কাজিরবাজার ডেস্ক :
ঘরে বসেই করোনা টেস্ট করার ঝকমকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বেড়াচ্ছে কয়েকটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। এরা আকর্ষণীয় দামে করোনার র্যাপিড এ্যান্টিজেন টেস্ট কিট বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়ে আসছে কয়েকদিন যাবত। এদের রমরমা প্রচারে আকৃষ্ট হয়ে এবং হাসপাতালগুলোতে টেস্টের ভোগান্তি এড়াতে এসব কিনতে ঝুঁকেছেন অনেক সাধারণ মানুষ, যা কোনভাবেই অনুমোদনযোগ্য নয় বলে জানিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর। ইতোমধ্যে ৩টি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চিহ্নিত করা হয়েছে জানিয়ে অধিদফতর বলছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তা বন্ধ করার সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শুধু রাজধানী নয়, চট্টগ্রামেও খুচরা ও পাইকারি মূল্যে অনলাইনে বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপন দিয়ে আসছে এসব প্রতিষ্ঠান। ভারত এবং চীনের তৈরি বলে বিক্রি হওয়া এসব কিটের মূল্য একেক জায়গায় একেক রকম। ১০০ টাকা থেকে শুরু করে ১০০০ টাকা পর্যন্ত দাম আদায় করছেন ব্যবসায়ীরা এসব কিটের বিপরীতে। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা জুবায়ের আল মেহেদি বলেন, এর আগেও সস্ত্রীক গত বছর করোনায় আক্রান্ত হয়েছি। তখন টেস্ট করাতে গিয়ে নানা ধরনের ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। একদিন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে প্রায় সারাদিন লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। এবার আবারও দুজনেই জ্বর-সর্দিতে আক্রান্ত হয়ে ঘরবন্দী অবস্থায় দিন কাটাচ্ছি। কিন্তু গত বছরের কথা মনে করে কোথাও গিয়ে টেস্ট করানোর সাহস পাচ্ছি না। অনলাইনে বাজার করার জন্য খুঁজতে গিয়ে এক জায়গায় করোনা টেস্ট কিটের সন্ধান পাই। ঘরে বসেই যদি এমন সুযোগ পাই তাহলে ক্ষতি কী? তাই অর্ডার দিয়েছি।
একই কথা বলেন রাজধানীর বাসাবো-বৌদ্ধ মন্দির এলাকার বাসিন্দা মারুফ। তিনি বলেন, একেতো জ্বর-সর্দিতে নাকাল অবস্থা, তার ওপর কোথায় টেস্ট করাব- এই নিয়ে ভোগান্তি। তাই অনলাইনে এমন একটা জিনিসই খুঁজছিলাম। পেয়েছিও দুই-এক জায়গায়। কিন্তু কিছুটা দ্বিধা কাজ করছে।
তবে শুধু অনলাইনেই নয়, অভিযোগ পাওয়া গেছে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ফার্মেসিগুলোতেও পাওয়া যাচ্ছে করোনার এ্যান্টিজেন টেস্ট কিট। অভিযোগের কিছুটা সত্যতা পাওয়া যায় সরেজমিন অনুসন্ধানেও। রাজধানীর শাহবাগ এলাকার মেডিএইড ফার্মেসির এক কর্মী জানান, কয়েকদিন থেকেই বেশ মানুষজন আমাদের এখানে টেস্ট কিট খুঁজতে আসছেন। যদিও আমাদের এখানে এমন কিছু নেই, কিন্তু কেউ না কেউ নিশ্চয়ই বিক্রি করছে। আর বিক্রি করছে বলেই মানুষজনের চাহিদা তৈরি হচ্ছে। একই কথা বলেন, মগবাজার নয়াটোলা এলাকার মেখলা ফার্মেসির স্বত্বাধিকারী মিঠু। তিনি বলেন, করোনার শুরু থেকেই এটি প্রতিরোধে আমরা রোগীদের চাহিদামতো ওষুধ সরবরাহ করে আসছি। কিন্তু সম্প্রতি এক শ্রেণীর ক্রেতা আসছেন, যারা করোনার টেস্ট কিট খুঁজছেন। আমাদের কাছে নাই জানালে অন্য দোকানগুলোতে যাচ্ছেন।
তবে টেস্ট কিট বিক্রি হচ্ছে মিটফোর্ড এলাকার কয়েকটি ফার্মেসিতে- এ অভিযোগের অনুসন্ধান করতে গেলে পাওয়া যায় সত্যতা। ওষুধ বেচাকেনার এই প্রাণকেন্দ্রের বেশ কয়েকটি ফার্মেসিতেই পাওয়া গেল করোনার এ্যান্টিজেন টেস্টের কিট। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ফার্মেসির স্বত্বাধিকারী জানান, বিভিন্ন দেশ থেকে এ্যান্টিজেন কিট আমদানি করছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। মূলত সেই কিটই তারা বিক্রি করছেন জানিয়ে তিনি বলেন, এই এলাকায় সাধারণত বিক্রি হচ্ছে ভারত ও চীনের তৈরি কিটগুলো। ক্রেতা বুঝে দাম আদায় করা হচ্ছে। কেউ কেউ বিক্রি করছেন ৫০০ টাকায়, আবার কেউ বিক্রি করছেন ৮০০ টাকায়। এই কিটের স্বাস্থ্য অধিদফতরেরও অনুমোদন রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
