যুগে যুগে মতভিন্নতার ধরন, প্রকৃতি এবং তার প্রতিকার

16

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥
(পূর্ব প্রকাশের পর)
“ইমাম আবূ দাউদ, আস-সুনান, অধ্যায়: তাহারাত, পরিচ্ছেদ: ইযা খাফাল জুুনুবু আলবারদা হা. নং: ৩৩৪”এ হাদীস থেকে জানা যায় যে, যদিও ‘আমর ইবনুল ‘আস (রা.) এর উক্ত ইজতিহাদ সাহাবীগণের নিকট পছন্দনীয় হয়নি এবং এ কারণে তারা মাদীনায় ফিরে বিষয়টি রাসূলুল্লাহ (স.) কে অবহিত করেন: কিন্তু রাসূলুল্লাহ (স.) আমর ইবনুল ‘আস (রা.) এর বক্তব্য শোনে তার ইজতিহাদ অনুমোদন করলেন। এ থেকে অনেক উসুরবিদই মনে করেন যে, রাসূলুল্লাহ (স.) এর যুগে তার অনুপস্থিতিতে সাহাবীগণের ইজতিহাদ করেন আমাল করা যায়িয ছিল। “ইবন হজার, ফাতহুল বারী (বৈরুত: দারুর মা‘রিফাহ, ১৩৭৯হি.) খ.১, পৃ. ৪৫৪; বাদরুদ্দীন আল-আইনী, শারহু সুনানী আবী দাউদ (রিয়াদ: মাকতাবাতুর রুশদ ১৯৯৯ খ্রি).”
সাইয়িদুনা আবূ সা‘ঈদ আল-খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার দুজন ব্যক্তি সফরে বের হন। পথিমধ্যে তাদের নামাযের সময় হয়। কিন্তু তাদের সাথে অযু করার মতো কোনো পানি ছিল না। ফলে তারা দুজনেই পবিত্র মাটিতে তায়াম্মুম করে নামায আদায় করে নেন। এপর নামাযের সময়ের মধ্যে তারা দুজনেই পানি পেলেন। ফলে তাদের একজন অযু করে পুনরায় নামায আদায় করলেন: কিন্তু অপর ব্যক্তি পুনরায় নামায পড়লেন না। পরবর্তীতে তারা দুজনেই রাসূলুল্লাহ (স.) এর খিদমাতে এসে তাঁকে তাঁদের উক্ত অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করলেন। রাসূলুল্লাহ (স.) যিনি পুনরায় নামায পড়ে দেননি তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “তুমি সঠিক নিয়মই পালন করেছ। তোমার ঐ নামাযই তোমার জন্য যথেষ্ট হবে। আর যিনি অযু করে পুনরায় নামায পড়ে দেন রাসূলুল্লাহ (স.) তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমার জন্য দুবারই পুরস্কার রয়েছে। “আবূ দাউদ, আস সুনান, অধ্যায় : তাহারাত, পরিচ্ছেদ: আল মুতাইয়াম্মিম ইয়াজিদুল মা’আ…, হা. নং: ৩৩৮”
এ হাদীস থেকে জানা যায় যে, তাঁরা দুজনেই নিজে নিজে ইজতিহাদ করে আমাল করেন এবং তা নিয়ে তাঁদের দুজনের মধ্যে মতভিন্নতা ও দেখা দেয়। কিন্ত পরে রাসূলুল্লাহ (স.) তাঁদের মতপার্থক্যের কথা জানতে পেরে তাঁদের কাউকে তিরষ্কার তো করলেনই না; বরং তাঁদের প্রত্যেকের আমাল অনুমোদন করলেন। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (স.) এর যুগে তার অনুপস্থিতিতে সাহাবীঘন ক্ষেত্রবিশেসে ইজতিদহাদ করে আমাল করতেন এবং তা নিয়ে তাঁদের পরস্পরের মধ্যে মতপার্থক্য ও দেখা দিতো। পরে রাসূলুল্লাহ (স.) তাঁদের মতপার্থক্যের কথা জানতে পেরে তাদের প্রত্যেকের আমাল অনুমোদন ও করতেন।
সাইয়িদুনা জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক সফরে আমাদের জনৈক সাথীর মাথা ফেটে যায়। পরবর্তীতে তার গোসল ফারয হলে তিনি এ অবস্থায় তায়াম্মুন করার কোনো সুযোগ আছে কিনা জানতে চাইলেন। সাথীরা বললো, যেহেতু তুমি পানি ব্যবহার করতে পারছো, তাই তোমার তায়াম্মুম কারা কোনো সুযোগ নেই। তখন তিনি বাধ্য হয়ে গোসল করলেন। এতে তাঁর মৃত্যু হলো। আমরা মাদীনায় এসে রাসূলুল্লাহ (স.) কে ঘটনাটি সম্পর্কে অবহিত কররে তিনি তাঁর সাথীদেরকে কঠোরভাবে তিরষ্কার করে বললেন “ তারা তাকে খুন