কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইন নিজের হাতে তুলে না নিয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে লেখাপড়ায় মন দেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, রাস্তায় নেমে যানবাহন ভাংচুর করা এটা ছাত্রদের কাজ নয়। এটা কেউ করবেন না। কেউ নিজের হাতে আইন তুলে নেবেন না। দয়া করে যার যার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে যান, লেখাপড়া করেন। যারা দোষী তাদের খুঁজে বের করে অবশ্যই শাস্তি দেয়া হবে, সেটা আমরা করব।
বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর মাসের প্রথম দিনে বুধবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি প্রাঙ্গণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল উদ্বোধন এবং রাজধানীর ধানম-িতে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ১২ তলা বিশিষ্ট অত্যাধুনিক ‘জয়িতা টাওয়ার’ নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সড়কে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে যারা গাড়ি ভাংচুর কিংবা অগ্নিসংযোগ করে তাদেরও খুঁজে বের করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ করে সরকারপ্রধান বলেন, একটি গাড়িতে এক্সিডেন্ট হয়ে একটা মানুষ মারা গেল বলে আরও ১৫টি গাড়ি ভাঙ্গা এবং সেখানে আগুন দেয়া, সেই ভাংচুর ও আগুন দেয়ার ফলে ওই গাড়িতে থাকা যাত্রী, ড্রাইভার, যারা আহত হয় অথবা নিহত হয় সেই দায়িত্বটা কারা নেবে? ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে নিজেদের (শিক্ষার্থী) প্রস্তুত করতে হবে। রাস্তায় নেমে গাড়ি ভাংচুর করা ছাত্রদের কাজ না। এটা কেউ করবেন না দয়া করে। দয়া করে যার যার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে যান, লেখাপড়া করেন। আর যারা দোষী তাদের খুঁজে বের করে অবশ্যই শাস্তি দেয়া হবে, অবশ্যই সেটা আমরা করব।
মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত মূল অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারী বাসভবন গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করেন। মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন্নেসা ইন্দিরার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ সায়েদুল ইসলাম বক্তৃতা করেন। বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারপার্সন লাকী ইনাম এবং জয়িতা ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফরোজা খানও বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে জাতির পিতার ম্যুরাল এবং ‘জয়িতা টাওয়ার’-এর ওপর দুটি ভিডিও চিত্রও পরিবেশিত হয়।
সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থী মারা যাওয়ার ঘটনায় সমবেদনা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ছাত্রছাত্রীদের বলব যে, এখানে ছাত্ররা মারা গেছে, সেটা অত্যন্ত দুঃখজনক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ ব্যাপারে অনেক সতর্ক। সঙ্গে সঙ্গেই অপরাধীদের খুঁজে বের করা হয়েছে। তাছাড়া সবকিছুর ভিডিও ফুটেজও রয়েছে। যে কোন সময় যে কোন অপরাধ যে করবে তাদের ধরে ফেলা খুব একটা কঠিন হচ্ছে না। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করেই সেটা করা হচ্ছে।
শেখ হাসিনা সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ভবিষ্যতে এই গাড়ি ভাংচুর এবং আগুন দেয়ার ঘটনা যারা ঘটাবে তাদের খুঁজে বের করা হবে, শাস্তি দেয়া হবে। কেননা যে গাড়িতে আগুন দেয়া হচ্ছে, সে গাড়িতে যদি কেউ মারা যায় বা আগুনে পোড়ে তার জন্য কঠোর শাস্তি দেয়া হবেÑ এ কথাও মাথায় রাখতে হবে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ময়লার গাড়িতে পরপর পথচারী নিহত হবার ঘটনা যথাযথভাবে তদন্ত করে দেখারও নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।
গাড়িতে অগ্নিসংযোগের নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, আমার এখানে একটা প্রশ্ন, এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সমগ্র জাতির কাছে প্রশ্ন করছি এই যে, আগুন দেয়া শুরু হলো, তো ওই গাড়িতে কি যাত্রী নেই? শিশু নেই? ওখানে কি ছাত্রছাত্রী নেই? ওই আগুনে যারা পুড়বে, আহত হবে বা মারাও যেতে পারে তার দায়িত্বটা কে নেবে? সে দায়িত্বটা কে নেবে? খুব স্বাভাবিকভাবে সেই দায়িত্বটা যারা ভাংচুর করছে তাদের ওপর বর্তায়। তাহলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সে ব্যাপারেও ব্যবস্থা নিতে হবে। যদি আহত হয় বা নিহত হয় সেই দায়-দায়িত্বটাও তাদের নিতে হবে। একটা এক্সিডেন্ট হয়ে একটা মানুষ মারা গেছে, তাকে বাঁচানোর চেষ্টা না করে, তার সেবা না করে লাঠিসোটা নিয়ে নেমে পড়ল বাকি গাড়ি ভাঙ্গা এবং আগুন দিতে!
