পশ্চিমাদের দেখে নেয়ার হুমকি রাশিয়ার

8

কাজিরবাজার ডেস্ক :
রাশিয়ার ওপর দফায় দফায় পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কঠিন জবাব দেয়ার সঙ্কল্প ব্যক্ত করেছে মস্কো। বুধবার ক্রেমলিন সাফ জানায়, আমরাও পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে একাধিক ব্যবস্থা নেয়ার কথা ভাবছি। এর প্রভাব পড়বে পশ্চিমাদের সবচেয়ে সংবেদনশীল বিষয়গুলোতে। রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা দিমিত্রি বিরিচেভস্কি বলেন, পশ্চিমাদের ওপর রাশিয়ার ব্যবস্থা হবে কঠোর, উদ্বেগজনক ও সংবেদনশীল। ইউক্রেনে রুশ আক্রমণের ১৪তম দিন বুধবার সকাল থেকেই কিয়েভসহ আশপাশের এলাকায় একাধিক হামলা চালায় রুশ সৈন্যরা। এ দিন ভোর থেকে দেশটির লুবনি, সুমি, চেরনিহিব, পোলভাতা ও ব্যাসিলকিভে হামলা হয়। কিয়েভের উত্তর ও উত্তর পশ্চিমদিকে প্রচন্ড আক্রমণ চালায় রুশরা। ওই অঞ্চলে ইউক্রেনের চেকপয়েন্টগুলোর ওপর অব্যাহতভাবে মর্টারের গোলাবর্ষণ চালানো হয়। তবে ইউক্রেন সৈন্যরাও তাদের অবস্থান ধরে রেখেছে এবং রুশ বাহিনীর অগ্রাভিযান ঠেকিয়ে দেয়ার দাবি করে। এদিকে ইউক্রেনে টানা রুশ হামলার ফলে বুধবার সামান্য নমনীয় মনোভাব পোষণ করেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য পদ পাওয়ার বিষয়টিতে এখন আর জোর দিচ্ছেন না তিনি। বুধবার প্রচারিত এক সাক্ষাতকারে জেলেনস্কি বলেন, আমার মনে হয় ইউক্রেনকে গ্রহণ করতে ন্যাটো প্রস্তুত নয়। ফলে আমরা এখন আর জোটটিতে যোগ দেয়ার বিষয়ে অতি উৎসাহিত নই। তিনি বলেন, আমার মনে হয়েছে ন্যাটো নেতারা রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে জড়াতে চান না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, ইউক্রেনে পুতিন কখনই বিজয় পাবেন না।
উল্লেখ্য, ইউক্রেনের ন্যাটো জোটে যোগ দেয়া নিয়েই যুদ্ধের শুরু। দুই সপ্তাহের এ যুদ্ধে ইতোমধ্যে কয়েক হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে।
ইউক্রেন হামলা নিয়ে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে রাশিয়া। এখন রাশিয়াকে যেহেতু নিষেধাজ্ঞা দিয়ে পশ্চিমারা চাপে রেখেছে। তাই রাশিয়াও পাল্টা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে পশ্চিমাদের চাপে ফেলতে চাইছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মঙ্গলবার হোয়াইট হাউস থেকে পুতিনকে তীব্র আক্রমণ করে বলেন, রাশিয়া চরম মূল্য দিয়ে অগ্রসর হতে পারে। কিন্তু এটি খুবই স্পষ্ট যে ইউক্রেনে পুতিন কখনই বিজয় পাবেন না। বাইডেন হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, পুতিন একটি নগরীর নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেন। কিন্তু পুরো ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণ কখনই নিতে পারবেন না।
রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা বিশ্বের নজিরবিহীন অবরোধ সত্ত্বেও পুতিন ইউক্রেনে তার সামরিক অভিযান অব্যাহত রেখেছেন। মস্কো সামরিক অভিযানের ১৩তম দিন মঙ্গলবার ইউক্রেনের পাঁচ শহরে মানবিক করিডর চালু করে। অবশ্য কিয়েভ একে রাশিয়ার পাবলিসিটি স্ট্যান্ট হিসেবে বর্ণনা করে। ইউক্রেনে হামলার কারণে প্রতিবেশী দেশগুলোতে শরণার্থীর ঢল নেমেছে। এ প্রসঙ্গে বাইডেন তার মিত্রদেশসমূহের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেন।
বাইডেন বলেন, ইউক্রেনের প্রতিবেশী দেশগুলোতে আসা শরণার্থীদের দেখভালে যুক্তরাষ্ট্র দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেবে। তিনি ইউক্রেনে বেসামরিক স্থাপনার ওপর নির্বিচারে হামলার জন্য পুতিনকে দায়ী করেন। কিন্তু পুতিন যে কোন মূল্যে তার এ অভিযান চালিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলে বাইডেন মন্তব্য করেন। তিনি ইউক্রেনকে সহায়তা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার করে বলেন, যখন এই যুদ্ধের ইতিহাস লেখা হবে তখন ইউক্রেনে পুতিনের এই যুদ্ধ রাশিয়াকে আরও দুর্বল এবং বাকি বিশ্বকে শক্তিশালী হিসেবে দেখানো হবে।