করেছে। আল্লাহ তা‘য়ালা তাদের ধ্বংস করুন! জানা না থাকলে তারা জিজ্ঞাসা করে নিলো না কেন? জিজ্ঞাসাই তো হলো অজ্ঞতার নিরাময়। তার জন্য কতটুকুই যথেষ্ট ছিল যে, সে তায়াম্মুম করবে অথবা ক্ষতস্থান পট্টি বাঁধবে এবং তার ওপর মাসহ করবে আর শরীরের অন্যান্য অংশ ধুয়ে ফেলবে। “দারাকুতনী, আস-সুনান, অধ্যায় : তাহারাত পরিচ্ছেদ: জাওয়াযুত তায়াম্মুম লি সাহিবিল জিরাহ খ. ১. পৃ, ১৮৯ হা. নং: ৬৪/৩; বাইহাকী, আস সুনানুস সুগরা, অধ্যায় তাহারাত পরিচ্ছেদ: আত তায়াম্মুন হা. নং: ১৮১”
এ হাদীস থেকে ও জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (স.) এর যুগে তাঁর অনুপস্থিতিতে সাহাবীগণ ক্ষেত্রবিশেষ ইজতিহাদ করে আমাল করতেন। তবে তিনি এরুপ কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁদের ইজতিহাদের প্রয়োজনীয়ত যোগ্যতা নেই, তাঁরা নিজেরা ইজতিহাদ করে সিদ্ধান্ত দেবেন। এটা তিনি মোটের ওপর পছন্দ করতেন না। বরং তাঁদের একান্ত কর্তব্য হলো, বিজ্ঞ আলিমের শরণাপন্ন হওয়া এবং তাঁদের কথা মেনে চলা। “আল-খাতাবী আল-বাগদাদী, আল-ফাকীহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ খ.২, পৃ, ৩৫৩।
ইতোপূর্বে রাসূলুল্লাহ (স.) এর যুগে মতপার্থক্যের যে অবস্থা আলোচনা করা হলো, তার আলোকে আমরা তার সময় কার মতপার্থক্যের কতিপয় সাধারণ বৈশিষ্ট্য সংক্ষেপে তুলে ধরতে পারি।
সাহাবা কিরাম (রা.) যথাসাধ্য সতবিরোধ থেকে বেঁচে থাকতে চেষ্টা করতেন। এ কারণে তাঁরা ভবিষ্যতে সংঘটিত হতে পারে। এমন সব বিষয় ও খুঁটিনাটি ব্যাপার এড়িয়ে যেতেন। তাঁরা কেবল বাধ্য হয়েই সময়ে সময়ে আপতিত বিভিন্ন পরিস্থিতি ও ঘটনাতে নিজেদের করণীয় জানতে চেষ্টা করতেন। এর ফলে আপতিত ঘটনা তাৎক্ষণিক সমাধান বের করার প্রয়োজন দ্বন্দ্ব সংঘাত তো দূরের কথা, পরস্পর মতবিরোধে জড়িয়ে পড়ার সুযোগ ও তাঁদে বেশি ছিল না।
মতুবিরোধ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা সত্ত্বেও যদি তাঁদের মধ্যে ঘটনাক্রমে কোনো বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিতো, তখন তাঁরা দেরি না করে দ্রুত আল্লাহর কিতাব ও রাসূলুল্লাহ (স.) এর শরাণাপন্ন হতেন। এভাবে অতি অল্প সময়ের মধ্যে তাঁদের মতবিরোধ নিরসন হয়ে যেতো।
যে কোন বিরোধের সময তাঁরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ফায়সালার প্রতি পূর্ণ আত্ম সমর্পণ করতেন এবং পরিপূর্ণরূপে তা মেনে চলতেন।
অনেক ব্যাখ্যানির্ভর বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (স.) মতবিরোধকারীদের পরস্পর ভিন্ন সব মতকেই সঠিক বলে অনুমোদন দেন। এতে প্রত্যেকেরই এ ধারণা লাভ হতো যে, তিনি যে মত পোষণ করেছেন তা যেমন সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা রাখে, তেমনি তাঁর অপর ভাইয়ের মতও সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা রাখে, তেমনি তাঁর অপর ভাইয়ের মতও সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। বস্তুতপক্ষে এ ধারণা মতবিরোধকারীদের প্রত্যেককে একে অপরের মতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে শিক্ষা দেয় এবং নিজের মতের প্রতি পক্ষপাতিত্বমূলক ভূমিকা গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখে।
