দেশের জেলাগুলোর মধ্যে বায়ুদূষণে চতুর্থ শীর্ষ স্থানে রয়েছে হবিগঞ্জ জেলা। সর্বোচ্চ বায়ুদূষণ পরিমাপ করা হয়েছে গাজীপুরে আর সর্বনিম্ন মাদারীপুরে। বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে ৬৪ জেলার বায়ুদূষণ সমীক্ষা ২০২১’ উপস্থাপন করে বেসরকারি স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)।
সংবাদ সম্মেলনে গবেষণা তথ্য তুলে ধরেন ক্যাপস প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার। উপস্থিত ছিলেন স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ আলী নকী, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী প্রমুখ।
অধ্যাপক কামরুজ্জামান জানান, স্টামফোর্ড বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) ৬৪ জেলার বায়ুমান বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পর্যালোচনা করে। গবেষণা থেকে দেখা যায়, ২০২১ সালে বাংলাদেশের ৬৪ জেলার সর্বমোট ৩ হাজার ১৬৩টি স্থানের গড় অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা ছিল প্রতি ঘনমিটারে ১০২.৪১ মাইক্রোগ্রাম। এটি দৈনিক আদর্শ মানের (৬৫ মাইক্রোগ্রাম) চেয়ে প্রায় ১.৫৭ গুণ বেশি।
পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ৬৪ জেলার মধ্যে গাজীপুর জেলায় সবচেয়ে বেশি দূষণ পরিলক্ষিত হয়, যার মান ছিল প্রতি ঘনমিটারে ২৬৩,৫১ মাইক্রোগ্রাম। গাজীপুরের পর দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে পার্শ্ববর্তী জেলা ঢাকা এবং তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে নারায়ণগঞ্জ, যার বায়ুমান ছিল যথাক্রমে ২৫২.৯৩ ও ২২২.৪৫ মাইক্রোগ্রাম।
উল্লেখিত সবচেয়ে দূষিত তিনটি শহরের বায়ুমান ছিল বাংলাদেশের আদর্শমানের চেয়ে প্রায় চার-পাঁচ গুণ বেশি। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও সংস্কারকাজ, মেগা প্রকল্প, আশপাশের ইটভাটা, ছোট-বড় কয়েক হাজার শিল্পকারখানা, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কালো ধোঁয়া এবং ময়লা-আবর্জনা পোড়ানো এই প্রধান তিনটি শহরে দূষণের উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে পরিলক্ষিত হয়।
গবেষণার তথ্যানুযায়ী চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে হবিগঞ্জ, নোয়াখালী, টাঙ্গাইল, কক্সবাজার, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম ও কিশোরগঞ্জ। অন্যদিকে সবচেয়ে কম দূষিত শহরের মধ্যে রয়েছে মাদারীপুর, যার বায়ুমান ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৪৯.০৮ মাইক্রোগ্রাম। মাদারীপুরের পরের অবস্থানে রয়েছে পটুয়াখালী ও মেহেরপুর। বায়ুদূষণ কম হওয়ার কারণ হিসেবে সরেজমিনে এসব এলাকায় প্রচুর পরিমাণ গাছপালা ও প্রাকৃতিক জলাধার দেখা গেছে।
সাত ধরনের ভূমির ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণ ছিল মিশ্র এলাকায়, যার মান ছিল প্রতি ঘনমিটারে ১১১.৯ মাইক্রোগ্রাম। পরবর্তী অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে বাণিজ্যিক (১১১.৪ মাইক্রোগ্রাম), রাস্তার সংযুক্তি (১১০.৮ মাইক্রোগ্রাম), আবাসিক শিল্প (১০৬.৭ মাইক্রোগ্রাম) এবং সংবেদনশীল এলাকা (১৭.৩ মাইক্রোগ্রাম)। এদিক থেকে তুলনামূলক কম দূষণ পরিলক্ষিত হয় গ্রামীণ এলাকায়, যার মান ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৯৪.০২ মাইক্রোগ্রাম।
ভালো বায়ুমানের জেলাসমূহের (প্রতি ঘনমিটারে ০-৬৫ মাইক্রোগ্রাম) ৬৪টি জেলার মধ্যে শুধু ১০টি (১৫.৬২%) জেলায় বায়ুর মান ভালো পাওয়া যায় (প্রতি ঘনমিটারে ৬৫ মাইক্রোগ্রামের নিচে) এবং সেই জেলাগুলো হলোÍকুড়িগ্রাম (৬৩.৩৩ মাইক্রোগ্রাম), নাটোর (৬৩.১৯ মাইক্রোগ্রাম), জয়পুরহাট (৫৮.২৪ মাইক্রোগ্রাম), রাজবাড়ী (৫৮.২২ মাইক্রোগ্রাম), রাজশাহী (৫৬.৪১ মাইক্রোগ্রাম), পাবনা (৫৬.২২ মাইক্রোগ্রাম), সিরাজগঞ্জ (৫৫.২ মাইক্রোগ্রাম), মেহেরপুর (৫৩.৩৭ মাইক্রোগ্রাম), পটুয়াখালী (৫১.৪২ মাইক্রোগ্রাম), এবং মাদারীপুর (৪৯.০৮ মাইক্রোগ্রাম)।এসব এলাকা ভৌগোলিকভাবে নদীর পার্শ্ববর্তী হওয়ায় দূষণের বিস্তৃতি কম।
ক্যাপস দেশব্যাপী গত বছর ৬ জানুয়ারি থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত ৬৪ জেলার জেলা শহরগুলোতে ভূমি ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে ৩ হাজার ১৬৩টি স্থানের বস্তুকণার মান পর্যবেক্ষণ করে তা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পর্যালোচনা করে। এই গবেষণায় ৬৪টি জেলা থেকে ৫৩১টি সংবেদনশীল এলাকা (১৬.৭৯%), আবাসিক এলাকা ৪৪০টি (১৩.৯১%), মিশ্র এলাকা ৪০৭টি (১২.৮৭%), বাণিজ্যিক এলাকা ৫৭৫টি (১৮.১৮%), রাস্তার সংযুক্তি এলাকা ৩৫৮টি (১১.৩২%), শিল্প এলাকার ৪৩২টি (১৩.৬৬%) এবং গ্রামীণ এলাকা থেকে ৪২০টি (১৩.২৮%) তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। এই স্থানগুলো থেকে স্বয়ংক্রিয় এয়ার কোয়ালিটি মনিটর ব্যবহার করে উপাত্ত সংগ্রহ করা হয় এবং পরবর্তী সময়ে ঝচংং ও অৎপএওঝ সফটওয়্যার ব্যবহার করে বায়ুর মান বিশ্লেষণ করা হয়।
‘ক্যাপস’ এর দেশব্যাপী বায়ুদূষণ সমিক্ষায় হবিগঞ্জ চতুর্থ শীর্ষ স্থানে থাকায় বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) হবিগঞ্জ শাখার পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়, এই জেলা একসময় বনভুমি, নদনদী, হাওর, জলাশয় অধ্যুষিত ছিল। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে পরিবেশ বিধ্বংসী নানা কর্মকাণ্ডের জন্য এই অঞ্চলের পরিবেশপ্রতিবেশ চরমে সংকটপূর্ণ। জেলার অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, খোয়াই, পুরাতন খোয়াই, সুতাং, সোনাই নদীসহ অন্যান্য নদনদী পুকুর, জলাশয় দখল-দূষণ, পাহাড় কাটা, বনভূমি উজার, পৌরসভার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নির্মাণ সামগ্রী উন্মুক্ত পরিবহণ ইত্যাদি কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। বাসযোগ্য নগরীর জন্য পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড এখনই রোধ করা না হলে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহভাবে পরিবেশ ও মানবিক বিপর্যয় নেমে আসবে। বিজ্ঞপ্তি