেক জাতীয় ছাত্র সমাজ নেতা মিজুবুর রহমান ডালিম। তিনি সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের পক্ষ থেকে কানাইঘাটে কিছু ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেছেন। তবে স্থানীয়রা জানিয়েছেন আগামি উপজেলা নির্বাচনে তিনি ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী হবেন এ উদ্দেশ্যই মাঠে নেমেছেন।
এবারের আকস্মিক বন্যায় নগরীর সুরমা নদী তীরবর্তি এলাকা গুলোর অধিকাংশই প্লাবিত াবিত হয়ে পড়ে। এর বাইরে ও নগরীর বেশ কিছু এলকায় সৃষ্টি হয় মারাত্মক জলাবদ্ধতা। জলাবদ্ধতার কারণে কোথাও কোথাও যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। নগরীর অভিজাত এলাকা হিসাবে পরিচিত শাহজালাল উপশহরে এবার সৃষ্টি হয় নজিরবিহীন বন্যা ও জলাবদ্ধতা। ১৭ মে থেকে প্রায় এক সপ্তাহ ঐ এলাকায় এমন অবস্থা চললেও খুব একটা দেখা যায়নি স্থানীয় কাউন্সিলর সালেহ আহমদ সেলিমকে।
তবে মহানগর আওয়ামী লীগের ত্রাণ বিতরণের দু একটি কর্মসূচিতে তার উপস্থিতি থাকলেও এর বাইরে তার আর কোনো তৎপরতা ছিলো না। বন্যা কবলিত সময়টাতে এলাকাবাসি নৌকা দিয়ে চলাচল করলেও স্থানীয় এ কাউন্সিলর ছিলেন অন্তরালে। এমন কি বন্যা পরবর্তি দুর্ভোগ নিরসনেও তাকে দেখা যাচ্ছে না বলে এলকাবাসির অভিযোগ।
বন্যাকালিন সময়ে মেয়র আরিফুল হক ছিলেন লন্ডন সফরে। ঐ সময়ে ভারপ্রাপ্ত মেয়র ছিলেন ২৬ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলরও প্যানেল মেয়র তৌফিক বক্স লিপন। তার ওয়ার্ডের বড় একটি অংশ ছিল বন্যা ও জলাবদ্বতার শিকার। ঐ সময় তিনি নগরীর বন্যা কবলিত কিছু কিছু এলাকা পরিদর্শন ও ত্রান বিতরনসহ নানা কাজে বেশ তৎপর ছিলেন। এছাড়া আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণের কর্মসূচিতে ও তাকে সরব দেখা গেছে।। অনেকেই ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসাবে তার এরকম কাজের প্রশংসা করেছেন।
নগরীর ৯নং ওয়ার্ডের তপোবন, সুরমা ও নরসিংটিলা এলকাসহ আরো কিছু এলকার মানুষ ছিল এবারের বন্যায় মারাত্বক ভাবে পানি বন্দি। এ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মকলিছুর রহমান কামরান। বন্যায় দুর্গত মানুষের পাশে তাকে দেখা যায়নি। তবে মেয়র আরিফুল হক দেশে ফরার পর তাকে সঙ্গে নিয়ে বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শন করা ছাড়া উল্লেখ আর কোন ত্রাণ তৎপরতা চোখে পড়েনি চার বারের নির্বাচিত এ কাউন্সিলর ও সাবেক প্যানেল মেয়রের।
নগরীর ১০ ওয়ার্ডের বেতের বাজার, মোল্লাপাড়া, ঘাসিটুলা ও কাবিশাইল শামিমাবাদসহ কয়েকটি এলাকার বেশির ভাগ বাসা বাড়ি এবারের বন্যায় তলিয়ে যায়। স্থানীয় স্কুল ও মাদ্রাসায় খোলা হয় আশ্রয়ণ কেন্দ্র। এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তারেক উদ্দিন তাজ দু একদিন এসব আশ্রয়ণ কেন্দ্র ঘুরে দেখা ছাড়া কাজের কাজ আর কিছুই করেননি। তবে আগামি নির্বাচনে যারা প্রার্থী হতে চান এ রকম অত্যন্ত দুজন সম্ভাব্য নারী কাউন্সিলর প্রার্থীকে দেখা গেছে দুর্গত মানুষের মাজে ত্রাণ বিতরণ করতে।
