কাজিরবাজার ডেস্ক :
রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত গৌরবোজ্জ্বল মহান স্বাধীনতা সমুন্নত রেখে দেশ থেকে সন্ত্রাস, মাদক, দুর্নীতি ও জঙ্গীবাদ নির্মূলের মাধ্যমে জাতির পিতার স্বপ্নের ‘সোনার ুবাংলা’ গড়তে দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার জন্য দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। ধর্মের নামে কোন গোষ্ঠী যেন দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে না পারে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখার পাশাপাশি জনপ্রতিনিধি হিসেবে সংসদ সদস্যদের জনস্বার্থকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দেয়ার আহ্বান জানান। একই সঙ্গে রাষ্ট্রপতি করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন যাতে আমাদের দেশে সংক্রমণ ছড়াতে না পারে, সে জন্য সরকারকে সতর্কতা অবলম্বনসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা বলেছেন।
রাষ্ট্রপতি বলেন, জনপ্রতিনিধি হিসেবে জনস্বার্থকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। নতুন প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ, সুখী, সুন্দর ও উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ উপহার দেয়া আমাদের পবিত্র কর্তব্য। এ লক্ষ্যে গণতন্ত্র, আইনের শাসন এবং উন্নয়নের মতো মৌলিক প্রশ্নে দল-মত, শ্রেণী ও পেশা নির্বিশেষে আপামর জনগণকে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণের জন্য দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, জাতির পিতার আদর্শকে ধারণ করে তারই যোগ্য উত্তরসূরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ নেতৃত্বে আজ বাঙালি জাতি এগিয়ে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর আজীবন লালিত স্বপ্ন সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার পথে।
স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে রবিবার একাদশ জাতীয় সংসদের ষোড়শ অধিবেশনের প্রথম দিনে সংবিধান অনুযায়ী প্রদত্ত ভাষণে রাষ্ট্রপতি এমন আহ্বান জানান। ধর্মের নামে কোন ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী যাতে দেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করতে না পারে, সে দিকে সবাইকে সজাগ দৃষ্টি রাখার আহ্বান জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর নীতির কারণে দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে, যা উন্নয়নের পূর্বশর্ত। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে বিশ্বের জন্য একটি অনন্য উদাহরণ। দেশের সকল মানুষ যাতে সম্প্রীতি সহকারে স্ব স্ব ধর্ম চর্চা করতে পারে- সে বিষয়ে সরকার সচেষ্ট রয়েছে।
তিনি বলেন, মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টানসহ সকল সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসবসমূহ নির্বিঘ্নে যথাযথ ভাবগাম্ভীর্য ও উৎসবমুখর পরিবেশে শান্তিপূর্ণভাবে উদ্যাপন করা হচ্ছে। তথাপি ধর্মের নামে কোন ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী যাতে দেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করতে না পারে সে দিকে আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
সরকারী অর্থের অপব্যবহার রোধপূর্বক প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বনের আহ্বান জানিয়ে রাষ্ট্রপ্রধান বলেন, বিগত দেড় দশকে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারী ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এ জন্য সরকারী অর্থের অপব্যবহার রোধপূর্বক প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে প্রকল্প বাস্তবায়ন শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি সরকারী সকল কার্যক্রমে জনগণের যথাযথ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতামূলক সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে গণতন্ত্রকে অধিক কার্যকর করতে হবে।
প্রতিবারের মতো এবারও মন্ত্রিসভার ঠিক করে দেয়া ১৬৯ পৃষ্ঠা ভাষণের সংক্ষিপ্তসার পড়েন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। বিকেল চারটায় স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অধিবেশন শুরু হয়। সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন। প্রতি বছরের প্রথম অধিবেশন শুরুর দিন রাষ্ট্রপতির ভাষণের সময় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্ত করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় এবার তা করা হয়নি।
কোন সংসদের প্রথম এবং নতুন বছরের প্রথম অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির ভাষণ দেয়ার বিধান রয়েছে। পরে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর একটি ধন্যবাদ প্রস্তাব আনা হয়। পুরো অধিবেশনজুড়ে এই প্রস্তাবের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নেবেন সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা। আলোচনা শেষে রাষ্ট্রপতিকে ধন্যবাদ জানিয়ে সংসদে একটি প্রস্তাব গৃহীত হবে।