সবাইকে ট্রাফিক আইন মেনে চলার আহ্বান জানিয়ে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেন, রাস্তাঘাট চলার সময় সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। ট্রাফিক রুলস মেনে চলতে হবে। রাস্তায় যে কোন জায়গা থেকে, যেখান-সেখান থেকে রাস্তা পার হতে গেলে দুর্ঘটনা হবেই। কারণ একটা চলমান গাড়ি চট করে ব্রেক করতে পারে না। ব্রেকটা কষতে সময় লাগে। রাস্তা পারপারের জায়গা নির্দিষ্ট করা আছে। এই পারাপার করার জায়গা নির্দিষ্ট করা, সেখান থেকেই রাস্তা পার হওয়া সমীচীন। ওই হঠাৎ করে দৌড় দেবে, আর তারপর এক্সিডেন্ট হবে। একটা গাড়িতে দুর্ঘটনা ঘটে একজন মারা গেল বলে সেখানে আরও ২৫টি গাড়ি ভাঙ্গা এবং আগুন দেয়া এটা কোন ধরনের কথা। তাই আমি বলব কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। আর গাড়ি চালকদেরও আমি বলব, তাদের সতর্কতার সঙ্গে গাড়ি চালাতে হবে।
আজকের শিশুরাই হবে ’৪১-এর উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের কর্ণধার উল্লেখ করে করে প্রধানমন্ত্রী তাদের লেখাপড়া করা এবং বাবা-মা-অভিভাবকদের আদেশ মান্য করার পরামর্শ দেন শিক্ষার্থীদের। তিনি বলেন, বেশি দূরে নয়, মাত্র ১০/১২ বা ১৪ বছর আগের বাংলাদেশ আর এখন বাংলাদেশের অনেক তফাৎ। এখনকার বাংলাদেশে আমাদের ছেয়েমেয়েরা যেটা দেখছে আগে সেরকম ছিল না। এটাও তাদের মাথায় রাখতে উচিত। তাদের ভবিষ্যতে বাংলাদেশটাকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে।
সিটি কর্পোরেশনের গাড়ির নিচে চাপা পড়ে শিক্ষার্থী মারা যাওয়ার ঘটনায় দায়ীদের খুঁজে বের করার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সিটি কর্পোরেশনের গাড়িতে এটা আমি রহস্যই বুঝলাম না। দক্ষিণে মারা গেল, এরপর আবার উত্তরে মারা গেল। এর কারণটা কী এবং কেন? এর কারণ খুঁজে বের করতে হবে, এর জন্য কারা দায়ী। তিনি বলেন, তখন ময়লার গাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল, ময়লার গাড়ির সামনে দিয়ে কেউ হেঁটে যাবেন কেন? সেটাও বিবেচনা করতে হবে। আর গাড়ি যে চালাচ্ছিল, ময়লার গাড়ি চালানোর মতো দক্ষতা তার আছে কিনা? সেটাও বিবেচনা করতে হবে। উভয় দিকে দায়িত্বশীলতা, কার কতটুকু আছে সেটাও দেখতে হবে। জনবহুল এই দেশে গাড়ি চালানোর জন্য এ সময় সঠিকভাবে প্রশিক্ষণের ওপরও গুরুত্বারোপ করেন তিনি বলেন, তাঁর সরকার উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রেখেছে।
দেশে করোনার বিস্তার বাড়লে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আবারও বন্ধ করার মতো পরিস্থিতি আসতে পারে উল্লেখ করে বিষয়টি মাথায় রেখে শিক্ষার্থীদের সময়কে কাজে লাগানোর এবং আগামীতে নিজেদের গড়ে তুলে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য কাজ করার পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘মনে রাখতে হবে যে, এই করোনাভাইরাস কিন্তু এখনও শেষ হয়ে যায়নি। আমরা ভ্যাকসিন দেয়া শুরু করেছি, এখন শিক্ষার্থীদেরও দিচ্ছি। বর্তমানে আবার নতুন আরেকটা ঢেউ আসছে। কাজেই এটা মাথায় রাখতে হবে যদি করোনা বিস্তার লাভ করে তা হলে যে কোন সময় আবার কিন্তু সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। তাই শিক্ষার্থীদের আমি আরেকটা কথা বলব, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন করোনার জন্য বন্ধ ছিল। এখন সমস্ত স্কুল-কলেজ খুলে গেছে। সবাইকে এখন পড়াশোনা করতে হবে। যার যার স্কুলে ফিরে যেতে হবে।’