তবে এসব কিট একেবারেই অবৈধ বলে জানান ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোঃ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, আমাদের কাছেও এসব বিষয়ে অভিযোগ এসেছে। আমরা ইতোমধ্যে ৩টা অনলাইন প্ল্যাটফর্মকে শনাক্ত করেছি। আশা করছি, তাদের কার্যক্রম বন্ধ করা সম্ভব হবে। আপনাদের কাছেও যদি এমন কোন তথ্য থাকে যে, কেউ স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমোদিত সেন্টারের বাইরে করোনা টেস্ট কিট বিক্রি করছে, তাহলে দয়া করে আমাদের জানাবেন, আমরা ব্যবস্থা নেব। তিনি বলেন, ২০২১ সালের ডেল্টা তাণ্ডব শুরু হলে বেসরকারী পর্যায়ে এ্যান্টিজেন টেস্টের অনুমতি দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর। সেখানে এসডি বায়োসেন্সর হিসেবে কোরিয়ার এবং যুক্তরাষ্ট্রের দুটি কিট ব্যবহারের অনুমোদন দেয়া হয়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত ২৪টি ব্র্যান্ডের কিটকে দেশে জরুরী ব্যবহারের জন্য ইমারজেন্সি ইউজ অথরাইজেশন দেয় ঔষুধ প্রশাসন অধিদফতর। তার বাইরে আর কেউ বিক্রি করতে পারবে না। কেউ যদি এমনটি করে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জানা যায়, দেশে ২০২০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সরকারীভাবে করোনা পরীক্ষায় যুক্ত হয় র্যাপিড এ্যান্টিজেন টেস্ট। সম্প্রতি করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনে সংক্রমণের হার দিন দিন বেড়েই চলেছে। নতুন রোগী যেমন শনাক্ত হচ্ছে, তেমনি মৃত্যু সংখ্যাও বাড়ছে। এ নিয়ে শঙ্কাও বেড়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। এদিকে, গত কয়েকদিন তীব্র ঠান্ডা আবহাওয়া ছিল সারাদেশে। ফলে স্বাভাবিকভাবে বেড়েছে জ্বর-সর্দি-কাশির মতো ঠান্ডাজনিত রোগ। সামান্য এসব রোগেই ভয় পেয়ে অনেকে পরীক্ষা করাতে চাচ্ছেন। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে একটি অসাধু চক্র করোনা পরীক্ষার নিম্নমানের এসব কিট অবৈধভাবে বাজারজাত করার চেষ্টা করছে। যদিও সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) বা সরকারী হাসপাতাল ছাড়া অন্য কোথাও এই টেস্ট করার নিয়ম নেই।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা পরীক্ষা করাতে গিয়ে জটিলতা বা রেজাল্ট প্রাপ্তিতে ভোগান্তির কারণেই এসব অসাধু চক্র জেগে উঠেছে। তাই করোনা পরীক্ষা কার্যক্রম আরও গতিশীল করার আহ্বান জানিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডাঃ এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, করোনার উর্ধমুখী সংক্রমণ চলছেই। এমন অবস্থায় পরীক্ষা করাটা অত্যন্ত জরুরী। কিন্তু প্রায়ই অভিযোগ আসছে, পরীক্ষা করাতে গিয়ে ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। ফলাফল পেতে দেরি হচ্ছে। তা বন্ধ না করতে পারলে তো অসাধু চক্র সুবিধা নেবেই। তাদের আটকাতে আমি মনে করি পরীক্ষার সুযোগ-সুবিধা আরও বাড়ানোর পাশাপাশি ফল দ্রুততম সময়ের মধ্যে দিতে হবে।
এ বিষয়ে আইইডিসিআরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, খোলাবাজারে যে সব কিট বিক্রি হচ্ছে, সে সব কিট মেশিনে পরীক্ষার সুযোগ নেই। আমরা সরাসরি কিট আনছি। খোলাবাজার থেকে কিনছি না। আর আমরা খুবই সতর্কতার সঙ্গে পুরো কাজটি করছি। তা ছাড়া আমাদের কিট বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম মেনে সংগ্রহ করা। আমাদের অনুমোদনের বাইরে এর ব্যবহার সম্পূর্ণ অবৈধ।
করোনা শনাক্তে সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত ও সংবেদনশীল পদ্ধতি হচ্ছে- আরটিপিসিআর বা রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেজ পিসিআর। আর আরেকটি ব্যবহৃত পদ্ধতি হলো এ্যান্টিজেন। কারও শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি রয়েছে কি না, সেটি র্যাপিড এ্যান্টিজেন পরীক্ষার মাধ্যমেও নিশ্চিত হওয়া যায়। র্যাপিড এ্যান্টিজেন টেস্টের প্রধান সুবিধা হলো, ৩০ থেকে ৪০ মিনিটের মধ্যে টেস্টের ফল পাওয়া যায়। করোনার ডেল্টা ধরনের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় গত বছরের এপ্রিলে দ্রুত পরীক্ষার ফলের জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের সার্বিক তত্ত্বাবধানে এ্যান্টিজেন টেস্ট কার্যক্রম শুরু করে বেসরকারী সংস্থা ব্র্যাক। এর আগে ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে করোনাভাইরাস শনাক্তের এ্যান্টিজেন পরীক্ষা চালু হয়। শুরুতে এতে নমুনার সংখ্যা কম পাওয়া গেলেও পরে বাড়তে থাকে। এরপর ১৮ জুলাই করোনার এ্যান্টিজেন পরীক্ষার অনুমোদন পায় ৭৮টি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান। স্বাস্থ্য অধিদফতর নির্ধারিত এর পরীক্ষার সর্বোচ্চ মূল্য ৭০০ টাকা। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে বাসা থেকে নমুনা সংগ্রহে অতিরিক্ত চার্জ ৫০০ টাকা রাখা যেতে পারে।