কাজিরবাজার ডেস্ক :
মিল মালিকদের কারসাজিতে ফের বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহ চেন ভেঙ্গে গেছে। সরবরাহ কমে যাওয়ায় তীব্র সঙ্কটের মুখে বাড়ছে সব ধরনের ভোজ্যতেলের দাম। ঈদ সামনে রেখে তেলের বাজারে অরাজক অবস্থা তৈরি হয়েছে। ফলে বাজার থেকে ধীরে ধীরে উধাও হয়ে যাচ্ছে ভোজ্যতেল। এ অবস্থায় ভোজ্যতেলের বাজার দ্রুত স্বাভাবিক করার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ভোক্তা অসন্তোষ তৈরি হওয়ার আগেই বাজারে তেলের সরবরাহ বাড়ানোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। কোম্পানিগুলো নিজেরা খুচরা পর্যায়ে কিছু ভোজ্যতেল সরবরাহ করলেও চাহিদার তুলনায় তা খুবই নগণ্য। ফলে বাজারে দিন দিন সঙ্কট চরম আকার ধারণ করেছে। ভোজ্যতেলের আন্তর্জাতিক মূল্য টনপ্রতি ১ হাজার ৮৭০ ডলারের সমন্বয় করে অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্য নির্ধারণ করতে চায় মিলাররা। এ কারণে সরকার নির্ধারিত দামে তেল সরবরাহ প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে কোম্পানিগুলো। ব্র্যান্ডভেদে বোতলজাত কিছু ভোজ্যতেল নির্ধারিত দামে বিক্রি হলেও খোলা সয়াবিন ও পামওয়েল অনেক বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। অস্থির হয়ে উঠছে দেশের ভোজ্যতেলের বাজার।
জানা গেছে, দেশের কোথাও সরকার নির্ধারিত দামে খোলা ভোজ্যতেল পাওয়া যাচ্ছে না। সরবরাহ কমায় অনেকটা উধাও হয়ে গেছে খোলা পামওয়েল ও সয়াবিন তেল। পাইকারি বাজার হিসেবে খ্যাত ঢাকার মৌলভীবাজারে ভোজ্যতেল বিক্রি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এ মার্কেটের প্রায় অর্ধশতাধিক পাইকারি ব্যবসায়ী মিল থেকে ভোজ্যতেল পাচ্ছে না। ফলে ঢাকা মহানগীর খুচরা পর্যায়ের কিছু ব্যবসায়ী বাধ্য হয়ে মিল থেকে চাহিদার তুলনায় সামান্য তেল এনে বাজারে বিক্রি করছেন। ঢাকার মতো দেশের অন্যান্য জেলা পর্যায়েও তেলের সরবরাহ কমে গেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে ভোজ্যতেল নিয়ে বড় ধরনের ভোক্তা অসন্তুষ্ট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এদিকে দ্রুত ভোজ্যতেলের সরবরাহ চেন স্বাভাবিক করতে বৃহস্পতিবার দুপুরে মৌলভীবাজার পরিদর্শনে যান জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান। ওই সময় তিনি পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকও করেন। তবে সেই বৈঠক যে ফলপ্রসূ হয়েছে-এমনটিও মনে করছেন না ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, মিলারদের কারসাজির কারণে ভোজ্যতেলের সরবরাহ চেন পুরোপুরি ভেঙ্গে গেছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, ঈদের আগে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর কোন সুযোগ নেই। এ বিষয়টি ভোক্তা অধিদফতর থেকে তাদের (ব্যবসায়ী) স্পষ্ট জানিয়ে দেয়া হয়েছে। বাজারে তেলের সরবরাহ কমে গেছে স্বীকার করে তিনি বলেন, দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, মৌলভীবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করা হয়েছে। তাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে- ঈদের আগে দাম বাড়ানোর আর কোন সুযোগ নেই। সরকার নির্ধারিত দামেই ভোজ্যতেলে বিক্রি করতে হবে। মিল থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা যাতে তেল আনতে পারেন সে বিষয়ে মিল মালিকদের নির্দেশ দেয়া হবে। এছাড়া ভ্যাট কমানোর সুবিধা নিয়ে দ্রুত ভোজ্যতেল আমদানির জন্য পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এদিকে খুচরা বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, খোলা সয়াবিন ও পামওয়েলের সরবরাহ মারাত্মকভাবে কমে গেছে। অনেক বাজারে খোলা ভোজ্যতেল পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি মূল্যে বিক্রি হচ্ছে ভোজ্যতেল। কোন কোন বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেল কেটে বিক্রি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সরকারী বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ টিসিবির দেয়া তথ্যমতে, সর্বশেষ প্রতিলিটার খোলা সয়াবিন ১৫৫-১৫৮, পামওয়েল লুজ প্রতিলিটার ১৪৫-১৪৮, পামওয়েল সুপার প্রতিলিটার ১৪৮-১৫০, সয়াবিন তেল পাঁচ লিটারের বোতল ৭৪০-৭৬০ এবং প্রতিলিটার এক লিটারের বোতল ১৬০-১৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। যদিও ঢাকার বাজারে খোলা সয়াবিন আরও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ভোক্তারা। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে মিলাররা তাদেরকে কিছু ভোজ্যতেল সরবরাহ করলেও এখন তা পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