ইউক্রেনে ২৪শ’ রুশ সেনা নিহত : প্রায় দুই সপ্তাহের যুদ্ধে মস্কোর প্রায় ২৪শ’ সৈন্য নিহত হয়েছেন। মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা মঙ্গলবার রুশ আক্রমণ নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করেন। ধারণা করা হচ্ছে- বিশ্বব্যাপী ব্যাপক বিরোধিতার মুখেও পুতিন ইউক্রেনে হামলার গতি বাড়াবেন।
হাউস ইন্টেলিজেন্স কমিটির এক শুনানিতে এ সামরিক অভিযানে এখন পর্যন্ত রাশিয়ার কতজন সৈন্য মারা গেছেন জানতে চাইলে পেন্টাগনের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক লে. জেনারেল স্কট বেরিয়ার বলেন, এ যুদ্ধে রাশিয়ার ‘দুই হাজারের বেশি সৈন্য নিহত হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।’
নিরাপদে ত্রাণ সরবরাহের সুযোগ দেয়ার আহ্বান জাতিসংঘের : জাতিসংঘ ইউক্রেনের যুদ্ধ অঞ্চলে নিরাপদে মানবিক সহায়তার সুযোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের এক জরুরী বৈঠকে মঙ্গলবার বিশ্ব সংস্থার একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, ইউক্রেনের যুদ্ধাঞ্চলে মানবিক সরবরাহের জন্য নিরাপদ করিডর দরকার। রুশ হামলার কারণে ইউক্রেনে যে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে সে সম্পর্কে জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল মার্টিন গ্রিফিথস এই জরুরী বৈঠকে বলেন, মারিয়াপোল, খারকিভ, মেলিটোপুলসহ বিভিন্ন জায়গায় বেসামরিক নাগরিকদের জীবন রক্ষাকারী ওষুধসহ জরুরী সহায়তা প্রয়োজন। তিনি ইউক্রেনে বেসামরিক নাগরিক, বাড়িঘর ও অবকাঠামো নিরাপদ রাখতে উভয়পক্ষের প্রতি আহ্বান জানান।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ইউক্রেনে জীবাণু অস্ত্র কর্মসূচীর অভিযোগ রাশিয়ার : যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে ইউক্রেনে জীবাণু অস্ত্র কর্মসূচী পরিচালিত হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছে রাশিয়া। বুধবার যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বের কাছে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেয়ার দাবি জানিয়েছে মস্কো। রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা এই অভিযোগের ব্যাপারে ওয়াশিংটনের কাছে স্বচ্ছতার দাবি জানান। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে কিয়েভ। পেন্টাগনের একজন মুখপাত্রও এই অভিযোগকে অযৌক্তিক বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।
চেরনোবিলের কর্মীরা বিশ্রাম ছাড়াই কাজ করছে : জাতিসংঘের পারমাণবিক কার্যক্রম তদারকি সংস্থা আইএইএ জানিয়েছে, ইউক্রেনের উত্তরাঞ্চলীয় চেরনোবিল পারমাণবিক কেন্দ্রের কর্মীরা নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। এই পারমাণবিক কেন্দ্রটি বর্তমানে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে রুশ বাহিনী। আইএইএ প্রধান রাফায়েল গ্রোসি এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষ তাকে অবগত করেছে যে চেরনোবিল পারমাণবিক কেন্দ্রে থাকা ২১০ জন কর্মীর একই গ্রুপটি গত দুই সপ্তাহ ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এসব কর্মী যে চাপের মধ্যে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি। রাফায়েল গ্রোসি বলেন, এসব কর্মীকে অবশ্যই বিশ্রাম এবং নিয়মিত শিফটে কাজের সুযোগ দিতে হবে। তিনি বলেন, এটা সামগ্রিকভাবে পারমাণবিক নিরাপত্তার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৮৬ সালে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ পারমাণবিক দুর্ঘটনার কেন্দ্র চেরনোবিল সম্প্রতি দখলে নেয় রাশিয়া।
ইউক্রেনকে যুদ্ধবিমান দেয়া নিয়ে পোল্যান্ড-যুক্তরাষ্ট্রের ভিন্ন মত : জার্মানিতে মার্কিন বিমানঘাঁটির মাধ্যমে ইউক্রেনে মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান পাঠাতে পোল্যান্ডের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটন বলেছে, প্রস্তাব সমগ্র ন্যাটো জোটের জন্য গুরুতর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
