কাজিরবাজার ডেস্ক :
মত বা পেশা বিবেচনা না করে সৎ, দক্ষ ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদকে অনুরোধ জানিয়েছে ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদ (ইনু)। দলটি নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে একটি সুনির্দিষ্ট ও স্থায়ী আইন কাঠামো তৈরিতে রাষ্ট্রপতিকে ভূমিকা পালনেরও অনুরোধ জানিয়েছে। দলটির নেতারা জানান, সংলাপে রাষ্ট্রপতি বলেছেন, দ্রুতই তিনি সার্চ কমিটি গঠন করবেন। সার্চ কমিটি ইসি গঠনের ব্যাপারে যদি কোন নাম চায় তাহলে সেখানে সহযোগিতা করার জন্য জাসদ নেতাদের তিনি আহ্বান জানান। বৈঠক শেষে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ একটি গ্রহণযোগ্য ও দক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতিকে সহযোগিতা করবে। তিনি অভিযোগ করেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচাল করার চক্রান্তের অংশ হিসেবে বিএনপি ইসি গঠনে রাষ্ট্রপতির সংলাপকে বানচাল করতে চাচ্ছে। আর পাঁচ বছর পর পর যেন ইসি গঠন করতে গিয়ে বিব্রত হতে না হয়, সে কারণেই তারা দলের পক্ষ থেকে এই আইন প্রণয়নে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা প্রত্যাশা করছেন। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে শুরু হওয়া ধারাবাহিক সংলাপের দ্বিতীয় পর্যায়ে বঙ্গভবনে জাসদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে এক ঘণ্টারও বেশি সময় আলোচনা করেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। বৈঠকে জাসদের পক্ষ থেকে ভবিষ্যতে নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যাপারে নতুন আইন করার প্রস্তাব দেন রাষ্ট্রপতির কাছে। তবে দলের পক্ষ থেকে তারা সার্চ কমিটি গঠনে কোন নাম প্রস্তাব করেনি।
এর আগে বিকেল চারটা থেকে এক ঘণ্টার বেশি সময় তারা বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপ করেন। সাত সদস্যের জাসদের প্রতিনিধি দলে আরও উপস্থিত ছিলেন দলটির সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার এমপি, কার্যকরী সভাপতি এডভোকেট রবিউল আলম, সহ-সভাপতি মীর হোসাইন আক্তার, স্থায়ী কমিটির সদস্য মোশারফ হোসেন, এডভোকেট শাহ জিকরুল আহমেদ এবং রেজাউল করিম তানসেন।
এর আগে সংলাপের প্রথম দিন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়ে সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির ইসি গঠনে আইন প্রণয়নসহ তিন দফা প্রস্তাবনা দেন। সংলাপে অংশ নেয়া এ দু’দলের প্রতিনিধিরাই কোভিড টেস্টের নেগেটিভ রেজাল্ট নিয়ে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে অংশগ্রহণ করেন।
সংলাপে রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব মোঃ জয়নাল আবেদীন জানান, রাষ্ট্রপতি একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য, শক্তিশালী ও কার্যকর নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে জাসদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন গঠনে কোন নির্দিষ্ট আইন নেই। সেহেতু রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনে ভূমিকা রাখবে বলে তিনি আশা করেন। রাষ্ট্রপ্রধান দেশের সকল রাজনৈতিক দলগুলোর সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেন।
নির্বাচন কমিশন গঠন ইস্যুতে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপ শেষে হাসানুল হক ইনু দলের পক্ষ থেকে সংলাপে দেয়া প্রস্তাবনার বিষয়ে সাংবাদিকদের সামনে বিস্তারিত তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠনের সম্পূর্ণ এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির। তারপরেও উনি জাসদসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার যে সূত্রপাত করেছেন, তারজন্য রাষ্ট্রপতিকে আমরা সাধুবাদ জানিয়েছি। এই পদ্ধতিটা নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য অংশগ্রহণমূলক হবে এবং একটি গ্রহণযোগ্য ও দক্ষ নির্বাচন কমিশন উপহার দিতে রাষ্ট্রপতির সাহায্য হবে।
সাবেক এই তথ্যমন্ত্রী বলেন, সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী ইসি গঠনে আইনী কাঠামো না থাকার কারণে একটি অনুসন্ধান কমিটির মধ্য নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করার উদ্যোগটি তুলনামুলকভাবে ভাল উদ্যোগ। ভবিষ্যতের জন্য তারা আইন করার উদ্যোগ নিতে রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে প্রতি পাঁচ বছর পর পর বিব্রতকর অবস্থা হয়। তার থেকে স্থায়ী সমস্যার সমাধান করতে রাষ্ট্রপতি যেন ভূমিকা গ্রহণ করেন। ভবিষ্যতে একটি আইনী কাঠামো তৈরি করার জন্য উনি (রাষ্ট্রপতি) যেন সরকারকে উপযুক্ত পরামর্শ ও দিক-নির্দেশনা দেন।
