অগ্নিঝরা মার্চ

5

কাজিরবাজার ডেস্ক :
১৮ মার্চ, ১৯৭১। উত্তাল-অগ্নিগর্ভ একাত্তরের রক্তক্ষরা এই দিনে দেশব্যাপী সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি চলছিল। একদিকে সংগ্রামের প্রস্তুতি চলছে, অন্যদিকে চলছিল বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়া খানের আলোচনা। এক পর্যায়ে সবাই বুঝতে পারে যে আলোচনার নামে চলছে সময়ক্ষেপণ। বঙ্গবন্ধু আলোচনাতেই শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে আলোচনার নামে প্রহসনের অভিযোগ আনেন। তিনি স্বাধীনতার দাবিতে অটল থেকে আলোচনায় অংশগ্রহণ করছিলেন।
একাত্তরের এ দিনেই বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সৈনিকরা স্বাধীনতার সংগ্রামের জন্য প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কর্মীরা বাংলাদেশে অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে একাত্ম করতে বিভিন্নস্থানে মতবিনিময় চালিয়ে যেতে থাকে। দেশের বিভিন্নস্থানে সাধারণ মানুষ সামরিক প্রশিক্ষণের প্রস্তুতি নিতে থাকে। মহিলা পরিষদের মেয়েরাও পিছিয়ে ছিল না। তাদেরও বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
এদিকে পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনী সামরিক ঘাঁটিকে শক্তিশালী করতে গোপনে গোলাবারুদ আর সৈনিক জড়ো করতে শুরু করেছিল। পাকিস্তানী শাসকরা স্বাধীনতার আন্দোলনকে দমাতে এভাবে একটু একটু করে প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছিল। এদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা তেজগাঁও-মহাখালীতে শ্রমিকদের ট্রাকে হামলা চালায়। আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলেন, ‘এ ধরনের উস্কানি আর সহ্য করা হবে না।’
একাত্তরের এই দিনে ঢাকার রাজপথ ছাত্র-শ্রমিক জনতার পদচারণায় প্রকম্পিত ছিল। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিভিন্ন সংগঠন ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা সংগ্রামের কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য দৃপ্ত শপথ গ্রহণ করেন। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত উৎসুক জনতা তাদের আশা আকাক্সক্ষার প্রতীক বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে ভিড় জমান। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গণমানুষের ঢল নামে বাংলাদেশের জনগণের অবিসংবাদিত নেতার বাসভবনে। সহকর্মীদের আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে বঙ্গবন্ধুর বারবার বৈঠক থেকে উঠে এসে শোভাযাত্রাকারীদের উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। সমবেত বীর বাঙালিদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তোমরা চরম প্রস্তুতি নিয়ে ঘরে ঘরে সংগ্রামী দুর্গ গড়ে তোল। যদি তোমাদের ওপর আঘাত আসে তা প্রতিহত করে শত্রুদের ওপর পাল্টা আঘাত হান।’ আজও বিপুল সংখ্যক দেশী-বিদেশী সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর বাসভবনে দেখা করেন।
উনিশশ’ একাত্তর সাল মার্চ মাস ছিল উত্তুঙ্গ গণজাগরণের সময়। অসহযোগ আন্দোলনের সপ্তদশ দিবস ছিল ১৮ মার্চ। এ দিনও সরকারী-বেসরকারী ভবনের শীর্ষে কালো পতাকা উড়িয়ে, অফিস-আদালত অনুপস্থিত থেকে সর্বশ্রেণীর কর্মচারী বঙ্গবন্ধু ঘোষিত সংগ্রামের কর্মসূচী সফল করে তোলেন।
বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে জনতা সারাদিন ধরে মিছিলের পর মিছিল করে চলমান আন্দোলনের সঙ্গে তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন ও একাত্মতা ব্যক্ত করে। জনগণের কণ্ঠে উচ্চারিত শ্লোগান ছিল- ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। মিছিলকারীদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন. ‘তোমরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। জনগণের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না।’
স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এক বিবৃতিতে আমেরিকা, ব্রিটেন, রাশিয়া, চীন প্রভৃতি শক্তির প্রতি তাদের সরবরাহকৃত অস্ত্রের দ্বারা বাঙালি হত্যার প্রয়াস বন্ধ করার আবেদন জানায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দ অপর এক বিবৃতিতে বিভিন্ন দেশের সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুদ্ধিজীবীদের কাছে তারবার্তা প্রেরণ করে আসন্ন গণহত্যা ও যুদ্ধ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানীদের নিবৃত্ত করার অনুরোধ জানান।