অধিবেশন শুরুর পর শোক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এরপর সভাপতিম-লীর মনোনয়ন দেয়া হয়। বিকেল চারটা ২০ মিনিটে স্পীকার রাষ্ট্রপতির আগমনের ঘোষণা দিলে সশস্ত্র বাহিনীর একটি বাদক দল বিউগলে ‘ফ্যানফেয়ার’ বাজিয়ে রাষ্ট্রপতিকে সম্ভাষণ জানান। স্যুট-কোর্ট পরিহিত রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ সংসদ অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করলে সবাই দাঁড়িয়ে তাকে সম্মান জানান। সংসদ কক্ষে রাষ্ট্রপতি ঢোকার পর নিয়ম অনুযায়ী অর্কেস্ট্রায় জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হয়। সংসদে রাষ্ট্রপতির জন্য স্পীকারের ডান পাশের লাল রঙের গতি সংবলিত চেয়ার রাখা হয়। এর আগে বিকেল চারটার আগে সংসদের ‘উত্তর প্লাজা’ দিয়ে সংসদ ভবনে প্রবেশ করেন রাষ্ট্রপতি। স্পীকারের অনুরোধের পর রাষ্ট্রপতি তার লিখিত ভাষণের সংক্ষিপ্তসার পড়া শুরু করেন। এ সময় তার মূল বক্তব্য পঠিত বলে গণ্য করার জন্য স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে অনুরোধ জানান মোঃ আবদুল হামিদ। স্পীকারের আসনের পাশে রাখা ডায়াসে দাঁড়িয়ে ভাষণ দেন রাষ্ট্রপতি। সংসদ নেতাসহ সংসদ সদস্যরা মাঝে মধ্যেই টেবিল চাপড়িয়ে রাষ্ট্রপতিকে অভিনন্দন জানাতে দেখা যায়। রাষ্ট্রপতি বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটে ভাষণ শুরু করে ৫টা ১৫ মিনিটে শেষ করেন।
৫০ মিনিটের ভাষণ শেষে রাষ্ট্রপতি জাতীয় সঙ্গীতের পর অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করেন। এরপর স্পীকার সংসদের অধিবেশন আজ সোমবার সকাল ১১টা পর্যন্ত মুলতবি ঘোষণা করেন। মূল ভাষণের সংক্ষিপ্তসারে রাষ্ট্রপতি দেশের অর্থনীতি, বাণিজ্য-বিনিয়োগ, খাদ্য-কৃষি, পরিবেশ-জলবায়ু, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্নখাতে সরকারের কার্যক্রম ও সাফল্য তুলে ধরেন। এছাড়া দেশের আইনের শাসন সুসংহত ও শিক্ষা সমুন্নত রাখা এবং সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ দমনে সরকারের কার্যক্রমের প্রশংসা করেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ।
২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে শামিল হবে দেশ : ২০৪১ সালে বাংলাদেশ উন্নত দেশের কাতারে শামিল হবে এমন দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করে রাষ্ট্রপতি বলেন, রূপকল্প-২০২১ এর সফল বাস্তবায়ন শেষে রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়িত হচ্ছে। পানি ব্যবস্থাপনা এবং পরিবেশগত পরিবর্তন বিবেচনা করে প্রণীত বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ এর আওতায় বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ২০৩১ সালে উচ্চ-মধ্য আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে শামিল হতে চাই আমরা।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে বাংলাদেশ। এর পরিপ্রেক্ষিতে উত্তরণ পরবর্তী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে তা দ্রুত বাস্তবায়নের কাজ শুরু করতে হবে। উন্নত বাংলাদেশ গড়তে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুযোগ কাজে লাগাতে হলে আমাদের জনমিতির সুবিধা পুরোপুরি ব্যবহার করতে হবে। এ জন্য আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে, যাতে আমাদের নতুন প্রজন্ম দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে।
রাষ্ট্রপ্রধান বলেন, নতুন নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধানসহ বিদেশে শ্রমশক্তি রফতানির প্রচেষ্টা আরও জোরদার করতে হবে। বিশ্ববাজারের চাহিদা অনুযায়ী নতুন প্রশিক্ষণ কারিক্যুলাম প্রস্তুত, বিদ্যমান কারিক্যুলাম যুগোপযোগীকরণ এবং পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে সার্টিফায়েড দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে।
সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করে আবদুল হামিদ বলেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবিসংবাদিত নেতৃত্বে বাঙালী অর্জন করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য তার অব্যাহত সংগ্রাম, নির্ভীক ও দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং গভীর দেশপ্রেম জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্বীকৃত।
রাষ্ট্রপ্রধান বলেন, জাতির পিতার আদর্শকে ধারণ করে তারই যোগ্য উত্তরসূরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ নেতৃত্বে আজ বাঙালী জাতি এগিয়ে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর আজীবন লালিত স্বপ্ন সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার পথে।
ওমিক্রন যেন ছড়াতে না পারে : স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে সরকারের ভূমিকার প্রশংসা করে রাষ্ট্রপতি বলেন, করোনা সংক্রমণরোধে বিভিন্ন প্রকার বিধিনিষেধ আরোপ ও প্রচারের পাশাপাশি ১৫৬টি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে আক্রান্তদের চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়। এ ছাড়া করোনা পরীক্ষার জন্য ১৫১টি আরটিপিসিআর ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়। স্বাস্থ্যসেবা খাতে গত অর্থবছরের তুলনায় বাজেট বৃদ্ধি করা হয়েছে ১৩ শতাংশ।
দেশের সাত কোটি মানুষকে করোনা ভাইরাসের টিকা দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি আশা করেন, দেশের অধিকাংশ জনগণকে টিকার আওতায় আনা হবে। তিনি বলেন, সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে পৃথিবীর অন্য যে কোন দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ এবং সংক্রমণজনিত মৃত্যুর হার অপেক্ষাকৃত কম। প্রধানমন্ত্রীর সাহসী, দূরদর্শী নেতৃত্ব ও অনুপ্রেরণায় আমরা এখন পর্যন্ত করোনা এবং এর অভিঘাত সফলভাবে মোকাবেলা করে যাচ্ছি।