রাশিয়ার গ্যাস ছাড়া চলতে পারব না : রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে আরও চাপে ফেলতে রাশিয়ার তেল, গ্যাসসহ অন্যান্য জ্বালানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপের সবচেয়ে বড় জোট ইউরোপীয় ইউনিয়নও যুক্তরাষ্ট্রের পথে হাঁটতে চাইছে। তবে রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের ওপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বিভক্তি দেখা দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নে। কারণ বেশ কয়েকটি দেশ এই নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করেছে।
এর মধ্যে হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান প্রকাশ্যে বলেন, তার দেশ রাশিয়ার জ্বালানির ওপর কোন নিষেধাজ্ঞায় থাকবে না। তিনি সরাসরি বলেছেন, রাশিয়ার গ্যাস ছাড়া চলতে পারব না আমরা। ভিসেগার্ড বৈঠকে যুক্তরাজ্য, পোল্যান্ড, চেক রিপাবলিক ও স্লোভাকিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে বৈঠক শেষে নিজের সিদ্ধান্তের কথা জানান ভিক্টর ওরবান।
তুরস্কে বৈঠকে বসছেন লাভরভ-কুলেবা : ইউক্রেন পরিস্থিতি নিয়ে খুব শীঘ্রই তুরস্কে বৈঠক করবেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ এবং ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্র কুলেবা। বুধবার রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে এ তথ্য নিশ্চিত করে।
গ্রাহকদের টাকা তোলার ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দিল রাশিয়া : ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের পর থেকেই রাশিয়ার ওপর নানা রকম নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে পশ্চিমা দুনিয়া। অনেকে বলছেন, অর্থনৈতিকভাবে রাশিয়াকে পঙ্গু করে দেয়ার জন্যই ওই পদক্ষেপ করা হয়েছে। সামরিক অভিযানের ১০ দিনের মধ্যে রাশিয়ার ওপর আড়াই হাজারের বেশি নিষেধাজ্ঞা চাপানো হয়েছে। মোট সাড়ে পাঁচ হাজারেরও বেশি নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া ঝুলছে পুতিনের মাথার উপরে। রাশিয়ার ওপর যত আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা চাপছে, নাগরিকদের ওপর ততই নিষেধাজ্ঞার বহর বাড়াচ্ছে ভøাদিমির পুতিনের সরকার। এ বার সেন্ট্রাল ব্যাংককে গ্রাহকদের টাকা তোলার এ ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হলো। আর এই নিষেধাজ্ঞার ধাক্কায় চরম ভোগান্তির মুখে পড়তে হচ্ছে রুশ নাগরিকদের। আশঙ্কার আবহ তৈরি হয়েছে এই পরিস্থিতিকে ঘিরে। সংবাদ সংস্থা নেক্সটার প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, রাশিয়ার ব্যাংকগুলোকে ইতোমধ্যেই গ্রাহকদের টাকা তোলার ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দিতে বলেছে সেন্ট্রাল ব্যাংক। গ্রাহকরা বিদেশী এ্যাকাউন্ট থেকে ১০ হাজার ডলারের বেশি তুলতে পারবেন না। বাকি টাকা তুলতে গেলে রুবলে তুলতে হবে এবং সেটা বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী। আগামী ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিদেশী মুদ্রার বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সেন্ট্রাল ব্যাংক। এই সময়ের মধ্যে সে দেশের কোন ব্যাংকই গ্রাহকদের বিদেশী মুদ্রা বিক্রি করতে পারবে না।
সেন্ট্রাল ব্যাংকের এই ঘোষণার পর পরই রাশিয়ার সব এটিএম-এ গ্রাহকদের বিপুল লাইন পড়ে গিয়েছে। কোন জরুরী অবস্থা জারি হলে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, সরকারের এই সিদ্ধান্তে নাগরিকদের মধ্যে তেমনই একটা আশঙ্কার আবহ তৈরি হয়েছে। ফলে সকলেই এখন এটিমএমমুখী হচ্ছেন। ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের পর থেকেই রাশিয়ার ওপর নানা রকম নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে পশ্চিমী দুনিয়া। অনেকে বলছেন, অর্থনৈতিকভাবে রাশিয়াকে পঙ্গু করে দেয়ার জন্যই ওই পদক্ষেপ করা হয়েছে।