বিধিনিষেধ শুরু, লকডাউন আতঙ্কে মানুষ

16

কাজিরবাজার ডেস্ক :
করোনার সংক্রমণের উর্ধগতি ঠেকাতে বৃহস্পতিবার থেকে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে ১১ দফার বিধিনিষেধ। গণপরিবহনে অর্ধেক যাত্রী বহনসহ বিধিনিষেধে নিষিদ্ধ করা হয়েছে উন্মুক্ত স্থানে সব ধরনের সভা-সমাবেশ। কিন্তু বিধিনিষেধই পরবর্তীতে লকডাউনে রূপ নিতে পারে এই ভয়ে প্রথম দিনই রাজধানী ছাড়ার জন্য কমলাপুর রেলস্টেশনে বেড়েছে ভিড়। হিড়িক পড়েছে যেন ঢাকা ছাড়ার। তবে গণপরিবহনের অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলাচলের সিদ্ধান্ত শনিবার থেকে কার্যকর হওয়ার সিদ্ধান্তে ততটা চাপ পড়েনি বাসস্ট্যান্ডগুলোতে।
স্বাস্থ্যবিধি মানতে সর্বোচ্চ সচেতনতা থাকা সত্ত্বেও রাজধানীর পথে পথে দেখা গেছে মাস্ক ছাড়াই চলছে মানুষজন। এক্ষেত্রে তদারকিতে রয়েছে মোবাইল কোর্ট। জেল-জরিমানার কথা বলা হলেও বিধিনিষেধের প্রথম দিন হিসেবে সতর্ক করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে অনেক জায়গায়। আবার কিছু কিছু জায়গায় করা হয়েছে জরিমানাও। এ অবস্থা চলতে থাকলে সরকারের উদ্দেশ্য সফল না হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
বৃহস্পতিবার সরেজমিনে রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, টিকিট কাউন্টারের মানুষের উপচেপড়া ভিড়। তবে মাস্ক ছাড়া কাউকে রেলওয়ে স্টেশনে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না নিরাপত্তা কর্মীরা। এ নিয়ে ক্ষুব্ধও হতে দেখা গেছে অনেক যাত্রীকে। কেউ আবার বিধিনিষিধের পর পরই লকডাউন আসতে পারে এই ভয়ে পরিবার-পরিজনকে গ্রামে পাঠিয়ে দিতে এসেছেন। রাজধানীর বংশাল এলাকার বাসিন্দা নিরঞ্জন মোদক বলেন, আমাদের গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে। আমি একটি প্লাস্টিক পণ্যের কারখানায় কাজ করি। গত বছরের লকডাউনে চাকরি হারিয়ে ঢাকায় আটকা থেকে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। তাই এবার বিধিনিষেধ শুরু হতেই পরিবারকে বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি। যদি অবস্থা বেগতিক হয় তাহলে আমিও চলে যাব। লকডাউনের ভোগান্তিতে পড়তে রাজি নই। এদিকে স্টেশন প্রাঙ্গণে অনেকেরই মাস্ক নেই। মাস্ক ছাড়া স্টেশনে প্রবেশ করতে না পারা মিরপুরের বাসিন্দা সুরুজ মিয়া বলেন, মাস্ক তো ছিল পকেটেই। কিন্তু স্টেশনে ঢোকার সময় পকেট থেকে পড়ে গেছে। এখন এখানে ঢুকতে দিচ্ছে না। কি যে এক মুশকিল। হঠাৎ করে যাত্রীর চাপ বাড়ায় টিকিটের সঙ্কটও দেখা গেছে। স্টেশন ম্যানেজার সারোয়ার আলম বলেন, যাত্রীদের চাপ সামলাতে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে আন্তঃনগর ট্রেনে সিট ছাড়া টিকেট বিক্রি করছি না। স্টেশনে প্রবেশের প্রধান ফটকে টিকিট দেখানোর পরই প্রবেশের অনুমতি দেয়া হচ্ছে। আবার যাত্রা শেষে বের হওয়ার পথেও যাত্রীদের চেক করা হচ্ছে মাস্ক, টিকিট এসব আছে কিনা। করোনায় ট্রেনে সিট ছাড়া ভ্রমণের নিয়ম না থাকায় আন্তঃনগর কিংবা কমিউটার কোন ট্রেনেই সিট ছাড়া যাত্রী উঠানো হচ্ছে না।
এ সময় টিকিটের জন্য কয়েকজন শিক্ষার্থীকে নিরাপত্তা কর্মীদের সঙ্গে বিতর্কেও জড়াতে দেখা গেছে। একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সিদ্ধার্থ বলেন, করোনার সংক্রমণ আবারও বাড়ায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ক্লাস স্থগিত করেছে। ক্লাস না থাকলে ঢাকায় থেকে কি করব? তাই গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য টিকিট কাটতে আসছি। কিন্তু সকাল থেকে দাঁড়িয়ে থেকেও টিকেট পাইনি। আমার মতো অনেক শিক্ষার্থীর একই অবস্থা। সরকারের উচিত ছিল বিধিনিষেধ দেয়ার আগে আমাদের কথা চিন্তা করার। তাহলে আমাদের অন্তত ভোগান্তি পোহাতে হতো না।