সাহাবীগণের মতবিরোধের পেছনে সকলের একান্ত উদ্দেশ্য ছিল, নিজ নিজ ইজতিহাদের মাধ্যমে সত্য বরে করা ও তার ওপর ‘আমাল করা। তাঁদের সে মতবিরোধে কোনো প্রকারের স্বার্থপরতা, আত্মপ্রীতি, হঠকারিতা ও গোঁড়ামির স্থান ছিল না।
সাহাবীগণ মতবিরোধের ক্ষেত্রে কখনো ইসলামের সাধারণ শিষ্টাচার-রীতি লঙ্ঘন করতেন না। তাঁরা প্রত্যেকেই নিজের অভিমত যুক্তিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করতেন, একে অপরের মত গভীর মনোযোগ সহাকারে শোনতেন, সুন্দর ও মার্জিত ভাষা ব্যবহার করতেন এবং যে কোনো ভাবে কটাক্ষ করা থেকে বিরত থাকতেন।
রাসূলুল্লাহ (স.) এর যুগে যেমন ফিকহী বিষয়ে ক্ষেত্রবিশেষ ইজতিহাদী মতপার্থক্য দেখা গিয়েছিল, তেমনি তাঁর ইন্তিকালের পর সাহাবা কিরামের আমলেও মতপার্থক্য এরূপ দেখা গিয়েছিল। তদুপরি এ সময়কার অনেক বিষয়ের মতপার্থক্য অমীমাংসিতও থেকে যায়। যেমনÑ সালাত আদায় তরককারীর কাফির হওয়া বা না- হওয়া, গোসলে মহিলাদের মাথার খোপা খোরা বা না-খোলা, গর্ভবতী নারী বিধবা হলে ‘ইদ্দাতের সময়কাল কতটুকু হবে প্রভূতি বিষয়গুলো সাহাবা কিরামের আমলেও অমীমাংসিত ছিল। সাহাবা কিরাম (রা.) এর পর মুজতাহিদ ইমামগণও কুরআন ও হাদীস এবং নিজস্ব কতিপয় মূলনীতি অনুসরণ করে নানা বিষয়ে ইজতিহাদ করেছেন এবং তা নিয়ে তাদের মধ্যে বেশ সতপার্থক্যও দেখা দেয়। কিন্তু সাহাবা কিরাম (রা.) ও মুজতাহিদ ইমামগণের এ মতপার্থক্যের মধ্যে আমরা কতিপয় সাধারণ বৈশিষ্ট্য ও শিষ্টাচার দেখতে পাই। যেমন- মুজতাহিদ ইমামগণ যদিও শারী‘আতের অপ্রধান বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্য করেছেন; কিন্তু তাঁদের কেউ নিজের মতকে একমাত্র সঠিক মত এবং অন্যান্যের মতকে ভ্রান্ত মনে করতেন না। বরং তাঁদের প্রত্যেকের দৃষ্টিভঙ্গি হতো এই যে, তাঁর মতটি তাঁর গবেষণা ও চিন্তা অনুযায়ী সঠিক; কিন্তু প্রকৃত বিচার তা ভুল হওয়ারও সম্ভাবনা রাখে। অপরদিকে অন্যের মতটি তাঁর গবেষণা ও চিন্তা অনুযায়ী ভুল; কিন্তু প্রকৃত বিচার তা সঠিক হওয়ারও সম্ভাবনা রাখে। এ কারণে মুজতাহিদ ইমামগণ তাঁদের মতামত খুব কমই দৃঢ়তাসূচক ভাষায় ব্যক্ত করে থাকেন; বরং আমরা তাঁদেরকে প্রায়শ নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে গিয়ে এ কথা বলতে দেখতে পাই যে, (এটা অধিকতর সর্তকতামূলক ব্যবস্থা), (এটা অধিকতর বিশুদ্ধ), (এটা অধিকতর উত্তম), (এটা অধিকতর উপযোগী), (এটা সমীচীন), (এটা আমরা অপছন্দ করি), (এটা আমার পছন্দনীয় নয়) প্রভৃতি। বিশিষ্ট সাহাবীগণের নিয়ম ছিল যে, তাঁরা যখনই কোনো বিষয়ে নিজের রায় ও ইজতিহাদের ভিত্তিতে কোনো ফাতওয়া দিতেন, তখন বলতেন: “যদি তা সঠিক হয়, তবেই তা আল্লাহর পক্ষ থেকে। আর যদি ভুল হয়, তবে তা আমার ও শায়তানের পক্ষ থেকে এবং তা থেকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল দায়মুক্ত।” “এ উক্তি করেছেন সাইয়দুনা আবূ বাকর (দ্র. দারিমী, আস-সুনান, হা.নং: ২৯৭২; বায়হাকী, আস-সুনানুল কুবরা, হা. নং: ১২৬২৯), ‘উমার (দ্র. বায়হাকী, আস-সুনানুল কুবরা, হা. নং: ২০৮৪৫; হাকিম, আল-মুস্তাদরাক, হা. নং: ২৭৩৭) ও ‘আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘উদ (দ্র. আবূ দাউদ, আস-সুনান, হা. নং:২১১৮; দারাকুতনী, আস-সুনান, হা. নং: ১৬৫; তাবারানী, আল-মু‘জামুল কাবীর, হা. নং: ৫৪৩, ৫৪৪, ৫৪৫) এ ছাড়াও অন্যান্য অনেকের থেকেও অনুরূপ বক্তব্য বর্ণিত রয়েছে।” (অসমাপ্ত)