আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…

10

কাজিরবাজার ডেস্ক :
সেদিনও বইছিল বসন্ত বাতাস। তবে ফাগুনরাঙা সেই বাতাসে মিশেছিল দ্রোহের আগুন। ইতিহাসের বাঁকফেরানো দিনটিতে বারুদের গন্ধ ছড়িয়েছিল শহর ঢাকায়। মায়ের ভাষার অধিকার আদায়ে জ্বলে উঠেছিল তরুণ হৃদয়ের বহ্নিশিখা। শোষকের বিনাশী তৎপরতার মাঝেও অবিনাশী হয়ে উঠেছিল সেসব তরুণ প্রাণ। বুকের রক্তে ছিঁড়ে দিয়েছিল শাসকের ষড়যন্ত্রের সবকটা জাল। রচিত হয়েছিল বাঙালি জাতিসত্তার নতুন ইতিহাস।
তেমনই এক দিন ছিল ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। এদিন বেলা ১১টায় আমতলার সভায় এসেছিল ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত। সভাপতির ভাষণে ছাত্রদের মাঝে বিদ্রোহের উত্তাপ ছড়িয়ে গাজীউল হক বলেন, নুরুল আমিন সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে পুলিশ মোতায়েন করেছে। ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা হলে নাকি গুলি করা হবে, ছাত্রদের হত্যা করা হবে। আমরা সরকারের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করছি। ১৪৪ ধারা আমরা ভাংব। আমরা দেখতে চাই নুরুল আমিন সরকারের অস্ত্রাগারে কত বুলেট জমা আছে।’ এমন উদ্দীপ্ত বক্তৃতা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্লোগান ওঠে, ১৪৪ ধারা মানি নাÑমানি না। গগণবিদারী শ্লোগানের সঙ্গে সঙ্গে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। সত্যাগ্রহ করতে দশজনের দল করে দল বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়। তবে কে প্রথম ভাঙ্গাবে ১৪৪ ধারা, তা নিয়ে ছিল দ্বিধাদ্বন্দ্ব।
মোহাম্মদ সুলতানকে দায়িত্ব দেয়া হয় যারা সত্যাগ্রহ করতে বাইরে যাবেন তাদের নাম, ঠিকানা লিখে রাখার। তাকে সাহায্য করেন আজহার ও হাসান হাফিজুর রহমান। নাম ধাম লিখে নেয়ার জন্য মোহাম্মদ সুলতান এগিয়ে আসতেই মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান শেলী (পরবর্তীকালে প্রধান বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা) বলে ওঠেন, ‘তুই আমার পঙ্খীরাজটা (সাইকেল) দেখিস, আমি চললাম।’ গলা ফাটিয়ে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে যান কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে। ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার প্রথম দলের নেতৃত্ব দিয়ে প্রথম দলের সঙ্গে বেরুলেন মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান।
১৪৪ ধারার ভাঙ্গার ঘটনা প্রসঙ্গে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান স্মৃতিকথায় বলেছিলেন, তখন বেলা সোয়া একটা। উত্তেজনায় সারা গা থেকে তখন আগুনের ভাপ বের হচ্ছে। প্রথমে পুলিশ আমাদের ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে এবং পরে রাস্তার একধারে ঘেরাও করে রাখে। আমরা এগিয়ে যাওয়ার পর যখন অন্যান্য ছাত্ররা গেট পার হয়ে রাস্তায় নামতে শুরু করল তখন আমাদের কয়েকজনকে পুলিশ একটা ট্রাকে তুলে নিল। ট্রাকটা যখন তেজগাঁওয়ের দিকে চলতে শুরু করল তখন মনের অবস্থা হাল্কা করার জন্য আমি বললাম, ‘দূরে কোথাও কোন মজা পুকুরে আমাদের চ্যাংদোলা করে ছুড়ে ফেলা হবে।’ ট্রাকটা চলার সঙ্গে সঙ্গে ঠা-া হাওয়ায় মানসিক উত্তেজনা কিছু কমল, কিন্তু দুর্ভাবনা বাড়তে থাকল।’
এরপর দলে দলে মানুষ বের হতে শুরু করে। ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা ও গ্রেফতার বরণের এক প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে গাজীউল হক বলেন, ‘দ্বিতীয় দলের নেতৃত্ব দিয়ে ইব্রাহীম তাহা ও আবদুস সামাদ বাইরে বেরুলেন। তৃতীয় দল নিয়ে বেরুলেন আনোয়ারুল হক খান এবং আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। তিনটি সত্যাগ্রহী দলকেই পুলিশ গ্রেফতার করে এবং ট্রাকে তুলে নেয়। এসময় পুলিশের তরফ থেকে গেটে একটি হামলা ও লাঠিচার্জ হয়। এর ফলে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম চতুর্থ দলটি যাবে সাফিয়ার নেতৃত্বে। এই দলে বেশ কয়েকজন ছাত্রী ছিলেন। রওশন আরা বাচ্চু, ডাঃ সাফিয়া, সুফিয়া ইব্রাহিম, শামসুন নাহার প্রমুখ।
পুলিশের লাঠিচার্জের ফলে ছাত্ররা উত্তেজিত হয়ে পুলিশের ওপর ইট পাটকেল ছুড়তে থাকে। পুলিশ তখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে কাঁদানে গ্যাস ছাড়ে। ছাত্রদের রক্তে তখন বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। মোহাম্মদ সুলতানের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘সত্যাগ্রহীদের নাম লেখার সময় পাওয়া যাচ্ছিল না। এ সময় কাঁদুনে গ্যাসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ অন্ধকার হয়ে পড়ে। কাঁদুনে গ্যাসের একটি শেল এসে সরাসরি আমার বুকে লাগে এবং আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি।’
পুলিশ এরপর কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয়-চত্বরে প্রবেশ করে। এ সময় কিছুক্ষণের জন্য ছাত্ররা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। তবে কিছুক্ষণের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজের মাঝখানের প্রাচীর টপকে মেডিক্যাল হোস্টেলের প্রধান ফটকের কাছে আবার জমায়েত হন। গ্রেফতারবরণ চলতে থাকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত।