কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রায় এক সপ্তাহ ধরে দেশের উত্তরবঙ্গে জ্বালানি তেল বিশেষ করে পেট্রোল নিয়ে হাহাকার চলছে। পূর্ব কোন ঘোষণা ছাড়াই জ্বালানি নেই অজুহাতে পাম্পে তেল বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে মালিকরা। ফলে ঈদ মৌসুমে জ্বালানির সঙ্কটে এই অঞ্চলের মানুষদের পোহাতে হচ্ছে চরম দুর্ভোগ। তবে সবরাহে কোন ঘাটতি নেই বলে দাবি করেছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ। তবুও কেন সঙ্কট কাটছে না, তা তদারকিতে একাধিক টিম মাঠে তদন্ত করছে বলেও জানিয়েছেন জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মোঃ মাহবুব হোসেন। এদিকে চালকরা অভিযোগ করছে, ঈদ মৌসুমকে ঘিরে দাম বাড়াতেই জ্বালানি তেলের কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করা হয়েছে। তাদের অভিযোগ পাম্পে গিয়ে পেট্রোল পাওয়া না গেলেও খোলা বাজারে ঠিকই পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীদেরই বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে পেট্রোল-অকটেনের অভাবে। তাই দ্রুত এ সমস্যার সমাধান করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন চালকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সোমবার বিকেল পর্যন্তও উত্তরবঙ্গের প্রবেশপথ বগুড়াসহ রাজশাহী, নাটোর, দিনাজপুরের পেট্রোলপাম্পগুলোতে জ্বালানি তেলের সঙ্কট ছিল। বেশিরভাগ পাম্পেই ছিল না পেট্রোল-অকটেনের সরবরাহ।
ঈদের ছুটির পর থেকেই হঠাৎ করে রাজশাহীতে তৈরি হয় পেট্রোল-অকটেনের সঙ্কট। পেট্রোল পাম্প মালিকদের দাবি, চাহিদার তুলনায় তেলের সরবরাহ কম। নগরীর বেশিরভাগ পাম্পগুলোতেই চাহিদার তুলনায় মোটরসাইকেল বা প্রাইভেট কার চালকদের কম করে তেল দেয়া হচ্ছে। আবার অনেক পাম্পে পেট্রোল আছে তো অকটেন নেই, অকটেন আছে তো পেট্রোল নেই। নগরীর বাইরে উপজেলা পর্যায়ের কিছু পাম্পে পেট্রোল-অকটেন কোনটাই মিলছে না। এ সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী খুচরা পর্যায়ে বাড়তি দরেও জ্বালানি তেল বিক্রি করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে রাজশাহী জেলা পেট্রোল পাম্প এ্যান্ড ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মমিনুল হক জানান, জেলার ৯টি উপজেলায় ৪৮ টি তালিকাভুক্ত পেট্রোল রয়েছে। প্রায় তিন মাস থেকে এগুলোতে পর্যাপ্ত পেট্রোল-অকটেন আসছে না। ঈদ-উল-ফিতরের ছুটিতে এ সঙ্কট আরও বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ জন্য পাম্পগুলো প্রায় তেলশূন্য হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, ঈদের আগে কোনভাবে ক্রেতাদের চাহিদা কমবেশি পূরণ করা গেলেও ঈদের পর আর তা সম্ভব হচ্ছে না। পেট্রোল-অকটেনের পাশাপাশি ডিজেলেরও সঙ্কট রয়েছে বলে জানান তিনি।
একই তথ্য জানান দিনাজপুর প্রতিনিধিও। তিনি জানান, দিনাজপুরেও প্রায় এক সপ্তাহ ধরে পেট্রোলের জন্য হাহাকার চলছে। বাধ্য হয়ে অকটেন ব্যবহার করছেন মোটরসাইকেল চালকরা। তবে অকটেনের বিক্রি বাড়ায় অনেক পাম্পে এ জ্বালানিরও সঙ্কট দেখা দিয়েছে। তবে পাম্পে সঙ্কট থাকলেও খোলা বাজারে ৮৬ টাকা লিটারের পেট্রোলের দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। অভিযোগ পাওয়া গেছে, খোলা বাজারে প্রতিলিটার পেট্রোল বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১৩০ টাকায়।