তবে যাত্রীর খুব একটা চাপ দেখা যায়নি রাজধানীর মহাখালী ও সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডে। মহাখালীর বাসের কাউন্টারে কর্মী সিদ্দিকুর জানান, প্রতিদিনের মতোই আজকেও যাত্রী আছে। তবে শনিবারের পর হয়ত পরিস্থিতি বদলাতে পারে।
তবে করোনার সনদ ছাড়া হোটেল-রেস্তরোঁগুলোতে বসে খাওয়া যাবে না এমন নিদের্শনা ছিল পুরোপুরি উপেক্ষিত। পল্টন, মৌচাক, মগবাজার, বাংলামোটর, খিলগাঁওয়ের এলাকার রেস্টুরেন্টগুলোতে স্বাভাবিক দিনের মতোই ছিল মানুষের উপস্থিতি। তাদের কারও কাছে করোনার সনদ আছে আর কার কাছে নেই তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা লক্ষ্য করা যায়নি। রাজধানীর বাংলামোটর এলাকার আলম হোটেলের ব্যবস্থাপক বলেন, দুপুর সময় এত মানুষ আসে কার মাস্ক আছে, কার সনদ আছে তা দেখার কি সুযোগ পাওয়া যায়? একই অবস্থা দেখা যায় ফার্মগেটের হোটেল-রেস্তরাঁগুলোতেও। করোনার সনদ দেখা তো দূরে থাক বেশিরভাগ খেতে আসা মানুষের মুখে মাস্ক পর্যন্ত ছিল না।
এদিকে বিধিনিষেধ শুরু হওয়া রাজধানীর কাঁচাবাজারগুলোতেও ছিল মানুষের উপচেপড়া ভিড়। এদিন সকালে রাজধানীর শান্তিনগর কাঁচাবাজারের সামনে দেখা যায় হাজারো মানুষের ভিড়। এদের কেউ ক্রেতা কেউবা বিক্রেতা। মাছের বাজারের অংশটা কোন বিক্রেতার মুখেই ছিল না মাস্ক। স্বাস্থ্যবিধি মানার কথা তো দূরে থাক নেই ন্যূনতম শারীরিক দূরত্বেরও বালাই। নগরীর মগবাজারের নয়াটোলা থেকে মাছ কিনতে আসা ফরহাদ হোসেন বলেন, এখান থেকেই সপ্তাহের মাছ কিনে নিয়ে যাই। আজ থেকে যেহেতু বিধিনিষেধ শুরু হচ্ছে তাই হয়ত নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে পারে। তাই ভোর চলে এসেছি। কিন্তু এখানকার পরিস্থিতি দেখে তো চক্ষু চড়কগাছ। মানুষের এত ঠেলাঠেলি যে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকাই মুশকিল। আর দোকানদার কারও মুখেই তো মাস্ক নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কী করছে কে জানি। বাজারের মাছ বিক্রেতা রিপন মিয়া বলেন, বেচি মাছ। আমাদের আবার স্বাস্থ্যবিধি কী? এত এত মাছ কাটতে-ধুইতে হয় মাস্ক কতক্ষণ পরে থাকা যায়? একই অবস্থা দেখা যায় কাওরানবাজারেও। লকডাউনের ভয়ে বাজারে যেন গিজগিজ করছে মানুষ। এদের বেশিরভাগই এসেছেন নিত্যপণ্যের পাশাপাশি পুরো মাসের বাজার করে নিতে। কিন্তু অধিকাংশের মুখেই নেই মাস্ক। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন রাজধানীর খিলগাঁও থেকে বাজার করতে আসা বিপ্রজিত চন্দ। বলেন, রাস্তার মোড়ে মোড়ে তো আর মোবাইল কোর্ট বসিয়ে লাভ নেই। যেখানে জনসমাগম বেশি সেখানেই তো অভিযান চালাতে হবে। আপনি নিজেই দেখেন এই বাজারে কয়জনের মুখে মাস্ক রয়েছে? স্যানিটাইজার, সামাজিক দূরত্ব এসব তো বাদই দিলাম। তাই আমি মনে করি মোড়ে মোড়ে কোর্ট না বসিয়ে এসব বাজারগুলোতে অভিযান চালানো হোক।
