অর্থনীতিতে চরম মন্দা ॥ অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে

7

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান  :
সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ সমাজবদ্ধভাবে একত্রে মিলেমিশে বসবাস করে। প্রয়োজনের তাগিদে একে অন্যের সাথে পারস্পরিক লেনদেন এবং জিনিসপত্রের আদান-প্রদান করে থাকে। প্রাত্যহিক লেনদেনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ব্যবসায়-বাণিজ্য। ব্যবহারিক জীবনে ব্যবসায়-বাণিজ্যে পণ্য ও মূল্যের বিনিময় হয়ে থাকে। ক্রেতা ও বিক্রেতার মাঝে পণ্য ও মূল্যে যৌক্তিক বিনিময় আদান প্রদান হওয়া কাম্য হওয়া সত্ত্বেও যখন বিক্রেতা অতি মুনাফার লোভে চড়ামূল্যে বিক্রয় করার জন্য পণ্য সামগ্রী কুক্ষিগত করে, তখন একে বলে মজুদদারি। এর ফলে পণ্যের মূল্য বেড়ে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরেু চলে যায় এবং জনজীবন বিপর্যন্ত হয়ে পড়ে। ইসলাম এ সমস্যা সমাধানে যথাযথ দিক-নির্দেশনা দিয়েছে। ইসলাম মজুদদারিকে হারাম ঘোষণা করত: অতি মুনাফা অর্জনের মানসিকতা পরিহারের নির্দেশ দিয়েছে। মজুদদারির কারণে কোন ভাবেই যেন জনজীবন বিপর্যন্ত না হয়ে পড়ে।
পারস্পরিক সম্পর্ক ও লেনদেনের মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বজায় রাখার স্বার্থে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে ইসলাম নিয়ম-নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে ব্যবসায়-বাণিজ্য। ইসলাম ব্যবসায়-বাণিজ্য উৎসাহিত করতে যেমন বিভিন্ন রকম জাগতিক ও পারলৌকিক প্রাপ্তির ঘোষণা দিয়েছে তদ্রুপ বিভিন্ন ধরনের নৈরাজ্যকর ও অবাঞ্জনীয় পদক্ষেপ প্রতিরোধে জাগতিক এবং পারলৌকিক শাস্তিও ঘোষণা করেছে। পণ্য সামগ্রী জমা রেখে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে সমাজের দুর্ভোগ বৃদ্ধি ও অতি মুনাফা অর্জন করাকে দন্ডণীয় কাজ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
যারা আল্লাহর সৃষ্টজীবকে কষ্ট দিয়ে অধিক মুনাফা অর্জনের লক্ষে দ্রব্য সামগ্রী মজুদ করে রাখে, তাদের জন্য আখিরাতে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে। দুনিয়াতেও তাদের ভয়াবহ পরিণতির কথা কুরআন ও হাদীসে ঘোষণা করা হয়েছে। কুরআনে আল্লাহ কারুনের ঘটনা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ কারুনকে তার ধন-ভা-ার ও গৃহ-আসবাবসহ যমীনে দাবিয়ে দিয়ে শাস্তি দিলেন। রসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি মুসলিম সম্প্রদায়ের খাদ্যদ্রব্য মজুদ করে রাখবে আল্লাহ তাকে দুরারোগ্য ব্যাধি ও দারিদ্র্য দিয়ে শাস্তি দিবেন”।
বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের অর্থব্যবস্থা চালু রয়েছে। অর্থব্যবস্থার ভিন্নতার প্রেক্ষিতে মজুদদারিতেও বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় রাষ্ট্র দ্রব্য সামগ্রী মজুদ করে রাখে। আবার পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় ব্যক্তি পণ্য মজুদ করে থাকে। তবে দুই অর্থব্যবস্থাতেই মজুদদারির পরিণতি ভয়াবহ। এ ছাড়াও আরো কিছু ক্ষতিকর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
ব্যক্তি ও রাষ্ট্রসমূহের মাঝে প্রতিযোগিতার মনোভাব নষ্ট হয়ে যায়। কেননা প্রতিযোগিতা না থাকলে ব্যবসায়-বাণিজ্যে গতি সঞ্চার হয় না এবং উৎপাদনও বৃদ্ধি পায় না। ফলে জাতীয় অর্থনীতি মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হয়।
অনেক সময় আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য কমে যাওয়ার আশংকায় আমদানীকৃত পণ্য সামগ্রী ধ্বংস করে দেয়া হয়। কেননা আমদানীকৃত পণ্যের অবাধ প্রবাহের ফলে দ্রব্যমূল্য কমে যায়। মুনাফা স্থিতিশীল রাখতে ব্যবসায়ীরা আগুনে পুড়িয়ে বা সমুদ্রে ফেলে পণ্য ধ্বংস করে। ফলে খাদ্যের মারাত্মক সংকট ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।
মজুদদারি সমাজে লোভ, হিংসা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ার কারণ হয়। ফলে সামাজিক মূল্যবোধ হ্রাস পায়। মানুষের মাঝে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এক সময় সমাজের কাঠামো ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্ব বেড়ে যায়। ফলে আইন শৃংখলার মারাত্মক অবনতি ঘটে। আর অর্থনীতিতে চরম মন্দা ও অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করে।
আল্লামা ইউসুফ কারযাভী বলেন, মজুদদারি দু’টি শর্তে হারাম। যথা- ১. এমন এক স্থানে ও এমন সময় পণ্য মজুদ করা হবে যার কারণে জনগণের তীব্র অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে। ২. মজুদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হবে অধিক মূল্য হরণ। যার ফলে মুনাফার পরিমাণ অবেক বেড়ে যাবে।
আল-মুগনী ওয়াশ মারহুল কাবীর আলা মাতানিল মুকনি ফি ফিকহিল ইমাম আহমাদ গ্রন্থকারের মতে তিনটি শর্তে মজুদদারি হারাম। যথা- ১. পণ্য ক্রয়কৃত হতে হবে। যদি পণ্য আমদানীকৃত হয় বা নিজস্ব উৎপাদিত হয়, আর তা মজুদ করে রাখে তাহলে ইহতিকার হিসেবে গণ্য হবে না। ২. পণ্য একান্ত প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য হতে হবে। সুতরাং মসলা, হালুয়া, মধু, যায়তুন, গবাদি পশুর শুকনো খাদ্য ইত্যাদি মজুদ করে রাখলে তা হারাম হবে না। ৩. পণ্য ক্রয়ে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগে নিপতিত হওয়া। এর আবার দু’টি পর্যায় রয়েছে- ক. ছোট শহর যেখানে পণ্য মজুদ করলে মানুষের কষ্ট হবে এবং মূল্য বেড়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। এমতাবস্থায় ইহতিকার হারাম। খ. পণ্য সামগ্রীর সংকট বা অভাবের সময় যদি কোন বণিকদল দ্রব্য সামগ্রী নিয়ে শহরে প্রবেশ করে আর ধনী লোকেরা দ্রুত তাদের কাছ থেকে তা কিনে নেয়, ফলে মানুষের মাঝে পণ্যের সংকট দেখা দেয়, তাহলে ইহতিকার হারাম হবে। আর যদি খাদ্য সামগ্রী বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুদ থাকে এবং কম মূল্যে ক্রয় করা যায়। আর এতে মানুষের কষ্ট না হয় তাহলে ইহতিকার হারাম হবে না। আল-হিদায়া গ্রন্থকারের মতে, পণ্য মানুষ ও চতুষ্পদ জন্তুর খাদ্য হতে হবে এবং মজুদদারির কারণে মানুষ ও জীবজন্তুর কষ্ট হওয়ার সম্ভবনা থাকতে হবে। আর যদি কষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে তাহলে ইহতিকার করা নিষিদ্ধ নয়।
নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী সহজলভ্য ও ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখা সরকারের দায়িত্ব এবং ভোক্তা শ্রেণীর অধিকার। কিন্তু আমাদের দেশের বাজার ব্যবস্থাপনা মজুদদার লুটেরাদের হাতে কুক্ষিগত। অতি মুনাফাখোর অসাধু একদল ব্যবসায়ীর যাতাকলে আজ সাধারণ মানুষ নিষ্পেষিত। অসাধু ব্যবসায়ী শ্রেণি সিন্ডিকেট করে পণ্য গুদামজাত করে রাখে এবং কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে পণ্যের মূল্য নিজেদের ইচ্ছাকৃত নির্ধারণ করে। পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ ও বাজার তদারকির জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষ রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের ভূমিকা ভোক্তা সাধারণ যথেষ্ট মনে করেন না। কখনো অতি মুনাফাখোর ব্যবসায়ী শ্রেণির সাথে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যোগসাজশ থাকার কথাও গণমাধ্যমে প্রকাশ হতে দেখা যায়। কর্তৃপক্ষের এই দুর্বলতার সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে দফায় দফায় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করে। ফলে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। আর ক্রেতা সাধারণ আকাশ ছোঁয়া দ্রব্যমূল্যের কারণে হয়ে পড়ে দিশেহারা। বিশেষত রমযান ও ধর্মীয় উৎসবগুলোতে বাজার ব্যবস্থাপনায় শোচনীয় অবস্থা বিরাজ করে। তখন কিছু সংখ্যক ব্যবসায়ী নিত্য প্রয়োজনীয় সকল পণ্য মজুদ করে রাখে। এতে অস্বাভাবিকভাবে পণ্যের মূল্য হু হু করে বাড়তে থাকে। ভোক্তা শ্রেণি প্রয়োজনের তাগিতে চড়ামূল্যে পণ্য সামগ্রী ক্রয় করতে বাধ্য হয়। ফলে এ সুযোগে অতি মুনাফাখোর একদল অসাধু ব্যবসায়ী সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। আর সাধারণ মানুষ চড়া মূল্যে পণ্য ক্রয় করে নিঃস্ব থেকে আরো নিঃস্বতর হয়। এ সমস্যা নিয়ে প্রিন্ট মিডিয়ায় অনেক লেখালেখি হয় এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বহু সচিত্র প্রতিবেদন ও প্রচার হয়। বিভিন্ন সময়ে সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করা হয়। সেমিনারে এ সমস্যা নিরসনে বিস্তারিত আলোচনা করা হয় এবং সুপারিশমালা গ্রহণ করা হয়। তখন সরকারি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মজুদদারি ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণের নানা কথা বলে থাকেন এবং ব্যবসায়ীরা বহু প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন। কিন্তু বাস্তবে এ সমস্যার প্রতিকার সামান্যই পরিলক্ষিত হয়।
