ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর সাফল্যের গোপন মন্ত্র

5

কাজিরবাজার ডেস্ক :
সেনা, সামরিক কর্মকর্তা ও পার্লামেন্টের তদারককারীদের সোভিয়েত আমলের কঠোর বাহিনী থেকে একটি আধুনিক বাহিনীতে পরিণত করা হয়েছে। যে বাহিনী চলার পথেই চিন্তা করতে শিখে গেছে।
ইউক্রেনের ন্যাশনাল গার্ডের লেফটেন্যান্ট আন্দ্রি কুলিশ যখন রুশ সেনাদের ফাঁদে ফেলন, তখন তিনি ধন্যবাদ জানান কানাডার সেনাবাহিনী।
কানাডীয়রা গত গ্রীষ্মে শহুরে যুদ্ধের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছে লেফটেন্যান্ট কুলিশের র‌্যাপিড রেসপন্স ব্রিগেডকে। কানাডা, যুক্তরাজ্য, রোমানিয়া ও ক্যালিফোর্নিয়া ন্যাশনাল গার্ড সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যেসব প্রশিক্ষণ দিয়েছে এটি ছিল সেগুলোর একটি।
ইউক্রেনীয় ও পশ্চিমা উপদেষ্টারা বলছেন, নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন (ন্যাটো) ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর পদাতিক সেনা থেকে শুরু করে পার্লামেন্টের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তদারককারীদের প্রকাশ্যে যেসব প্রশিক্ষণ দিয়েছে এগুলো মাত্র খণ্ডাংশ। এ কারণেই সেনা সংখ্যায় বেশি ও অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত আক্রমণকারী রুশ বাহিনীর কাছ থেকে নিজেদের রক্ষা করে ইউক্রেনের চতুর যুদ্ধবাহিনী বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছে।
শ্রেণিকক্ষে পাঠদান, মহড়া ও অনুশীলনে প্রতি বছর অন্তত ১০ হাজার সেনা অংশ নিতেন। আট বছরের বেশি সময় ধরে এমন মান উন্নয়ন চলে আসছিল। ন্যাটো এবং জোটের সদস্যরা সোভিয়েত আমলের কমান্ড কাঠামো পশ্চিমা মানে বদলে ফেলেছেন। এই সেনারা চলার সময় চিন্তা করতে শিখে গেছেন।
এখন রুশ সেনাদের মোকাবিলায় ন্যাটোর প্রশিক্ষণে যা শিখেছেন তা সহযোদ্ধারা ব্যবহার করছেন বলে নিশ্চিত লেফট্যানেন্ট কুলিশ।
ইউক্রেনকে সামরিক সহযোগিতা কর্মসূচিতে সংশ্লিষ্ট পশ্চিমা কর্মকর্তারা বলছেন, পশ্চিমের সামরিক সহযোগিতা কখনও গোপন ছিল না। তবে রাশিয়ার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা মাথায় রেখে এগুলো নিয়ে ঢাকডোল পেটানো হয়নি। এগুলোর কথা খুব বেশি প্রচার করা হয়নি। কারণ যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের কাছে এগুলো ছিল মূল্যবান গোয়েন্দা তথ্য। কয়েক বছর ধরে রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধে লিপ্ত ইউক্রেন। যার অর্থ হলো কিয়েভে ইউরোপের যুদ্ধ-কঠিন সেনাদের অনেকেই রয়েছে। রণক্ষেত্রে তাদের অভিজ্ঞতা ন্যাটোর প্রশিক্ষণে আরও শানিত হয়েছে। একই সঙ্গে এই অভিজ্ঞতা ন্যাটো কমান্ডারদের রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই কেমন হবে তা জানার সুযোগ করে দিয়েছে।
২৪ ফেব্রুয়ারি যখন রাশিয়া আক্রমণ শুরু করে, তখন ইউক্রেনীয় সেনাদের ব্যাপকতর প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়ে গেছে। অন্তত ন্যাটোর আটটি দেশ প্রশিক্ষণে অংশ নেয়। বেশির ভাগ প্রশিক্ষণ ইউক্রেনীয় প্রশিক্ষক দ্বারা পরিচালিত হয়। ন্যাটো কমান্ডারদের কাছে এটা ছিল তাদের শিক্ষা কাজে লাগানোর ইঙ্গিত।
মার্কিন জ্যাভেলিন ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারে সাফল্য পাচ্ছে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীমার্কিন জ্যাভেলিন ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারে সাফল্য পাচ্ছে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী
ন্যাটো জোটের মহাসচিব জেন্স স্টলটেনবার্গ বলেন, যে শিক্ষা আমরা পাচ্ছি তা হলো অনেক দিনের সহযোগিতা ও সমর্থণের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে।
ইরাক ও আফগানিস্তানে পশ্চিমাদের উদ্যোগের তুলনায় ইউক্রেনে ন্যাটোর কাজ অনেক বেশি সফল ছিল। উপদেষ্টারা এজন্য ইউক্রেনের অনেক বেশি সমন্বিত সমাজ ও আমলাতন্ত্র দ্বারা সমর্থিত কেন্দ্রীয় সরকার এবং ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রকে কৃতিত্ব দিচ্ছেন। ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের পর একটি প্রত্যক্ষ বিদেশি শত্রুর সঙ্গে লড়াইয়ের হয়ত এক্ষেত্রে ভূমিকা রয়েছে।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে আক্রমণের কারণ হিসেবে দেশটির ন্যাটোতে যোগদানকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এই লক্ষ্য বাদ দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। পশ্চিমা উপদেষ্টা মনে করেন, ন্যাটোতে যোগদান করুক বা করুক ইউক্রেনের সেনারা শিখে গেছে ন্যাটোর নিয়মে যুদ্ধ করা এবং যুদ্ধক্ষেত্রে সাফল্য আসছে।
ইউক্রেনের সংঘাত ইউনিট পরিপূর্ণ নবগঠিক সামরিক কাঠামোর অগ্রবাহিনী। ন্যাটো উপদেষ্টারা ইউক্রেনের বাহিনীতে বেসামরিক নিয়ন্ত্রণ, পেশাদার পরিদর্শক, বাইরের নিরীক্ষক ও লজিস্টিকস বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তারা সেনা ও অস্ত্রের সংখ্যায় গুরুত্ব না দিয়ে সামর্থ্য বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। যাতে কমান্ডাররা লক্ষ্য নির্ধারণ এবং তা অর্জনে সেনা ও অস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা পূরণের দিকে মনোযোগ দেন।
এই প্রবণতা বাস্তবায়নে ন্যাটো নন-কমিশনড কর্মকর্তাদের ধারণা হাজির করে। অভিজ্ঞ সেনাদের ক্ষমতা দিয়ে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। যারা শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও মাঠের সেনাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ লিংক হিসেবে কাজ করে।
ন্যাটো দেশগুলো ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর নেতাদের মিশন কমান্ড দৃষ্টিভঙ্গি আত্মীকরণ করতে সহযোগিতা করেছে। যে প্রক্রিয়ায় উচ্চ পদের কর্মকর্তারা লড়াইয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে চেইন অব কমান্ড মেনে একেবারে সেনা পর্যন্ত বিস্তৃত।
সোভিয়েত দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, সিনিয়র কর্মকর্তারা নির্দেশ দেন। মাঠের সেনারা তা মানতে বাধ্য, আলোচনার কোনও সুযোগ। এই প্রক্রিয়া রাশিয়া ব্যাপকভাবে এখনও ব্যবহার করে।
ইউক্রেনের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী আন্দ্রি জাগোরোদনিয়ুক বলেন, এটি বড় পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। এনসিও পুনর্গঠন ও মিশন কমান্ড সেনাদের কার্যকারিতা অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েূছে।
লেফট্যানেন্ট কুলিশ বলছেন, এই প্রশিক্ষণের কার্যকারিতা বেড়েছে কারণ ইউক্রেনীয়রা জানে সোভিয়েত সেনাবাহিনী কীভাবে চিন্তা-ভাবনা করে।
তিনি বলেন, রুশরা তাদের প্রচলিত কৌশল ব্যবহার করছে। স্ট্যালিনের সময় থেকে এসব কৌশলে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি। প্রথমে আসে কামান। পরে আমাদের অবস্থান দখলে আসে সেনারা। কিন্তু বিপরীতে ইউক্রেনীয়রা অপ্রত্যাশিত ও চটপটে। আমরা তাদের শৃঙ্খলায় অরাজকতা তৈরি করেছি।