ওসমানীনগরে মস্তকবিহীন উদ্ধার হওয়া যুবতীর লাশের লোমহর্ষক তথ্য উদঘাটন, ঘাতক স্বামী জেলে

37

স্টাফ রিপোর্টার :
ওসমানীনগরে গত ২ ডিসেম্বর রাতে অজ্ঞাত এক যুবতীর (২০) মাথাকাটা দেহ উদ্ধার করেছিল পুলিশ। এর সাতদিন পর, গত ৯ ডিসেম্বর সকালে ওই তরুণীর ছিন্ন মস্তক উদ্ধার করা হয়। উপজেলার বুরুঙ্গা ইউনিয়নের যুগিনীঘর হাওর থেকে উদ্ধার করা হয় এ ছিন্ন মস্তক। চাঞ্চল্যকর সেই ঘটনার পর প্রথম দুই সপ্তাহে কোনো কুলকিনারা পাচ্ছিল না পুলিশ। অবশেষে মিলেছে ক্লু, বেরিয়ে এসেছে প্রকৃত ঘটনা, জানা গেছে ওই যুবতীর পরিচয়।
পুলিশ জানিয়েছে, ওই যুবতীর নাম সন্ধ্যা ওরফে শাহনাজ। তিনি খ্রিস্টান থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন বিবাহিত। স্বামী মোজাম্মেল মিয়া উরফে মুজাম্মিলের (২৪) হাতে খুন হন শাহনাজ। পরকীয়ার কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে প্রথমে শ্বাসরোধ করে খুন করেন স্বামী মোজাম্মেল। পরে গলা, নাক, কান ও স্তন কেটে ফেলেন। মোজাম্মেল মিয়া ওসমানীনগর উপজেলার দক্ষিণ কলারাই (গোয়ালাবাজার) গ্রামের মৃত জিলু মিয়ার পুত্র। গত সোমবার (১৬ ডিসেম্বর) রাত ১২টার দিকে তাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। পরে আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন তিনি। সন্ধ্যা ওরফে শাহনাজের বাড়ি বরিশালে। এর বেশি পরিচয় জানাতে পারেনি পুলিশ। এছাড়া স্থানীয় মোহন নামের এক যুবকের সাথে শাহনাজের পরকীয়া ছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ। তবে তার বিস্তারিত পরিচয় জানাতে চাননি সিলেটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আমিনুল ইসলাম।
গতকাল বুধবার রাতে পুলিশের পাঠানো প্রেসবিজ্ঞপ্তি থেকে জানা গেছে, গত ২ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে ওসমানীনগর উপজেলার বুরুঙ্গা ইউনিয়নের যুগিনীঘর হাওর থেকে মস্তকবিহীন এক তরুণীর দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় পরদিন থানার এসআই শফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে অজ্ঞাতদের আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। এরপর ৯ ডিসেম্বর স্থানীয়দের কাছ থেকে খবর পেয়ে ওই তরুণীর ছিন্ন মস্তক উদ্ধার করা হয়। যে স্থান থেকে তরুণীর মস্তকহীন দেহ উদ্ধার করা হয়েছিল, এর মাত্র দুইশ’ গজ দূর থেকে ছিন্ন মস্তক উদ্ধার করা হয় বলে জানিয়েছিলেন ওসমানীনগর থানার ওসি রাশেদ মোবারক।
পুলিশ আরো জানায়, ওই তরুণীর খণ্ডিত মাথা উদ্ধারের পর আগে উদ্ধারকৃত দেহের সাথে মিল আছে কিনা, তা পরীক্ষার জন্য ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগে পাঠানো হয়। এ হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে রহস্য উদঘাটনে ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ওসমানীনগর সার্কেল) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) মো. লুৎফুর রহমান ছিলেন।
সিলেটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আমিনুল ইসলাম জানান, প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে গত ১৬ ডিসেম্বর রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে ওসমানীনগর উপজেলার বুরুঙ্গা এলাকা থেকে মোজাম্মেল মিয়া ওরফে মুজাম্মিলকে গ্রেফতার করা হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে ওই তরুণীকে নিজের স্ত্রী সন্ধ্যা ওরফে শাহনাজ হিসেবে শনাক্ত করেন মোজাম্মেল। তিনি হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার লোমহর্ষক বিবরণ প্রদান করেন।