করোনা ভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন নিয়ে সরকারের উদ্দেশে রাষ্ট্রপ্রধান বলেন, করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন যাতে আমাদের দেশে সংক্রমণ ছড়াতে না পারে সে জন্য সরকারকে সতর্কতা অবলম্বনসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মহামারী মোকাবেলায় এবং অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রশংসা করেন আবদুল হামিদ।
তিনি বলেন, বিগত দেড় দশকে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারী ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এ জন্য সরকারী অর্থের অপব্যবহার রোধে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে প্রকল্প বাস্তবায়ন শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি সরকারী সকল কার্যক্রমে জনগণের যথাযথ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে গণতন্ত্রকে অধিক কার্যকর করতে হবে।
জনস্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে জনপ্রতিনিধিদের : জনপ্রতিনিধিদের সব কিছুর ঊর্ধ্বে জনস্বার্থকে স্থান দেয়ার আহ্বান জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস এবং তাদের সকল প্রত্যাশার কেন্দ্রবিন্দু জাতীয় সংসদ। জনপ্রতিনিধি হিসেবে জনস্বার্থকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। এ সময় তিনি সংসদে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সরকারী ও বিরোধী দলের সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানান।
গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে আবদুল হামিদ বলেন, নতুন প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ, সুখী, সুন্দর ও উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ উপহার দেয়া আমাদের পবিত্র কর্তব্য। এ লক্ষ্যে গণতন্ত্র, আইনের শাসন এবং উন্নয়নের মতো মৌলিক প্রশ্নে দল-মত, শ্রেণী ও পেশা নির্বিশেষে আপামর জনগণকে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণের জন্য আমি উদাত্ত আহ্বান জানাই। আসুন লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত গৌরবোজ্জ্বল মহান স্বাধীনতা সমুন্নত রেখে দেশ থেকে সন্ত্রাস, মাদক, দুর্নীতি ও জঙ্গীবাদ নির্মূলের মাধ্যমে জাতির পিতার স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গড়তে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করি।
যোগাযোগ খাতে সরকারের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি বলেন, এমআরটি লাইন ছয়-এর নির্মাণকাজ ৭৪ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে এবং দশ সেট মেট্রোট্রেন বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশে প্রথম মেট্রোরেল চলাচল শুরু করবে। পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে, যা ২০২২ সালের জুন নাগাদ সম্পন্ন হবে। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ জুন ২০২৩ সাল নাগাদ সম্পন্ন হবে। ১৬টি উড়োজাহাজ সংযোজনের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিমানকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হয়েছে।
এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে : সরকারের গত ১৩ বছরের সাফল্যের সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি বলেন, পরিবেশ সুরক্ষা, দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকারের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা আজ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বিস্তৃত হয়েছে। জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৬ এ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের দৃঢ় অবস্থান ও ভূমিকা বিশ্বে আমাদের মর্যাদা আরও বৃদ্ধি করেছে। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বর্তমানে দেশে রক্ষিত এলাকার সংখ্যা মোট ৪৯টি। ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে শুরু করে অদ্যাবধি জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিলে বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে প্রায় ৩ হাজার ৪১৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে গৃহীত ৮০০টি প্রকল্পের মধ্যে ৪৩৫টি প্রকল্প সমাপ্ত হয়েছে। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের পাশাপাশি গ্রামীণ জনপদে আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে সামাজিক বনায়ন এক নতুন দগন্তের সূচনা করেছে।
গৃহহীনদের বিনামূল্যে সরকার থেকে গৃহনির্মাণ করে দেয়ার কথা উল্লেখ করে রাষ্ট্রপ্রধান আবদুল হামিদ বলেন, দুর্যোগ সহনশীলতা অর্জনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। বিভিন্ন দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য ৬৬ হাজার ২৯১টি দুর্যোগ-সহনীয় বাসগৃহ এবং উপকূলীয় ১৬টি জেলায় ২২০টি বহুমুখী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। বজ্রপাতে মৃত্যুরোধে আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম স্থাপন এবং কংক্রিটের বজ্রপাত-নিরোধক শেল্টার নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