এই দেশকে গড়ে তুলতে এবং তৃণমূল পর্যায়ের জনগণকে উন্নয়নে সারথি করতে গিয়ে সমগ্র দেশ তাঁর চষে বেড়ানো এবং ছাত্রাবস্থার সময় গণপরিবহনে যাতায়াতের স্মৃতি রোমন্থন করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের জীবনে আমি যেমন গাড়িতে চড়েছি, বাসেও চড়েছি। শুধু বাস কেন আমি রিক্সায়, ভ্যানে, নৌকায় সব বাহনে চড়েছি। সাম্পানে চড়ে, মাছের ট্রলারে চড়ে সাগর পাড়ি দিয়েছি। আমি মাইলের পর মাইল কাঁদামাটি ভেঙ্গে হেঁটেছি, ধান খেতের আইল বেয়ে হেঁটেছি।
বাংলাদেশকে আমি না চিনতে পারলে এত দ্রুত বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি লাভ করতে পারত না উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি বাংলাদেশটাকে চেনার এবং দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশের এমন কোন অঞ্চল নাই আমি না ঘুরে বেড়িয়েছি। তখন সব ধরনের যানবাহনেই চড়েছি। ’৮১ সালে বাংলাদেশে আসার পর যখন কোথাও যেতাম তখন এই বাস ভাড়া করেই যেতাম। আবার যখন স্কুলে পড়তাম, বাসে করেই যেতাম। এমন কোন যান নেই যাতে চড়িনি। এভাবেই বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়িয়ে আজকে প্রধানমন্ত্রী হবার পর দেশের উন্নতি করতে সমর্থ হয়েছি। আমি বাংলাদেশকে না চিনতে পারলে এত দ্রুত বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি লাভ করতে পারত না।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর সরকারের প্রথম মেয়াদে (১৯৯৬-২০০১) এবং ২০০৯ সাল থেকে এই সময় পর্যন্ত শিশু ও নারীদের উন্নয়নে যেসব উদ্যোগ নিয়েছেন তাও সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরেন। নিজেদের অধিকার আদায়ে নারীদের স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে ওঠার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, আমাদের নারীরা যেন সব সময় এটা মনে রাখেন যে, অধিকার অধিকার করে চিৎকার করলে অধিকার কেউ দিয়ে দেবে না। অধিকার আদায় করে নিতে হবে। নিজেদের কাজ নিজেরা করতে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।
সরকারপ্রধান বলেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের যে মর্যাদা পেয়েছে তা গর্ব করে বলা যায়। আজকে আন্তর্জাতিকভাবেও আমাদের এটা স্বীকৃত যে, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলেছে টানা সপ্তমবারের মতো জেন্ডার সমতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে। শিশুদের ভবিষ্যত জীবন যেন সুন্দর হয় তার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।