পুলিশ জানিয়েছে, মোজাম্মেল বিগত ৫-৬ বছর ধরে রাজমিস্ত্রির কাজ করছিলেন। অন্যদিকে সন্ধ্যা ওরফে শাহনাজ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী ছিলেন। তিনি ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। এর ফলে তার পরিবার তাকে বের করে দেয়। পরে শাহনাজ ওসমানীনগরের নুরুল ইসলামের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। নুরুল ইসলাম হলেন মোজাম্মেলের খালু। গত কোরবানির ঈদে শাহনাজের সাথে পরিচয় হয় মোজাম্মেলের। পুলিশ আরো জানায়, শাহনাজের আচার-ব্যবহারে সন্তুষ্ট হয়ে এবং পরকালের কথা ভেবে মোজাম্মেলের মা ও আত্মীয়স্বজন শাহনাজকে মোজাম্মেলের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে চান। মোজাম্মেলও রাজি হয়ে যান। বিয়ের পর তাদের সংসার শান্তিতেই চলছিল। কিন্তু কিছুদিন পর থেকে শাহনাজের আচরণে পরিবর্তন দেখতে পান মোজাম্মেল। বাড়িতে তার মা, ভাই ও আত্মীয়স্বজনের সাথে শাহনাজের কলহ দেখা দেয়। এ প্রেক্ষিতে শাহনাজকে বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে রেখে নিজের কাজ করতে থাকেন মোজাম্মেল। দুজনের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হতো। এরই মধ্যে শাহনাজের পরকীয়ার বিষয়টি জানতে পারেন মোজাম্মেল।
পুলিশ কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলাম জানান, গত ৩০ নভেম্বর বেলা ১টার দিকে সিএনজি অটোরিক্সাযোগে দক্ষিণ সুরমার চন্ডীপুল থেকে গোয়ালাবাজার যান মোজাম্মেল ও শাহনাজ। সেখান থেকে ওসমানীনগরের উনিশ মাইল এলাকার আগে শাটকিলা নামক স্থানে অটোরিকশা থেকে নেমে পড়েন তারা। ধানী জমির মধ্য দিয়ে তারা উনিশ মাইলে মোজাম্মেলের বড় খালা ফুলমতির বাড়িতে রওয়ানা দেন। এর মধ্যে রাত হয়ে গিয়েছিল। মোজাম্মেল ও শাহনাজ হাওরের (বিল) মধ্য দিয়ে পশ্চিম দিকে যেতে থাকেন। মোজাম্মেলের হাতে ছোট গ্যাস লাইটার ছিল। যাওয়ার সময় তারা খানিক দূরে টর্চলাইটের আলো দেখে থেমে যান। এক প্রশ্নের জবাবে এই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, মোজাম্মেল ও শাহনাজ গোয়ালাবাজারে কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েছিল সম্ভবত। এজন্য রাত হয়ে গিয়েছিল সম্ভবত। তিনি আরো জানান, হাওর দিয়ে যাওয়ার পথে শাহনাজ দৈহিক মিলন করতে চাইলে মোজাম্মেল ধমক দেন। তখন শাহনাজ মোজাম্মেলকে গালিগালাজ করে বলেন, তিনি মোহন নামের এক যুবককে বিয়ে করবেন। শাহনাজ তাকে ‘আম্মা’ ডাকতে বলেন মোজাম্মেলকে। এতে ক্ষিপ্ত হন মোজাম্মেল। পরে শাহনাজের গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। তার লাশ লুকানোর চিন্তা করেন মোজাম্মেল। তিনি শাহনাজের বোরকা, জামাকাপড় সব খুলে ফেলেন এবং তার হাতব্যাগ, মোবাইল সবকিছু একত্র করেন। এরপর নিজেও উলঙ্গ হয়ে হাওরের কাদাপানি গায়ে মেখে উনিশ মাইল বাজারে যান। সেখানে ওয়ার্কশপের দোকানের বাইরে পড়ে থাকা চিকন স্টিলের পাত ও সিমেন্টের দুটি প্লাস্টারের টুকরো তুলে নেন। প্লাস্টারের টুকরো দিয়ে স্টিলের পাত ঘষে ধারালো করতে থাকেন মোজাম্মেল।
আমিনুল ইসলাম জানান, মোজাম্মেল ফের হাওরে শাহনাজের লাশের কাছে ফিরে যান। স্টিলের পাতটিকে চাকুর মতো ব্যবহার করে তার গলা কেটে মাথা বিচ্ছিন্ন করেন। এরপর তার নাক, কান, স্তন কেটে ছুড়ে ফেলেন। এছাড়া স্টিলের পাত দিয়ে শাহনাজের উরু ও পেটে একাধিক কোপ দেন তিনি। এছাড়া তার ছিন্ন মাথা একটু দূরে কাদার মধ্যে চাপা দেন। পরে সেখান থেকে সরে এসে পশ্চিম কালারাই গ্রামের দক্ষিণে নাটকিলা নদীতে ওই স্টিলের পাত ছুড়ে ফেলেন তিনি। এছাড়া শাহনাজের কাপড়চোপড়, মোবাইল সব পার্শ্বস্থ একটি ইটভাটার জ্বলন্ত চুল্লিতে ফেলে দেন।
পুলিশ জানিয়েছে, পরবর্তীতে স্থানীয় ভাগলপুরে নির্জন রাস্তায় প্রায় ৪০ মিনিট অপেক্ষা করেন মোজাম্মেল। ফজরের আজানের পর তিনি শ্যামলী বাসযোগে সিলেটে তার খালার বাসায় যান। সকালে তিনি তার চাচা জয়নালকে ফোন করে শাহনাজ বাড়িতে গেছে কিনা জিজ্ঞেস করেন এবং তার (শাহনাজ) সাথে আগের দিন থেকে যোগাযোগ নেই বলে জানান।
সিলেটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আমিনুল ইসলাম জানান, মোজাম্মেলকে গ্রেফতারের পর আদালতে সোপর্দ করা হয়। তিনি ১৬৪ ধারায় নিজের স্ত্রী শাহনাজ হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দেন। পরে আদালত তাকে কারাগারে প্রেরণ করেন।