সোনার বাংলা গড়বো ॥ জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় প্রত্যয়

11
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে ধানমন্ডি-৩২ এর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রজমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানান ও মোনাজাতে অংশগ্রহণ করেন। এ সময় জাতির পিতার কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা উপস্থিত ছিলেন।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশের বিদ্যমান অগ্রগতি ধরে রাখতে সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, আমাদের লক্ষ্য যে স্বপ্ন নিয়ে জাতির পিতা বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলেন, সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো এবং বাংলাদেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলা। আজকের দিনে সে প্রত্যয়ই ব্যক্ত করছি। ইনশাআল্লাহ যতটুকু পারি জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের ভাগ্যটা পরিবর্তন করে দিয়ে যাব এবং দেশবাসীকেও আমি সে আহ্বানই জানাই- আজকের যে অগ্রগতিটা হয়েছে সেটা ধরে রেখে আমরা যেন আরও এগিয়ে যেতে পারি সোনার বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে।
সোমবার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে আয়োজিত ‘মুক্ত স্বদেশে জাতির পিতা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানের আলোচনা পর্বে সভাপতির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এমন দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তিনি গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীর রামপুরায় বাংলাদেশ টেলিভিশন সেন্টারের (বিটিভি) শহীদ মনিরুল আলম মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত এই বিশেষ অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশ টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার হয়।
বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের লক্ষ্য একটাই, যে আদর্শের জন্য জাতির পিতা দেশ স্বাধীন করেছিলেন, যে লক্ষ্যে তিনি সারাজীবন সংগ্রাম করেছিলেন, জেল-জুলুম-অত্যাচার বার বার সহ্য করেছেন, নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন যে মানুষগুলোর জন্য- সেই মানুষগুলোর ভাগ্য গড়াই আমাদের লক্ষ্য।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার পর মাত্র সাড়ে ৩ বছর হাতে সময় পেয়ে জাতির পিতা বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করে একেবারে তৃণমূলের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, ভোটের অধিকার এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন, তাদের ক্ষমতায়ন করতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেন, যখনই জাতির পিতা সাধারণ মানুষ তথা তৃণমূলের মানুষের ক্ষমতায়নের জন্য পদক্ষেপ নিলেন, আর্থসামাজিক উন্নয়নের পদক্ষেপ নিলেন, তখনই কিন্তু ১৫ আগষ্টের আঘাতটা এলো। এই আঘাতটা শুধু একজন রাষ্ট্রপতিকে হত্যা নয়, এই আঘাত ছিল একটি স্বাধীন দেশের আদর্শ ও চেতনাকে হত্যা করা।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, ১৫ আগষ্টের পর থেকে যারা ক্ষমতায় এসেছিল তারা সেভাবেই রাষ্ট্রটা চালিয়েছিল। ১৫ আগষ্টের খুনী, স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী, মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী তারাই ক্ষমতায় বসেছিল। আর মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের কোন চেষ্টাই তারা করেনি। কাজেই যে মানুষগুলোর জন্য তিনি (জাতির পিতা) নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন, আজীবন জেল-জুলুম-অত্যাচার সহ্য করেছেন সেই মানুষগুলোর ভাগ্য গড়াটাই আমাদের লক্ষ্য।
ভোট দিয়ে বারবার নির্বাচিত করায় দেশের জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সরকারপ্রধান বলেন, তারা (দেশবাসী) আমার ওপর আস্থা রেখেছেন, বার বার আমি ক্ষমতায় এসে দেশের মানুষের উন্নয়নে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি এবং সবথেকে বড় কথা জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির পিতার পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত স্বদেশে ফিরে আসার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসটি পালন করতে পারছি।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মহিউদ্দিন আহমেদ অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির সমন্বয়ক ড. কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী স্বাগত বক্তব্য রাখেন। ছোট ছেলে-মেয়েদের অংশগ্রহণে সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের শুরু হয়। এরপরই এতে মুজিববর্ষের থিম সঙ্গ- ‘তুমি বাংলার ধ্রুবতারা, হৃদয়ের বাতিঘর’ সমবেত কণ্ঠে পরিবেশিত হয়। