ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ পতনের মুখে ॥ ইউক্রেনের রাস্তায় রুশ সাঁজোয়া যান ॥ সড়কে সেনাদের মরদেহ, রাশিয়ার দখলে চেরনোবিল

6

কাজিরবাজার ডেস্ক :
মাত্র ২৪ ঘণ্টার যুদ্ধে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে ঢুকে পড়েছে রুশ সৈন্য। ইউক্রেন সেনাদের প্রতিরোধ ব্যূহ ভেদ করে শুক্রবার রুশ সাঁজোয়া যান কিয়েভে প্রবেশ করে। এ সময় শহরটির রাস্তায় কয়েকজন ইউক্রেন সেনার মরদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। এ খবরে ইউক্রেনের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, যে কোন দিন রুশ সৈন্যদের হাতে কিয়েভের পতন হতে পারে। উত্তেজনাকর এই পরিস্থিতিতে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে শুক্রবার ফোনে কথা বলেছেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং। এ সময় ইউক্রেন সঙ্কট সমাধানে রাশিয়ার পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন জিন পিং। রাশিয়া বলছে, ইউক্রেন পুরোপুরি দখল করে নেয়ার ইচ্ছা নেই তাদের। মস্কো শুধু ইউক্রেনকে সামরিকভাবে নিরস্ত্র করতে চায়। এজন্য দেশটিতে আক্রমণ চালানো হয়েছে। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন। মার্কিন গোয়েন্দা সূত্রসমূহ বলছে, রাশিয়ার আক্রমণের ধরন দেখে মনে হচ্ছে, যে কোন দিন কিয়েভের পতন হবে। বৃহস্পতিবার ইউক্রেনে সর্বাত্মক হামলা শুরু করে রাশিয়া। এরপর উভয় পক্ষে কয়েক শ’ সৈন্য নিহতের দাবি করা হচ্ছে। এদিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, তিনি দেশ ছেড়ে চলে যাবেন না। রুশ হামলার মুখে তিনি সপরিবারে কিয়েভেই থাকবেন।
শুক্রবার সকালে ভাষণে জেলেনস্কি রাশিয়াকে হামলা বন্ধের আহ্বান জানান এবং ইউক্রেনকে সাহায্য করার জন্য ফের পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি আবেদন করেন। ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট বলেন, আমরা দেশ রক্ষায় একাই লড়াই করছি। বৃহস্পতিবারের মতোই, বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশগুলো দূর থেকে তা চেয়ে চেয়ে দেখছে। তিনি বলেন, নিষেধাজ্ঞায় কি রাশিয়ার ওপর কোন প্রভাব পড়েছে? আমরা আমাদের আকাশে যে শব্দ শুনছি ও ভূমিতে যা দেখছি তাতে এটা যথেষ্ট নয়। মস্কোর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘কিভাবে বৈরিতার অবসান ঘটানো যায় তা নিয়ে এবং এই আক্রমণ বন্ধের বিষয়ে আগে হোক পরে হোক রাশিয়াকে আমাদের সঙ্গে কথা বলতেই হবে। যত আগে আলাপ শুরু করা যাবে রাশিয়ার ক্ষতি ততই কম হবে। কারণ শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে আমরা দেশকে রক্ষা করব। শুক্রবার ভোরের আগেই কিয়েভে বহুবার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে বলে তিনি নিশ্চিত করেন। ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট জানান, শুক্রবার ভোর ৪টা থেকে দ্বিতীয় দিনের মতো ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু হয়। সামরিক স্থাপনার পাশাপাশি বেসামরিক এলাকায়ও হামলা চালানো হচ্ছে। জেলেনস্কি বলেন, আমি রাশিয়ার এক নম্বর টার্গেট। তারপরও আমি কিয়েভ ছেড়ে যাব না। ওদিকে ইউক্রেনের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি হয়েছে রাশিয়া। শুক্রবার ইউক্রেনকে আলোচনায় বসার বার্তা দেয় মস্কো। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেন, ইউক্রেন যদি অস্ত্র সমর্পণ করে তাহলে আমরা তাদের সঙ্গে আলোচনায় প্রস্তুত। বৃহস্পতিবার যুদ্ধের প্রথম দিনেই ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় শহর খারকিভ এবং পরমাণু বিদ্যুত কেন্দ্র চেরনোবিল দখলে নিয়ে নেয় রুশ বাহিনী। যুদ্ধের দ্বিতীয় দিন রাজধানী কিয়েভে পৌঁছে পুতিন বাহিনী।