তবে বিধিনিষেধের প্রথম দিন হিসেবে রাজধানীর গুলশান, মতিঝিল, বিজয় সরণিসহ কয়েকটি জায়গায় বসা মোবাইল কোর্ট মাস্ক ছাড়া মানুষজনকে ছাড় দিলেও শাহবাগ মোড়সহ কয়েকটি মোড়ে করা হয় জরিমানাও। এদিন রাজধানীর প্রায় সব জায়গায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। পাশাপাশি বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে মাঠে ছিল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশও (ডিএমপি)। এদিন রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতে ডিএমপির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ডাঃ সঞ্জীব দাস পৌনে দুই ঘণ্টার অভিযানে ১১ জনের নামে মামলা দেন। তাদের ১০০ থেকে ২০০ টাকা করে অর্থদণ্ড দেয়া হয়। অভিযানে ১১ জনকে মোট দুই হাজার ৫৫০ টাকা জরিমানা করা হয় জানিয়ে ডাঃ সঞ্জীব দাস বলেন, এই সময়ে ৫০ থেকে ৬০ জনকে নিজের টেবিলে ডেকে পাঠাই। তাদের প্রত্যেকেরই মাস্ক পরায় ত্রুটি ছিল। কেউ থুতনিতে মাস্ক পরেছেন, কেউ ম্যাজিস্ট্রেট দেখে পকেট থেকে মাস্ক বের করেছেন। এছাড়া অধিকাংশের কাছেই ছিল না মাস্ক। তারা দিয়েছেন নানা অজুহাত। তিনি বলেন, পথচারী ও গণপরিবহনের যাত্রীরা সার্বিকভাবে আমরা দেখেছি অনেকে মাস্ক ছাড়া বের হয়েছেন, কেউ কেউ আবার মাস্ক পকেটে রাখছেন। কয়েকজনকে মৌখিকভাবে সতর্ক করা হয়েছে। পরবর্তীতে মাস্ক পরবে এ মর্মে মুচলেকাও নেয়া হয়েছে। অপরাধ বিবেচনায় অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে। তবে আমাদের মূল উদ্দেশ্য সবাইকে সতর্ক করা।
এমন অবস্থা চলতে থাকলে সরকারের দেয়া বিধিনিষেধ কতটুকু কার্যকর হবে তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। এ ব্যাপারে কোভিড-১৯ প্রতিরোধে গঠিত জাতীয় কারিগরি কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডাঃ ইকবাল আর্সনাল বলেন, জানুয়ারির প্রথম দিন থেকে আমরা দেখছি করোনার দৌরাত্ম্য আবারও শুরু হয়েছে। তাই আমরা সরকারকে পরামর্শ দিয়েছি স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতে লকডাউন না হোক অন্তত বিধিনিষেধ দেয়া হোক। যা বৃহস্পতিবার থেকে কার্যকর হয়েছে। কিন্তু মানুষজনের মধ্যে যদি সচেতনতা তৈরি না হয় তাহলে কোন বিধিনিষেধেই কিছু হবে না। এখনও সময় আছে সবাইকে সতর্ক হতে হবে। না হলে আমাদের আরেকটা মহামারী অবস্থার জন্য প্রস্তুত হতে হবে।
প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডাঃ এ বি এম আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, আমরা বার বার মানুষকে একটা কথাই বলছি, করোনা চলে যাবে না। যতদিন পুরো পৃথিবীতে একজনও করোনার রোগী রয়েছে ততদিন বার বার এর ঢেউ ফিরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। আর তাই নিজের সচেতনতা নিজেকেই নিতে হবে। এত ভয়াবহ অবস্থার পরও কেউ যদি সচেতন না হয় তাহলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আরও কঠোর হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। জেল-জরিমানার পাশাপাশি আরও যদি কোন কঠিন শাস্তি থাকে তাহলে সেটাই দেয়া উচিত হবে।
প্রসঙ্গত, গত সোমবার বিকেলে মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ থেকে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন ইস্যুতে ১১ বিধিনিষেধ জারি করে একটি প্রজ্ঞাপন দেয়া হয়। ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, করোনাভাইরাসজনিত রোগ কোভিড-১৯ এর নতুন ধরন ওমিক্রনের প্রাদুর্ভাব এবং দেশে এ রোগের সংক্রমণ পরিস্থিতি পর্যালোচনা সংক্রান্ত সভায় নেয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখা এবং সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ১৩ জানুয়ারি থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত সার্বিক কার্যাবলী/চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।