মজুদদারির ফলে অর্থনৈতিক কর্মকা-ে যে অস্থিতিশীল ও অরাজকতাপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়, তা অর্থব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়। আর সামাজিক কর্মকা-ে যে নৈরাজ্যকর ও বিশৃংখল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তা সমাজ ব্যবস্থাকে পর্যুদস্ত করে ফেলে। ইসলাম এ ক্ষেত্রে শাশ্বত ও যুগোপযোগী বিধান দিয়েছে। মজুদদারিকে নিষিদ্ধ করেছে এবং এ অবস্থা নিরসনে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এ ছাড়াও এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আরো কিছু পদক্ষেপ রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমন: সরকার মজুদদারির কুপ্রভাব সর্বসাধারণের সামলে তুলে ধরবে। এ ক্ষেত্রে ইসলামী বিধি-নিষেধগুলো প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। মজুদদারদেরকে শরয়ী নির্দেশনা পালনে পদক্ষেপ নিবে এবং ভোক্তাদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট থাকবে। দেশে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিলে সরকার মজুদদারদেরকে নীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে মজুদকৃত পণ্য সুলভ মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য করবে। মুজদদার শ্রেণি যদি তা অস্বীকার করে, তাহলে জনসাধারণের দু:খ-দুর্দশা লাঘবে এবং তাদের স্বার্থ ন্যায়সঙ্গতভাবে রক্ষার উদ্দেশ্যে সরকার মজুদকৃত পণ্য সামগ্রী বাজেয়াপ্ত করে তা ন্যায্য মূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সরকার নিত্য প্রয়োজনীয় সে সকল পণ্য সরবরাহের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে যা মজুদদারির কারণে দু¯প্রাপ্য এবং দেশের অভ্যন্তরে সব পণ্যের উৎপাদন বাড়ানোর প্রচেষ্টা চালাবে। সরকার অন্যান্য দেশের সাথে পণ্য বিনিময় করবে বা তাদেরকে ব্যবসায়ের জন্য উদ্বুদ্ধ করবে। বিশেষত দু¯প্রাপ্য পণ্য সামগ্রী বাণিজ্যিকীকরণে তাদের উৎসাহিত করবে এবং পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা প্রদান করবে। যদি মুজদদারির কারণে পণ্য সামগ্রীর মূল্য বেড়ে যায় এবং বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে, তাহলে সরকার ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষার্থে বিশেষজ্ঞ কমিটির পরামর্শক্রমে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দিবে। আর মজুদদার শ্রেণিকে পণ্য ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য করবে। কিন্তু বাজার যখন স্থিতিশীল হয়ে যাবে তখন ক্রেতা-বিক্রেতাকে স্বাধীনতা দেয়া হবে, যাতে তাদের চাহিদার আলোকে পণ্য মূল্য নির্ধারিত হয়। সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি মনিটরিং সেল গঠন করবে। মনিটরিং সেলের অধীনে নিজস্ব জনবল দিয়ে প্রতিনিয়ত বাজার পরিদর্শনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। যদি পরিদর্শকদলের নিকট কোন অনিয়ম পরিলক্ষিত হয় তাহলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
খাদ্য নিজস্ব উদ্যোগে আমদানীর জন্য সরকার একটি বোর্ড গঠন করতে পারে। এ বোর্ডের মাধ্যমে পণ্য আমদানী করবে বা যারা পণ্য আমদানী করবে এ বোর্ড তাদের মনিটরিং করবে। এতে আমদানীকারকরা বেশি মূল্যে পণ্য বিক্রির সুযোগ নিতে পারবে না।
এ সকল পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে নৈরাজ্যকর ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে একটি সুন্দর পরিবেশ বিরাজ করবে এবং ক্রেতা-বিক্রেতার অধিকার সুনিশ্চিত হবে।