যুদ্ধের প্রথম দিন ইউক্রেনের কমপক্ষে ১৩৭ সেনা নিহত হয়। পাশাপাশি বহু রুশ সৈন্য নিহতের দাবি করা হচ্ছে। কিয়েভ থেকে এক সাংবাদিক জানান, রাশিয়া ব্যাপক পরিসরে জল, স্থল ও বিমান হামলা শুরুর পর বৃহস্পতিবার ইউক্রেনের বিভিন্ন নগরীতে ক্ষেপণাস্ত্র ও কামানের গোলাবর্ষণ করা হয়। এতে প্রাণ বাঁচাতে বেসামরিক নাগরিকরা বিভিন্ন মেট্রোস্টেশনে আশ্রয় নেন। রুশ বাহিনী ইউক্রেনের একেবারে ভেতরে ঢুকে পড়ার প্রতি জোর দেয়ায় কিয়েভের উপকণ্ঠে ব্যাপক যুদ্ধ বেধে যায়। এদিকে পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার আগ্রাসনের জবাবে মস্কোর বিরুদ্ধে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা জারি করছে। বৃহস্পতিবার রাশিয়ার ছত্রী সেনারা কিয়েভের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত গোস্তমাল বিমান ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। ছত্রী সেনারা বেলারুশ অভিমুখ থেকে বিভিন্ন হেলিকপ্টার ও যুদ্ধ বিমানে করে এসে সেখানে অবতরণ করে।
ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ সতর্ক করে দিয়ে বলেন, রাশিয়ার ‘নাশকতা গ্রুপ’ কিয়েভে ঢুকে পড়েছে এবং তিনি দেশের নাগরিকদের এ ব্যাপারে সজাগ থাকার আহ্বান জানান। ইউক্রেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা টুইটে জানান, রুশ সেনারা কিয়েভের পার্শ্ববর্তী ওবোলন শহরে ঢুকে পড়েছে। শহরটি ইউক্রেনের পার্লামেন্ট থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার উত্তরে। যে কোন সময় সেনারা কিয়েভের দখল নিতে পারে। এ পরিস্থিতিতে মস্কোয় সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘মস্কো ইউক্রেনের দখল নিতে চায় না; বরং ইউক্রেনকে নিরস্ত্র করাই মস্কোর লক্ষ্য। দেশটিকে এখন নিজেদের ভাগ্য বেছে নিতে হবে।’ রাশিয়া একটি গণতান্ত্রিক দেশে হামলা চালাতে পারে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ল্যাভরভ ইউক্রেনকে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি বলেন, ‘সাবেক যুগোস্লাভিয়া, ইরাক ও লিবিয়ায় পশ্চিমা দেশগুলো আগ্রাসন চালিয়েছিল। গণতন্ত্রের নামে এসব আগ্রাসনে হাজারও নিরস্ত্র মানুষের প্রাণ গেছে। পশ্চিমারা ইউক্রেনের হাতেও অস্ত্র তুলে দিয়েছে। তাই রাশিয়া দেশটিকে নিরস্ত্র করবে। ইউক্রেনের সেনাদের অস্ত্র ত্যাগ করতেই হবে।
যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে সৈন্য পাঠাবে না : ইউক্রেনে রাশিয়ান বাহিনীর হামলার পর বৃহস্পতিবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ন্যাটো সীমানার ‘প্রতি ইঞ্চি’ ভূমি সুরক্ষার অঙ্গীকার ঘোষণা করেছেন। তবে ওয়াশিংটনের মিত্র দেশে আমেরিকার সেনা মোতায়েন করা হবে না বলে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন। হোয়াইট হাউস থেকে জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে বাইডেন বলেন, ‘আমি স্পষ্ট করে বলেছি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোর প্রতিটি ইঞ্চি ভূমি আমেরিকার পুরো শক্তি দিয়ে রক্ষা করবে।’তবে প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আমাদের বাহিনী ইউক্রেনে রাশিয়ার সঙ্গে সংঘাতে জড়াবে না।
জো বাইডেন বৃহস্পতিবার বলেছেন, রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের পর দেশটির প্রেসিডেন্ট পুতিন ‘আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সংঘহীন’ হয়ে পড়বেন।
মঙ্গলবার দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক প্রজাতন্ত্রের স্বীকৃতি দেন পুতিন। তিনি বলেন, মস্কো পূর্ব ইউক্রেনের দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছে। পুতিন ইউক্রেন সম্পর্কে বলেন, এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলোনি। একটি পুতুল সরকার ইউক্রেন চালাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘ইউক্রেন কোন দিনই প্রকৃত রাষ্ট্র ছিল না এবং আধুনিক ইউক্রেন রাশিয়ার দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে। পুতিনের এ বক্তব্যের পর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেন, আমরা শান্তি এবং কূটনৈতিক পথের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। আমরা এই পথ অনুসরণ করব এবং কেবল এটিই করব। আমরা নিজেদের ভূমিতে আছি। আমরা কোন কিছু এবং কাউকে ভয় পাই না। আমরা কাউকে পরোয়া করি না, কাউকে দেশ দখল করতে দেব না। তিনি আরও বলেন, আমাদের অংশীদারদের কাছ থেকে পরিষ্কার এবং ফলপ্রসূ পদক্ষেপ প্রত্যাশা করছি। কারা আমাদের প্রকৃত বন্ধু এবং অংশীদার, সেটি দেখাই এখন গুরুত্বপূর্ণ।