আইন তো রাষ্ট্রপতি নন সংসদ করবে, তাহলে তাঁর কাছে কেন এই প্রস্তাব? এমন প্রশ্নের জবাবে হাসানুল হক ইনু বলেন, আইন সংসদই করবে। সরকারই করবেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি সংবিধানের রক্ষক। সংবিধানের নির্দেশনা বাস্তবায়নে রাষ্ট্রপতি ভূমিকা রাখতে পারেন। এজন্য সরকারকে পরামর্শ দিতে অনুরোধ করেছি। ১১৮ অনুচ্ছেদ বাস্তবায়নে যেন সরকার উদ্যোগ নেয়। এজন্য সব মহলকে বিব্রত হওয়ার থেকে রেহাই দেয়ার জন্য মহামান্য রাষ্ট্রপতি ভবিষ্যতের জন্য একটি আইনী কাঠামো তৈরি করতে উদ্যোগ নেবেন।
সার্চ কমিটি সাংবিধানিক সংস্থা থেকে হওয়া বাঞ্ছনীয় উল্লেখ করে জাসদ সভাপতি বলেন, আমরা আপীল বিভাগের বিচারপতি, অডিটর এ্যান্ড কম্প্রোটরাল জেনারেল এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রধানসহ সার্চ কমিটি গঠন করতে বলেছি। এজন্য আমরা কোন নাম প্রস্তাব সমীচীন মনে করিনি। একজন নারী এবং একজন অধ্যাপক পর্যায়ের দুজন সার্চ কমিটিতে থাকার কথা। সেক্ষেত্রেও আমরা নাম প্রস্তাব করিনি। আমরা মনে করি মহামান্য রাষ্ট্রপতি এই দুজন মনোনয়ন দেবেন। নাম প্রস্তাব করে আমরা এক্ষেত্রে ভারাক্রান্ত করতে চাই না।
সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত দুটি নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, তাদের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। একই প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশন কতটা গ্রহণযোগ্য হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে হাসানুল হক ইনু বলেন, গত কয়েকটি নির্বাচন কমিশন অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে হয়েছে। কখনও বিতর্ক দেখা দিয়েছে, কখনো বিতর্ক দেখা দেয়নি। আমরা সংলাপে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে যতদূর সম্ভব একটি দক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন করতে রাষ্ট্রপতির উদ্যোগকে সহযোগিতা করা বাঞ্ছনীয় মনে করেছি।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে জাসদ সভাপতি ইনু বলেন, মহামান্য রাষ্ট্রপতি বলেছেন উনি অবিলম্বে সার্চ কমিটি গঠন করবেন। সার্চ কমিটি নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যাপারে যদি কোন নাম চায় তাহলে সেখানে আপনারা সহযোগিতা করবেন। সার্চ কমিটি দুজন করে নাম দেবেন, তার থেকে উনি (রাষ্ট্রপতি) চূড়ান্ত করবেন। আমরা রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করেছি, আপনি যে দক্ষতার মানুষই দেন না কেন, তিনি যেন ‘ম্যান অব ইনট্রিগ্রিটি’ হয়। কোন পেশা থেকে এলেন বা কোন মতের লোক সেটা বড় কথা নয়। যদি সৎ, দক্ষ ও গ্রহণযোগ্য মানুষ হন- তবে সেই নির্বাচন কমিশন ভাল নির্বাচন উপহার দেবেন।
সংলাপে বিএনপি না গেলে নতুন ইসি গঠনের প্রচেষ্টা কী বিফল হবে? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে হাসানুল হক ইনু অভিযোগ করেন, রাষ্ট্রপতির উদ্যোগকে স্বাগত না জানিয়ে যারা নাকচ করে দিচ্ছেন, তারা সংলাপ প্রক্রিয়াটিকে বানচাল করতে চাচ্ছেন। বানচাল করার ঘটনাটি আমরা দেখেছি। যারা নির্বাচনই বানচাল করতে চান, তারা সংলাপও বানচাল করবে। বিএনপি ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে দুইবার নির্বাচন বানচাল করার চক্রান্ত করতে চেয়েছিল। তাই তারা আগামী নির্বাচনটিকে বানচাল করার চক্রান্তের অংশ হিসেবে সংলাপটি বানচাল করতে চাচ্ছেন, এটা দুঃখজনক।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে জাসদ সভাপতি বলেন, নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির সংলাপের উদ্যোগকে যারা (বিএনপি) নাটক বা প্রহসন বলছেন, তাদের উদ্দেশ্য এটাই বলব- সংলাপে গেলেই না বুঝবেন এটা প্রহসন না ভাল উদ্যোগ। সংলাপে না গিয়ে প্রহসন বা নাটক বলা বাঞ্ছনীয় নয়। আগে সংলাপে ঢোকেন তারপর এটা নাটক না অন্য কিছু সেটা বুঝবেন।
জাতীয় পার্টি ও জাসদ ছাড়াও আরও কয়েকটি দলের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সংলাপের সিডিউল হয়েছে। এদের মধ্যে ২৬ ডিসেম্বর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ, ২৭ ডিসেম্বর তরিকত ফেডারেশন ও খেলাফত মজলিস, ২৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, ২৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) ও ইসলামী ঐক্যজোটের সঙ্গে সংলাপ করবেন রাষ্ট্রপতি। অন্যান্য দলগুলোর সঙ্গে সিডিউল এখনও চূড়ান্ত হয়নি।