একই অবস্থা নাটোর, নীলফামারী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, গাইবান্ধা, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রামেও। সব জেলা থেকেই অভিযোগ পাওয়া গেছে পেট্রোল ও অকটেনের প্রবল সঙ্কটের কথা। তেল না পেয়ে এসব এলাকার পাম্পগুলো থেকে ফিরে যাচ্ছেন যানবাহন পরিচালকরা। আর পাম্পগুলোর মালিকরা বলছেন, সরবরাহ কম থাকায় সৃষ্টি হয়েছে এ সমস্যার। কুড়িগ্রাম পেট্রোল পাম্প সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নজরুল ইসলাম জানান, ঈদ ঘিরে জেলায় পরিবহন সংখ্যা বেড়েছে। তার ওপর উত্তরবঙ্গে জ্বালানি তেল ব্যবহারের বিকল্প না থাকায় সঙ্কটের মাত্রা এখন উর্ধমুখী। একই দশা নীলফামারীর পেট্রোল পাম্পগুলোতেও। জ্বালানি তেলের খোঁজে প্রতিদিনই এক পাম্প থেকে আরেক পাম্পে ছুটছেন যানবাহন চালকরা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, পেট্রোল-অকটেন সরবরাহ বন্ধ রেখেছে ডিপোগুলো। ফলে তীব্র হয়েছে সঙ্কট। সমস্যা সমাধানে জেলাভিত্তিক তেল বণ্টনের দাবি তাদের। নীলফামারীর ৬ উপজেলায় পাম্প রয়েছে ৩৬টি। পাম্প কর্তৃপক্ষের দাবি, এক লিটারও মজুদ নেই তাদের।
তবে সরবরাহ সম্পূর্ণ স্বাভাবিক রয়েছে বলে দাবি করেন জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মোঃ মাহবুব হোসেন। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, আমাদের সরবরাহে কোথাও ঘাটতি নেই। আপনারা জানেন, ঈদের ছুটিতে একটা বিরাট সংখ্যার মোটরসাইকেল উত্তরবঙ্গের দিকে গেছে। ফলে স্বভাবতই পেট্রোল আর ডিজেলের ওপর চাপ পড়েছে। কিন্তু আমাদের বাড়তি প্রস্তুতিও ছিল। এখনও বাড়তি সরবরাহ রয়েছে। কিন্তু তারপরও কেন এ সঙ্কট তৈরি হয়েছে- তা খতিয়ে দেখতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমাদের নিজেদের টিমও মাঠে কাজ করছে। আশা করছি, দুই-একদিনের মধ্যেই সব সঙ্কট মিটে যাবে। কারণ পেট্রোল-ডিজেল তো মজুদ করে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরির কোন উপায় নেই। কারণ জ্বালানি তেল মারাত্মক দাহ্য পদার্থ। এটি পেট্রোল পাম্প ছাড়া যেখানে সেখানে বেশি মজুদের কোন উপায় নেই। তবু কেউ যদি এ রকম মারাত্মক অসাধু উপায় গ্রহণ করে থাকে, তাহলে তার বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
নীলফামারীর পাম্প থেকে জ্বালানি তেল উধাও : ফিলিং স্টেশনগুলো থেকে পেট্রোল ও অকটেন উধাও হয়ে গেছে। জেলার সব ফিলিং স্টেশনে পেট্রোল ও অকটেন নেই বলে কাগজ ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে পেট্রোল ও অকটেন পাওয়া যাচ্ছে খোলা বাজারে অতিরিক্ত দামে। এ অবস্থায় গ্রাহকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তাদের অভিযোগ, সঙ্কট দেখিয়ে পেট্রোল অকটেন নিয়েও কারসাজি করছে ফিলিং স্টেশনগুলো।
সোমবার ফিলিং স্টেশনগুলো বলছে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে রেলহেড অয়েল ডিপোতে মজুদ আশঙ্কাজনক হারে কমে যাওয়ায় উত্তরাঞ্চলের ৮ জেলায় পেট্রোল ও অকটেনের সরবরাহ প্রায় ১৫ দিন ধরে বন্ধ রয়েছে। এ ডিপোতে দৈনিক পেট্রোলের চাহিদা ১ লাখ ৮০ হাজার লিটার। বর্তমানে প্রতি সপ্তাহে মাত্র ১ লাখ ৮০ হাজার লিটার ডিপোতে পেট্রোল সরবরাহ দেয়া হচ্ছে।
এদিকে জেলার বিভিন্ন স্থানে খোলা বাজারে বিভিন্ন স্থানে খোলা বাজারে ১৫০ টাকা দরে পেট্রোল ও অকটেন বিক্রি হচ্ছে। অথচ পেট্রোলের নির্ধারিত মূল্য ৮৯ টাকা ও অকটেন ৯৫ টাকা লিটার। তবে কিছু কিছু পা¤েপ পাওয়া যাচ্ছে অকটেন। শহরের বিভিন্ন পা¤প ঘুরে দেখা গেছে, পেট্রোল দেয়ার মেশিনের সামনে পেট্রোল ও অকটেন নেই লেখা কাগজ ঝুলছে।