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে জাতির পিতার মুক্ত স্বদেশে ফিরে আসার ওপর একটি ভিজ্যুয়াল প্রেজেন্টেশন অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয়। বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানার তার বাবাকে নিয়ে লেখা ‘বাবা’ এবং মা’কে নিয়ে লেখা ‘রেনু আমার মা’ কবিতা দুটি অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করে শোনান বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এমপি। জাতির পিতার ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঐতিহাসিক রেসকোর্সের ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দেয়া ভাষণের উল্লেখযোগ্য অংশও অনুষ্ঠানে প্রচার করা হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সবসময় বাঙালির হৃদয়ে ছিলেন উল্লেখ করে সভাপতির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তানী সেনারা তাকে সে দেশে নিয়ে বন্দী করে রাখে। কিন্তু তিনি সবসময় মুক্তিকামী মানুষের পাশে ছিলেন। তিনি সশরীরে আমাদের মধ্যে ছিলেন না, কিন্তু তিনি বাঙালির হৃদয়ে ছিলেন। তার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ধারণ করে বাঙালি জাতি যুদ্ধ করেছে। তিনি বলেন, দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু তার লক্ষ্য অর্জন করেছিলেন। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৬ দফা, ’৭০-এর নির্বাচন, ৭ মার্চের ভাষণ, সবশেষ আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের সর্বাগ্রে ছিলেন তিনি। তার ভাষণ আমাদের মুক্তিকামী মানুষকে প্রেরণা জুগিয়েছে।
বঙ্গবন্ধু কখনও মৃত্যুকে ভয় পেতেন না জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে এটাও বলেছিলেন যখন তাকে ফাঁসি দেয়ার নির্দেশ হয়, তখন একটি দাবি তিনি শুধু করেছিলেন যে, আমাকে তোমরা মেরে ফেলতে পার। কিন্তু আমার লাশটা আমার বাঙালির কাছে পৌঁছে দিও। আমার বাংলার মাটিতে পৌঁছে দিও। তিনি (বঙ্গবন্ধু) দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেছিলেন, ‘আমি মুসলমান, মুসলমান একবার মরে, বারবার মরে না’। তিনি বলেন, জাতির পিতা কখনও ভয় করেননি, জয় করেছিলেন।
জনগণের প্রতি ভালোবাসার কারণেই বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরেই সোজা তার প্রিয় জনগণের কাছে ছুটে গিয়েছিলেন উল্লেখ করে তার কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, স্বাধীনতার পর যেদিন বঙ্গবন্ধু দেশে এলেন, দিনটি আমাদের জন্য কেমন ছিল তা ভাষায় বোঝাতে পারব না। ১০ জানুয়ারি তিনি ফিরে আমাদের (পরিবার) কাছে আসেননি। কারও কথা না ভেবে দেশের মাটিতে নেমেই তিনি চলে গেছেন সোজা তার প্রিয় জনগণের কাছে। যে জনগণের জন্য তিনি তার জীবনটা উৎসর্গ করেছেন। দেশে ফিরেই জাতির উদ্দেশে দেয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, সেই ভাষণটা ছিল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা। এ ভাষণটা ছিল স্বাধীন রাষ্ট্র কাঠামো কী রকম হবে, স্বাধীন রাষ্ট্র কীভাবে চলবে, স্বাধীন রাষ্ট্র কীভাবে কোন আদর্শে চলবে, সেই আদর্শই তিনি (বঙ্গবন্ধু) এ ভাষণে বলেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, হয়তো পাকিস্তানী কারাগারে বঙ্গবন্ধু অনেক অত্যাচারিত হয়েছেন। কিন্তু আমাদের কাছে কোন কষ্টের কথা কখনও বলেননি। শুধু শেখ রেহানাকে একবার বলেছিলেন, তোদের শোনার দরকার নেই, তোরা সহ্য করতে পারবি না। এ থেকেই আমরা তার ওপর অত্যাচারের বিষয়টি বুঝতে পারি। কারাগারে কি দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে থাকতে হয়েছে সেটা বুঝতে পারি। পাকিস্তানের কারাগারে থাকাকালীন জাতির পিতার বিরুদ্ধে মামলা ও ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়, সেলের কাছে কবর খোঁড়া হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২৫ মার্চ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। যে ঘোষণা তৎকালীন ইপিআরএর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সারাবাংলাদেশে ছড়িয়ে দেয়া হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানী বাহিনী ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি আক্রমণ করে জাতির পিতাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। আর পরদিন সেই বাড়ি আবার আক্রমণ করে তার মা ও রাসেলসহ অন্যদের গ্রেফতার করে ধানমন্ডির একটি বাড়িতে আটকে রাখে। তিনি বলেন, দেশ ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন হলেও তারা ১৭ ডিসেম্বর ধানমন্ডির সেই বাড়িতে পাকিস্তানী বন্দীদশা থেকে মুক্ত হন এবং তখনও জানতেন না তার বাবার ভাগ্যে কি ঘটেছে। এরপর ৮ তারিখে পিতার প্রথম কোন সংবাদ জানতে পেরে তারা যেন বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।