কাজিরবাজার ডেস্ক :
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদকে) অভিযুক্ত একাধিক কর্মকর্তাকে সচিব পদে পদোন্নতি দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। আসন্ন নির্বাচনে প্রশাসনকে বিশেষ কাজে ব্যবহারের লক্ষ্যে সুকৌশলে সরকার বিরোধীরা এই কার্যক্রম চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ। সুর্নিদিষ্ট কর্মকর্তাদের সচিব করতে নেতিবাচক দিক পরিহার করে সচিব পদে পদোন্নতি দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। সূত্র জানায়, সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডে সরকার পরিপন্থী আদর্শের কর্মকর্তা বেশি হওয়ায় তারা নানা কৌশলে এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে। সরকারের আমলাতন্ত্রের সদস্যদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে গোয়েন্দা রিপোর্টকে গুরুত্ব দেয়ার রেওয়াজ থাকলেও কোন কোন ক্ষেত্রে তা যথাযথভাবে মানা হচ্ছে না। এমনকি দুদকের কোন অভিযোগ থাকলে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। কিন্তু দুদকের অভিযোগ রয়েছে এমন একাধিক ব্যক্তিকে পদোন্নতি দেয়ার পাঁয়তারা চলছে বলে জানা গেছে। সূত্র জানায়, একটি পুরনো বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা এবং অপর একটি সরকারে সংস্থার প্রধানের বিরুদ্ধে দুদকের অভিযোগ রয়েছে। তাদের অভিযোগ আমলে না নিয়ে পদোন্নতির তালিকায় নাম রাখার চেষ্টা চলছে। এই বিভাগীয় কর্মকর্তা বর্তমানে হাইব্রিড আওয়ামী পন্থী কর্মকর্তা। অতীতে ছাত্রদল করলেও বর্তমানে তিনি অনেকের চেয়ে সরকারের বেশি আস্থাভাজন বনে গেছেন। আর আস্থাভাজন বনে গিয়ে তিনি সরকারের নিয়মনীতি উপেক্ষা করে চলেছেন। এমনিক অধীনস্তদের নিয়মনীতি উপেক্ষা করতেও চাপ সৃষ্টি করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ফয়েজ আহমেদ স্বাক্ষরিত রেজ্যুলেশনে বলা আছে, সরকারের যে সকল সম্পত্তি (বিশেষ করে সার্কিট হাউস, বিভাগীয় কমিশনারের বাংলো, ডিসির বাংলো ইত্যাদি) গণপূর্তের নামে জরিপে ভুলক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তা ১ নং খাস খতিয়ানভুক্ত করতে হবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশক্রমে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এই রেজ্যুলেশন জারি করে। তার প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট এডিসি রেভিনিউ ওই সম্পত্তি এক নং খাস খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত করেন।
অথচ ওই বিভাগীয় কমিশনার বিশেষ স্বার্থের লক্ষ্যে নিজেকে ভূমি বিশেষজ্ঞ আখ্যায়িত করে এসি ল্যান্ড ও এডিসি রেভিনিউকে ডেকে নিয়ে তা আগের অবস্থায় নেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
তিনি কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিকে প্রধান অতিথি করলে ডিসি বা অন্য কর্মকর্তাদের ওপর রুষ্ট হন। এসব কারণে ওই জেলার রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবী মহলে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে অনেক অপকর্মের রেকর্ড রয়েছে।
শুরু হয়েছে তদন্ত : ইতিপূর্বে ১১ ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে সচিব করার বিষয়টি প্রকাশিত হয়। এরপর প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে। শুরু হয়েছে তদন্ত। সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার পাশাপাশি বিভিন্ন পর্যায়ে তদন্ত চলছে। কোন কোন কর্মকর্তা এই সকল কাজে জড়িত, তাদের খুঁজে বের করতে ব্যাপক তদন্ত চলছে। এরই মধ্যে তারা দুদকের অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের সচিব করার কৌশল খুঁজছে। ইতিপূর্বে এই সকল কর্মকর্তার কারসাজিতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের সরকারবিরোধী আখ্যায়িত করে পদোন্নতি বঞ্চিত করা হচ্ছে। দেয়া হচ্ছেনা তাদের ভাল কোন পদে। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের আদরে কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানোর কার্যক্রম চলছে। সরকারের আদর্শের কোন কর্মকর্তাকে ভাল কোন পদে পদায়নের প্রস্তাব পাঠানো হলে তাকে সরকার পরিপন্থী আখ্যায়িত করে তা বাতিল করে দেয়া হচ্ছে। এতে মূলত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীরা দিন দিন সরকারের কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। বিরোধীরা চায় এভাবে সরকারের আদরে কর্মকর্তারা দূরে চলে যাক। যাতে মেয়াদের শেষ সময় সহজেই সরকারকে বেকায়দায় ফেলা যায়।
সম্প্রতি যুগ্ম সচিবে পদোন্নতি পেয়েছেন ২১৩ কর্মকর্তা। এর মধ্যে জামায়াত বিএনপি আখ্যায়িত করে মোট ৩৩ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তানকে পদোন্নতি বঞ্চিত করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারের ২২ কর্মকর্তা এবং ইকোনমিক ক্যাডারের ১১ কর্মকর্তা রয়েছেন। খোদ আওয়ামী লীগের শাসনামলেও সকল যোগ্যতা থাকার পরও পদোন্নতি পেলেন না মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও তাদের পরিবারের কর্মকর্তারা। অথচ জামায়াত-বিএনপি পন্থী কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এতে পদোন্নতি বঞ্চিত মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের কর্মকর্তাদের মধ্যে নেমে এসেছে চরম হতাশা।
বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের ব্যাচ ভেঙ্গে পদোন্নতি, নির্দিষ্ট সময়ে পদোন্নতি না দেয়া, ভারপ্রাপ্ত সচিবের পদ সৃষ্টি ও বিলুপ্তি, এক দিন চাকরি থাকলেও সচিব পদে পদোন্নতি, আবার পদোন্নতির সময় যে কর্মকর্তা কমপক্ষে দুই বছর সচিব পদে চাকরি করতে পারবেন তাদেরই পদোন্নতি দেয়ার সিদ্ধান্তসহ অসংখ্য অলিখিত নিয়মের কারণে জটিলতা বাড়ছে প্রশাসনে। এতে ক্ষুব্ধ হচ্ছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। মনগড়া নিয়ম বাদ দিয়ে আইন ও বিধি মেনে এসএসবিকে কাজ করার অনুরোধ জানিয়েছেন তারা। সংশ্নিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে যার সুবিধামতো সিদ্ধান্ত নিয়ে অন্যের অধিকার হরণ করা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। প্রশাসনের শীর্ষ এ কমিটিকে সরকারের আইন ও বিধি মেনে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোসলেহ উদ্দিন আহমদ বলেন, প্রশাসনিক গতিশীলতা এবং গুড গবর্ন্যান্সের জন্য হঠাৎ অস্থায়ী ভিত্তিতে রুলস- রেগুলেশনের বাইরে গিয়ে কিছু করা উচিত নয়। রুলস- রেগুলেশন অনুযায়ী চললে প্রশাসনে গতিশীলতা এবং যারা প্রশাসনের মধ্যে কাজ করেন তাদের মধ্যে স্পৃহা, ভবিষ্যতে কাজ করার দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। এর পরও মাঝেমধ্যে মনে হচ্ছে, কোন ব্যক্তিকে সামনে রেখে এসব অস্থায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। সেটা একটা সিভিল সার্ভিসের জন্য অদূর ভবিষ্যতে সুফল বয়ে আনবে না। সিভিল সার্ভিসে হতাশা দেখা দেবে। পুরো প্রশাসন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে। এ জন্য সরকারকেই বলিষ্ঠ ভূমিকা নিতে হবে। প্রশাসনকে গতিশীল করতে গেলে সঠিক রুল- রেগুলেশনের ভিত্তিতে কাজ করতে হবে। অস্থায়ী ভিত্তিতে করলে কখনও সুফল আসবে না।
জানা যায়, প্রশাসন ক্যাডারের ১১তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের এখন সচিব করা হচ্ছে। প্রথম ধাপে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পাওয়া ১৩তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের সচিব করা হবে ২০২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বরের পর। আর দ্বিতীয় ধাপে পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তারা সচিব হতে পারবেন ২০২৩ সালের ৭ সেপ্টেম্বরের পর থেকে। কারণ, ওইসব দিনে এই ব্যাচের কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত সচিব পদে কাজের দুই বছর পূর্ণ হবে, যা সচিব হওয়ার অন্যতম যোগ্যতা। তাই সচিব হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের আগেই বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা অবসরে চলে যাবেন। সম্প্রতি পদোন্নতি পাওয়া ৮৯ অতিরিক্তি সচিবের মধ্যে ২০২২ সালেই প্রায় অর্ধশত কর্মকর্তা অবসরে যাবেন। এদিকে ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের ২০২২ সালে পিআরএল শুরু হচ্ছে, কিন্তু অতিরিক্তি সচিব পদোন্নতির কার্যক্রম এখনও শুরু হয়নি। বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নির্দিষ্ট সময়ে পদোন্নতি না হওয়ায় অতিরিক্ত সচিবের পদগুলোতে পদায়ন এবং গ্রেড-১ ও সচিব পদে পদোন্নতিতে বড় সঙ্কট তেরি হতে পারে।