‘মুজিববর্ষে দেশের একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না’- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় ১ লাখ ৪৮ হাজার ৩৯৭টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে ২ শতক সরকারী খাস জমি বন্দোবস্ত প্রদানপূর্বক দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সেমিপাকা গৃহ নির্মাণ করে বিনামূল্যে উপকারভোগী স্বামী-স্ত্রীকে এর যৌথ মালিকানা প্রদান করা হয়েছে। ‘মুজিববর্ষ’ এবং ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী’ উদযাপন উপলক্ষে অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে ৪ হাজার ১২২ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩০ হাজার বাসস্থান প্রদান করা হবে। এ সকল কার্যক্রমের মাধ্যমে বিশাল একটি জনগোষ্ঠীকে পুনর্বাসন বিশ্বে সর্ববৃহৎ ও সর্বপ্রথম। দেশের ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল ও অসহায় মানুষের দারিদ্র্য বিমোচনের ধারণা মানবিকতার নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। প্রধানমন্ত্রীর এ ধারণা ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের শেখ হাসিনা মডেল’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
২০২১ ছিল এক অবিস্মরণীয় বছর : রাষ্ট্রপতি তার ভাষণে বলেন, ২০২১ সাল ছিল বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের জন্য এক অবিস্মরণীয় বছর। এ বছরেই আমরা উদ্যাপন করেছি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী। বের এমন মহামিলন, গণমানুষের এমন সম্মিলন ইতিহাসে কমই দেখা যায়। যদিও করোনা মহামারীর কারণে উৎসব পালনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোন বাধাই বাঙালিকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি।
তিনি বলেন, সাড়ম্বরে দেশে ও দেশের বাইরে জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপিত হয়েছে। এসব অনুষ্ঠানে বন্ধু দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানগণ অংশগ্রহণ করে অনুষ্ঠানের মর্যাদা ও আনন্দ-উৎসবে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। এছাড়া অনেক বন্ধু দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান এবং উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণ ভিডিও বার্তার মাধ্যমে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন। এর ফলে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সম্পর্ক ও যোগাযোগ বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হয়েছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের কথা তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি তার ভাষণে বলেন, সজীব আহমেদ ওয়াজেদের সুপরিকল্পিত দিকনির্দেশনায় আমাদের দেশ বহির্বিশ্বে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ হিসেবে সুপরিচিত। বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ এর মাধ্যমে সকল সরকারী-বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে। বর্তমানে ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২’ উৎক্ষেপণের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। মোবাইল সেবা উন্নতকরণ, তথ্য সংগ্রহ ও রিপোর্টিং প্রক্রিয়াকে অটোমেটেড করার পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আহরণে স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণে টেলিকম মনিটরিং সিস্টেম স্থাপনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭৫ দশমিক চার শতাংশ লোকের কমপক্ষে একটি মোবাইল ফোনের মালিকানা রয়েছে এবং ১৫ বছরের অধিক বয়সী মোট ৪৩ দশমিক পাঁচ শতাংশ ব্যক্তি ইন্টারনেট ব্যবহার করে। বিশ্বের নবম দেশ হিসেবে ১২ ডিসেম্বর, ২০২১ থেকে বাংলাদেশ ৫-জি নেটওয়ার্ক যুগে প্রবেশ করেছে। ৫-এ সহজলভ্যতার কারণে প্রচলিত অনলাইনভিত্তিক সকল কার্যক্রম আরও দক্ষ ও গতিশীল হবে। স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের জন্য এটি একটি বিশাল অর্জন।
সরকারের কূটনৈতিক সাফল্যের কথা তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্র ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ এই নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা সরকারের করোনা মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলন, প্রতিবেশী দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের রাষ্ট্রীয় সফর এবং বিদেশে নানাবিধ অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক-সহযোগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হয়েছে।
তিনি বলেন, এর ফলে করোনা পরিস্থিতিতেও একাধিক সমঝোতা স্মারক, অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ দলিলসমূহ স্বাক্ষরিত হয়েছে। সদ্য সমাপ্ত বিশ্ব শান্তি সম্মেলন সফল আয়োজনের মাধ্যমে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের আন্তরিকতা পৃথিবীব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। এ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বজনীন টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকল্পে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ তার বক্তব্যের শেষাংশে আবারও দলমত নির্বিশেষে দেশের সকল শ্রেণী-পেশার মানুষকে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণের উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেন, আসুন লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত গৌরবোজ্জ্বল মহান স্বাধীনতাকে সমুন্নত রেখে দেশ থেকে সন্ত্রাস, মাদক, দুর্নীতি ও জঙ্গিবাদ নির্মূলের মাধ্যমে জাতির পিতার স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গড়তে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করি।