নীলফামারীর সৈয়দপুর শহরের ইকু ফিলিং স্টেশনের মালিক মোঃ সিদ্দিকুল আলম জানান, প্রায় মাস আগে থেকে পেট্রোল ও অকটেন সঙ্কট দেখা দেয়। পার্বতীপুর তেল ডিপোতে পেট্রোল ও অকটেন না পেয়ে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী ডিপো থেকে জ্বালানি তেল এনে পা¤পগুলো চালাতে হচ্ছিল। কিন্তু এখন বাঘাবাড়ী ডিপোতেও পেট্রোল ও অকটেন পাওয়া যাচ্ছে না। তবে পা¤পগুলোতে ডিজেল সরবরাহ রয়েছে।
সমতা ফিলিং স্টেশনের হিসাবরক্ষক হেলাল হোসেন বলেন, তেলের প্রধান ডিপো থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে পেট্রোল ও অকটেন নেই। তাই আমরাও তেল বিক্রি করতে পারছি না।
সারাদেশে জ¦ালানি তেলের সরবরাহ
অব্যাহত রেখেছে বিপিসি : সারাদেশে জ¦ালানি তেলের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)। সংস্থার আওতাধীন তেল বিপণন কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে এ কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। বর্তমানে দেশের অকটেন ও পেট্রোলের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। এ নিয়ে কোন শঙ্কা নেই বলে বিপিসি সূত্রে জানানো হয়েছে।
বিপিসি জানিয়েছে, দেশের জ¦ালানি তেলের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে আমদানি ও সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। সোমবার এমটি ক্রিমসন জেড জাহাজযোগে প্রায় ২৭ হাজার মেট্রিন টন জ্বালানি তেল চট্টগ্রামে এসে পৌঁছেছে। অপর একটি জাহাজ ২৫ হাজার মেট্রিকটন অকটেন নিয়ে চলতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহ নাগাদ চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছাবে। সঙ্কট যেন না হয় সে ব্যাপারে কর্পোরেশন যথেষ্ট সজাগ আছে। বিপিসির দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, গত ৮ মে সারাদেশে অকটেন ও পেট্রোলের মোট মজুদ ছিল যথাক্রমে প্রায় ১৯ হাজার ১৪৯ এবং ১৯ হাজার ৩৯৬ মেট্রিক টন। মে ও জুন মাসে ৫০ হাজার মেট্রিক টন করে মোট ১ লাখ মেট্রিক টন অকটেন আমদানির সূচী চূড়ান্ত করা হয়েছে।
এদিকে দেশের একমাত্র জ¦ালানি তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড এবং তেল উৎপাদনকারী ও দেশীয় বেসরকারী প্ল্যানসমূহে অকটেন ও পেট্রোল উৎপাদন অব্যাহত রয়েছে, যা জ¦ালানি তেলের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহকে আরও সুসংহত করবে। উল্লেখ্য, দেশীয় উৎপাদন দ্বারাই পেট্রোলের সম্পূর্ণ চাহিদা পূরণ করা হয়ে থাকে। এর জন্য কোন আমদানি করতে হয় না। দেশে অকটেন ও পেট্রোলের স্বাভাবিক গড় মাসিক চাহিদা যথাক্রমে প্রায় ৩৬ হাজার মেট্রিক টন এবং ৩৯ হাজার মেট্রিক টন।
বিপিসির পক্ষ থেকে জানানো হয়, দেশে পর্যাপ্ত মজুদ থাকা সত্ত্বেও ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষে যাত্রী পরিবহনে প্রাধান্য প্রদানসহ ইঞ্জিন স্বল্পতার কারণে বিভিন্ন ডিপোতে অকটেন ও পেট্রোল সরবরাহে নির্ধারিত সময়ের তুলনায় কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। তবে ইতোমধ্যে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন ফিলিং স্টেশনের অনুকূলে অকটেন ও পেট্রোল চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা হচ্ছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে যাবে। ডিজেলসহ অন্যান্য জ¦ালানি তেলের মজুদ ও সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে।