কাজিরবাজার ডেস্ক :
আজ মাহে রমজানুল মুবারাকের ২০তম দিবস, জুম্মাবার। ইসলাম ধর্মে জুম্মা বা জুম্মা দিনের গুরুত্ব অনেক বেশি। দুনিয়ার অনেক উত্তান পতন ও ঘটনার কালসাক্ষী এটি। পৃথিবী সৃষ্টি হয় এ দিনে। কিয়ামতও এ দিনে সংঘটিত হবে বলে হাদিস শরীফ থেকে জানা যায়। এ দিনের জুম্মার সালাত ও খুৎবাকে গরীবের হজ¦ বলা হয়ে থাকে।
রহমত মাগফিরাত ও নাজাতের মাস রমজানে জুম্মার দিবসের গুরুত্ব বহুগুণে বেড়ে যায়। কারণ এ মাসের প্রতিটি নেক কাজের সাওয়াব অন্য ১১ মাসের তুলনায় অত্যধিক।
একইভাবে আজ পবিত্র মাহে রমজানের ২০তম দিবস। রহমত ও মাগফিরাতের বার্তাবাহী দুটি দশকই আমরা আজ অতিক্রম করছি। ইনশাআল্লাহ, আগামী কালের সূর্য উদয় হবে নাজাতের পয়গাম নিয়ে। রমজানের কঠিন অনুশীলন আমাদের একে একে বিশুদ্ধ আত্মা ও পরিশীলিত সমাজ গঠনের অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করে চলেছে। ইসলামে এমন কোন আনুষ্ঠানিকতার দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে না যাতে করে একে নেহায়েত আনন্দ উল্লাসের কিম্বা ভোগ বিলাসের ধর্ম হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। বরং ইসলামের প্রতিটি অনুষ্ঠান তা সে ব্যক্তিগত পর্যায়ে হোক আর সামাজিকভাবে পালনযোগ্যই হোক একটি বৃহত্তর সামাজিক গুরুত্ব বহন করে। রমজানের ত্রিশটি দিন ব্যক্তিগতভাবে রোজা পালনেরও তেমনি একটি সামাজিক গুরুত্ব রয়েছে।
বিশ্বব্যাপী মুসলিম জাতি রোজা পালনের মাধ্যমে যেমন ব্যক্তিগত আত্মশুদ্ধি অর্জন করেছে, তেমনি সামাজিকভাবেও তা তাদের মধ্যে শুদ্ধতা সৃষ্টির মাধ্যম। একমাত্র আল্লাহর শাস্তির ভয় ও পুরস্কারের প্রত্যাশায় কঠোর সিয়াম সাধনার মাধ্যমে সংযমের যে দৃঢ়তা বোধ সৃষ্টি হচ্ছে তা সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হবে এটা আশা করা যায়। আর এভাবেই সমাজের একজন সুনাগরিকের প্রধান গুণটি অর্জিত হয়ে থাকে।
এখন ঘরে ঘরে মা-বোনদের চলছে ইতিকাফ সাধনার স্বপ্ন, মসজিদে মসজিদে ধর্মপ্রাণ মুমিন মুসলমান পুরুষদের ইতিকাফের মাধ্যমে পাপ তাপ ও দুনিয়াবী লোভ লালসা থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর রাহে পড়ে থাকার সর্বাত্মক অনুশীলন। আত্মগঠনের ক্ষেত্রে ইতিকাফের উপকারিতার শেষ নেই। হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা নামক বিখ্যাত দর্শন গ্রন্থে আল্লামা শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ্ (রহ.) লিখেছেন: মসজিদের ইতিকাফ হচ্ছে আত্মিক প্রশান্তি, হৃদয়ের পবিত্রতা, চিন্তার বিশুদ্ধতা, ফেরেশতাকূলের গুণাবলি অর্জন এবং শবে ক্বদরের সৌভাগ্য ও কল্যাণ লাভসহ সকল প্রকার ইবাদতের অখন্ড সুযোগ লাভের এক সর্বোত্তম উপায়। তাই আল্লাহর রাসূল (স.) রমজানুল মুবারকের শেষ দশ দিন ইতিকাফ করেছেন এবং উম্মতের সৎ ও ভাগ্যবান লোকদের জন্য তা সুন্নতরূপে ঘোষণা করেছেন।’
ইতিকাফ হচ্ছে পবিত্র রমজান মাসের সামগ্রিক কল্যাণ ও বরকত লাভের জন্য একটি বলিষ্ঠ সহায়ক শক্তি। রমজানের প্রথম অংশে কোন কারণে যদি পূর্ণ প্রশান্তি, স্থির চিত্ততা, চিন্তা ও হৃদয়ের একাগ্রতা এবং আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন ও তার রহমতের দরজায় পড়ে থাকার সৌভাগ্য অর্জিত না হয়, সে অপূরণীয় ক্ষতি ও আফসোস পুষিয়ে দিতে করুণাময়ের পক্ষ থেকে উত্তম ব্যবস্থা হলো ইতিকাফ।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) খালিস নিয়তে ইতিকাফ পালনের সাওয়াবকে এক হাদিসে হজ¦ ও ওমরার পুণ্যের সঙ্গে তুলনা করেছেন। হযরত আয়েশা (রা.) রিওয়ায়েত করেছেন: ওফাতের পূর্ব পর্যন্ত নবী কারীম (স.) রমজানের শেষ দশদিন বরাবর ইতিকাফ পালন করেছেন এবং তার ইন্তিকালের পর তার স্ত্রীগণ ইতিকাফের এ পুণ্যধারা অব্যাহত রেখেছেন।’ (বুখারী ও মুসলিম)।
এরপর থেকে উম্মাহর দ্বীনদার মানুষগণ ব্যাপকভাবে তা পালন করে আসছে। ছোটকালে আমরাও মহল্লার মসজিদগুলোতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ময়-মুরব্বিকে ইতিকাফ গ্রহণ করতে দেখতাম। কিন্তু এ স্বল্পকালের ব্যবধানে বেশ পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে মানুষের মন মানসিকতার মাঝে। এখন মসজিদে মসজিদে একজন স্বেচ্ছাপ্রণোদিত মুতাকিফ বা ইতিকাফ করণেওয়ালা লোক পাওয়াও মুশকিল। এটি রীতিমতো উদ্বেগের বিষয়। আজকের ধর্মপ্রাণ মুরব্বি শ্রেণীর উচিত, আমাদের মহান পূর্বসূরিদের ঐতিহ্যময় সাধনার পথে নিজেদের আবগাহন করা, নিজেদের সম্পৃক্ত করা এ ধারাবাহিক সুন্নাতে নববী, সুন্নাতে আসহাব ও সুন্নাতে সালফেসালেহীনের সঙ্গে।
এভাবেই আমরা পদচ্যুত ও আদর্শচ্যুত মুসলমানরা ক্রমেই আবার ফিরে যেতে পারি পুণ্যবান সোনালি অতীতের মুসলমানদের আদর্শ জীবনের দিকে। আসলে ঐতিহ্যজ্ঞান ও ঐতিহ্য সচেতনতা বড় কথা। আজকে আমাদের সমাজে খোদাভীতিও আছে, ধর্ম কর্ম পালনের মানসিকতাও আছে, নেই শুধু ইমান ও আমলের শাখাগুলো চেনার পর্যাপ্ত জ্ঞান। দেশ ও জাতির আলিম ওলামাদের উচিত, নিজেরা পালন করে এবং অন্যদের উৎসাহিত করে সমাজে আবার ইতিকাফের মর্যাদা ও আগ্রহ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। কুপ্রবৃত্তি দমন ও চরিত্র সুনিয়ন্ত্রিতকরণের জন্য ইতিকাফ একটি বলিষ্ঠ ওয়াসিলা। কারণ মসজিদ এমন এক শান্ত শীতল পূতঃস্নিগ্ধ জায়গা যেখানে মানুষ কখনও কুচিন্তা মাথায় রাখতে চায় না।