নগরীর ১২ নং ওয়ার্ডের বেশ কিছু এলাকা সুরমা নদী তীরবর্তি হওয়ায় বন্যা এই এলকার ধান চালের ব্যবসায়ি ও মিল মালিক সহ সহ সাধারণ মানুষকে অতি মাত্রায় দুর্ভোগ ও ক্ষতিগ্রস্ত করলেও এ সময়টাকে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর সিকন্দর আলীকে পরিস্থতি মুকাবেলায় জুরালো ভাবে মাঠে দেখা না গেলেও তার ভাই জাতীয়তাবাদি মৎসজীবী দলের হাজী জাহাঙ্গীর দলের পক্ষ থেকে ব্যাপক ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেছেন। তিনি রান্না করা খাবার ছাড়াও শুকনো খাবার দিয়েছেন দুর্গত মানুষকে।
নগরীর ১৩ নং ওয়ার্ড এর কিছু কিছু এলাকা ছিলো মারাত্মক ভাবে বন্যা কবলিত। এ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শান্তনু দত্ত শন্তু বন্যায় ত্রাণ তৎপরতা চালিয়েছেন বেশ জোরে সুরে। তবে রান্না করা খিচুড়ি বিতরণ করা ছাড়া অন্য কোন ত্রাণ তৎপরতা তার ছিলো না।
নগরীর ২৫নং ওয়ার্ডের কিছু এলাকা ছিলো বন্যা কবলিত। কিন্তু ঐ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তাকবিরুল ইসলাম পিন্টু ছিলেন ধরা ছোয়ার বাইরে। এমনিতেই তার উপর রয়েছে ওয়ার্ডের সাধরণ মানুষের নানা অভিযোগ তার উপর ভয়াবহ এই বন্যায় তাকে না পাওয়ায় এলাকার মানুষ তার উপর চরম ক্ষুব্ধ।
২৭ নং ওয়ার্ডের খুশিঘাট এলাকায় বন্যা কবলিত মানুষের মধ্যে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেছেন কাউন্সিলর আজম খানকে। অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি ত্রাণ তৎপরতা চালিয়েছেন বলে কাউন্সিলর আজম খান নিজেই।
এবার লন্ডনে থাকায় মাঠে ছিলেন না ২০ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও মহানগর আওয়ামীলীগের যুগ্ম সম্পাদক আজাদুর রহমান আজাদ। তবে তার অনুগত কর্মি সমর্থকরা তার পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ করেছেন বলে জানা গেছে।
যেসব রাজনৈতিক দল ও সংগঠন মানুষের দু:সময়ে তাদের পাশে দাড়ায় না এ বিষয়ে সিলেট মহানগর আওয়ামীলীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ বলেন, এদের রাজনীতি সম্পর্কে আমার সন্দেহ আছে। এরা আসলে মানুষের জন্য রাজনীতি করে না। এদের রাজনীতি হচ্ছে স্বার্থসিদ্ধির রাজনীতি।
সিলেট মহানগর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন বলেন, দু:সময়ে যারা মানুষের পাশে থাকে না এগুলো আসলে রাজনৈতিক দল নয় এবং এদের যারা পৃষ্টপোষকতা করেন তারাও রাজনীতিবিদ নয়। এরা চক্রান্তকারী ষড়যন্ত্রকারী। তিনি বলেন, এরা পিছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় যেতে চায়।
সিলেট মহানগর আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি আসাদ উদ্দিন বলেন, এটা দু:ভাগ্যজনক যে মানুষের দু:সময়ে এদের পাওয়া যায় না অতচ সরকারের বিরুদ্ধে নানা ইস্যুতে এদের রাজপথে সরব দেখা যায়। তিনি বলেন, এ কারনেই জনগণ এদের বিশ্বাস করে না। এরা জনগণ থেকে প্রত্যাখাত।
এ বিষয়ে সিলেট জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট এমরান আহমদ বলেন রাজনীতিটাই তো মানুষের জন্য। তবে এ বন্যায় যাদের মাঠে দেখা যায়নি তাদের হয়তো দলীয় এস্টাকচার টাই ওরকম কিংবা একটি রিমোট এলাকায় কাজ করার মত ঐ রকম শক্তি তাদের নেই। এমরান আহমদ অভিযোগ করে বলেন সরকারের পক্ষ থেকে যে ত্রাণ তৎপরতা চালানো হচ্ছে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।