এ অবস্থায় মৌলভীবাজারে পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে কোন ভোজ্যতেল নেই। ফলে খুচরা ব্যবসায়ীরা তেল পাচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমারস এ্যাসোসিয়েন অব বাংলাদেশ- ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ভোক্তাদের সহনীয় মূল্যে ভোজ্যতেল খাওয়ানো সরকারের দায়িত্ব। ইতোমধ্যে ভ্যাট কমানোসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হলেও খুচরা পর্যায়ে সেভাবে দাম কমেনি। এখন আবার ভোজ্যতেলের সঙ্কট দেখা যাচ্ছে। এতে করে ভোক্তা অসন্তোষ বাড়ছে। তিনি বলেন, ভোক্তার স্বার্থ সার্বিকভাবে দেখা এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমে সমন্বয় সাধন করার জন্য একক কোন মন্ত্রণালয় নেই। ভোক্তা হলো দেশের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক গোষ্ঠী। প্রতিবেশী দেশ ভারত ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণে ১৯৯৭ সালে কনজ্যুমারস এ্যাফেয়ার্স এ্যান্ড পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন নামে পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন করেছে। বাংলাদেশেও স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় বা বিভাগ গঠন করে ভোক্তার জন্য কাজ করতে হবে। ভোক্তাদের স্বার্থে এসব উদ্যোগ গ্রহণ এখন জরুরী হয়ে পড়ছে।
ভোজ্যতেল কেনাবেচায় পুরনো পদ্ধতি থেকে হঠাৎ করে বের হয়ে আসা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, খুচরা ব্যবসায়ীরা বাকিতে মৌলভীবাজার থেকে ভোজ্যতেল সংগ্রহ করে থাকেন, যেটা মিলগেট থেকে কোনদিন পাওয়া সম্ভব নয়। এ কারণে এভাবে মার্কেট স্থিতিশীল করা একটি অসম্ভব বিষয়। এ কারণে পাইকারি বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহ বাড়াতে হবে। তবে খুচরা বাজারে সরবরাহ ঠিক থাকবে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাজী মোহাম্মদ আলী ভুট্টো বলেন, মিলাররা মৌলভীবাজারে তেলের সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। দ্রুত সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে ভোজ্যতেলের সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করবে। মিল মালিকরা সরকার নির্ধারিত দামে আর ভোজ্যতেল বিক্রি করতে চাচ্ছে না। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে দাম নির্ধারণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। ওই দাম কার্যকর করতেই মিল থেকে সরবরাহ বন্ধ করে সঙ্কট তৈরি করা হচ্ছে। দ্রুত এ বিষয়ে বৈঠক করে সমাধানে পৌঁছাতে হবে। অন্যথায় যে কোন সময় বাজার ভোজ্যতেল শূন্য হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
জানা গেছে, খুচরা বাজারে কোথাও সরকার নির্ধারিত দামে ভোজ্যতেল পাওয়া যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত সয়াবিনের দাম বেড়েছে- এমন অজুহাতে দেশের বাজারে সয়াবিন তেলের দাম আরও বাড়াতে চান আমদানিকারক ও উৎপাদনকারীরা। সম্প্রতি ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ন্ত্রণে আমদানিকারক ও মিল মালিকদের সঙ্গে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরের বৈঠকেও এসব দাবি করা হয়। ওই সময় মিল মালিকরা সয়াবিন তেলের দাম সমন্বয় বা বাড়ানোর অনুরোধ জানান। বৈঠকে সিটি, মেঘনা, এস আলম, বসুন্ধরা ও টি কে গ্রুপের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। তারা আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে ভোজ্যতেলের বাজার সমন্বয় করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানান। দ্রুত সময়ে সমন্বয় না হলে বাজারে আবারও সমস্যা তৈরি হতে পারে বলে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে সতর্ক করা হয়। মূলত এর পর থেকেই বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়তে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে সরবরাহ কিছুটা কমিয়ে বাজারে আতঙ্ক তৈরি করে দাম বাড়ানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে গোড়ার বাজারের ভাই ভাই স্টোরের বিক্রয়কর্মী টিটু হাসান জানান, চাহিদামতো বোতলজাত এবং খোলা সয়াবিন তেল দেয়া হচ্ছে না। রূপচাঁদা, তীর, মেঘনা, বসুন্ধরার মতো ব্র্যান্ডগুলো কয়েকটি করে বোতল দিচ্ছে যা আনামাত্র ক্রেতারা কিনে নিচ্ছেন। তিনি বলেন, এর আগে কোম্পানির লোক জানিয়ে দিয়েছেন তেলের দাম বাড়বে। আর এখন বাড়তি দাম নেয়া হচ্ছে। এ কারণে খুচরা পর্যায়ে দাম বেড়ে গেছে।
এদিকে মিল মালিকদের দাবি, আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত সয়াবিনের দাম বেড়েছে। সরকার যে সময়ে ভ্যাট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়, তখন প্রতি টন অপরিশোধিত সয়াবিনের দাম ছিল এক হাজার ৪০৭ মার্কিন ডলার। তবে বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে এক হাজার ৮৭০ ডলারে দাঁড়িয়েছে। ফলে সরকার ভ্যাট প্রত্যাহার করলেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত দামে সয়াবিন তেল বিক্রি করায় তাদের লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে। দেশে দৈনিক পাঁচ হাজার মেট্রিক টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। এর জোগান হিসেবে পর্যাপ্ত মজুদ মিল মালিকদের কাছে আছে বলেও জানান তারা। তবে ভোক্তা অধিদফরের পক্ষ থেকে বলা হয়, ঈদের পর মে মাসে এ দাম সমন্বয় নিয়ে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এর আগে বাজাওে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর সুযোগ নেই বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে সংস্থাটি।