কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারী ধর্ষণকে বিশ্বব্যাপী সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে তা প্রতিরোধে ভুক্তভোগী নারীর পাশে পুরুষ সমাজকেও সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, নারী ধর্ষণ শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী একটি সমস্যা। ধর্ষণ প্রতিরোধে পুরুষদেরও এগিয়ে আসতে হবে। কারণ এই নারী ধর্ষণকারী তো পুরুষরাই। কাজেই পুরুষ সমাজের পক্ষ থেকে আমরা চাই যে তাদেরকেও সোচ্চার হতে হবে।
রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে রবিবার আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধনী পর্বে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী নারীদের ওপর পাশবিক অত্যাচার যারা করে তাদের ‘পশুরও অধম’ আখ্যা দিয়ে বলেন, যারা নারীদের ওপর এ ধরনের পাশবিক অত্যাচার করে, তারা সমাজে সব থেকে জঘন্য। তাদের মানুষ বলতে ইচ্ছে করে না, বলতে ইচ্ছে করে এরা পশুর চেয়েও অধম। এদের বিরুদ্ধে পুরুষ সমাজকেও ব্যবস্থা নিতে হবে। নারীরা সব সময় নানা ধরনের যন্ত্রণার শিকার হয়, সেটা আমরা দেখেছি। সেটা মোকাবেলা করার জন্য আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপও নিয়েছি। আমরা সেভাবে বিভিন্ন আইনও করেছি। আইনগতভাবে আমরা বিভিন্ন শাস্তিরও ব্যবস্থা করেছি। তিনি বলেন, নারীরা যত শিক্ষিত হবে সমাজ তত দ্রুত এগোবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, অর্ধেক অংশকে অকেজো রেখে সমাজ সঠিকভাবে চলতে পারে না।
করোনাভাইরাস প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকারের যথেষ্ট সক্ষমতা আছে। ঘাবড়ানোর কিছু নেই। তিনি বলেন, আরেকটি সমস্যা এখন বিশ্বব্যাপী, করোনাভাইরাস। আমরা কিন্তু সারাক্ষণ মনিটর করছি। কোথাও যদি কোন সমস্যা দেখা দেয় যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছি। প্রত্যেকে যদি এ ব্যাপারে একটু সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারেন এবং সেভাবে মেনে চলতে পারেন ইনশাআল্লাহ এ ধরনের সমস্যা মোকাবেলা করতে আমাদের যথেষ্ট সক্ষমতা রয়েছে। আমরা তা পারব। কাজেই এখানে ঘাবড়ানোর কিছু নেই।
করোনাভাইরাস নিজেকে মুক্ত রাখতে সবাইকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেয়া নির্দেশনাগুলো মেনে চলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে আমি বলব সবাইকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে। এছাড়া প্রতিদিনই আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে কীভাবে চলতে হবে, কীভাবে কাজ করতে হবে। স্বাস্থ্য সুরক্ষার নির্দেশনাগুলো সবাইকে মেনে চলার অনুরোধ জানাচ্ছি। করোনাভাইরাসের কারণে বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই করোনাভাইরাসের কারণে অনেক দেশ এখন অর্থনৈতিকভাবেও সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।
নারীদের স্বাবলম্বী হওয়ার ওপর জোর দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, সমাজের অর্ধেক অংশই হচ্ছে নারী। সমাজের এই অর্ধেক অংশকে একেবারে অকেজো রেখে দিয়ে একটি সমাজ সঠিকভাবে চলতে পারে না, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলবে। একটা কথা আমরা বিশ্বাস করি, নারীরা যত শিক্ষিত হবে, নারীরা যত স্বাবলম্বী হবে, সেই সমাজ তত দ্রুত এগিয়ে যেতে পারবে। নারী দিবসে বাংলার নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎকে স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা আজকে নারীরা লেখাপড়া শিখেছি, নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখেছি। কিন্তু আমাদের যিনি এই পথ দেখিয়েছিলেন সেই বেগম রোকেয়ার কথা স্মরণ করি। কারণ তিনি আমাদেরকে শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করে না দিলে হয়ত নারী সমাজ এই সুবিধাটা পেত না।
‘প্রজন্ম হোক সমতার, সকল নারীর অধিকার’ শীর্ষক এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য নিয়ে সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে ইউএন উইমেনের এদেশীয় প্রতিনিধি এবং ভারপ্রাপ্ত আবাসিক সমন্বয়ক শোকো ইশিকাওয়া অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী রওশন আক্তার। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ‘জয়িতা পদকে’ ভূষিত সফল পাঁচ নারীর হাতে সম্মাননা পদক তুলে দেন। পদকপ্রাপ্তরা হলেন- আনোয়ারা বেগম, ডাঃ সুপর্ণা দে সিম্পু, মরহুম মমতাজ বেগম, আরনিকা মেহেরিন ঋতু এবং সিআরপির প্রতিষ্ঠাতা ভ্যালোরি এ্যান টেইলর। অনুষ্ঠানে ‘বঙ্গবন্ধু ও নারী উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রামাণ্য চিত্র পরিবেশিত হয়। পরে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও উপভোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, সরকারের পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ, বিদেশী কূটনীতিক, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধি, বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থার প্রধানসহ বিভিন্ন নারী নেতৃবৃন্দ এবং আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
পরিবার ও সমাজের জন্য নিজের বাবার পাশে থেকে মায়ের (বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব) অনুপ্রেরণামূলক অবদানের কথা নারী দিবসের অনুষ্ঠানে বিশেষভাবে স্মরণ করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ১৯৪৮ সালে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে চাপিয়ে দেয়ার মাধ্যমে ভাষার অধিকার কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করা হয় তখন এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করেছিলেন তৎকালীন আইনের ছাত্র শেখ মুজিবুর রহমান।
তিনি বলেন, আমার বাবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার দুঃখী মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন। সেই সংগ্রামের পথ বেয়ে কিন্তু ধাপে ধাপে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আর এই দীর্ঘ সংগ্রামে সব সময় বঙ্গবন্ধুর পাশে ছিলেন আমার মা। সাধারণ নারীর মতো তিনি কখনও স্বামীর কাছে শাড়ি, গহনা বা কোন কিছুই দাবি করেননি বা সংসার চালানোর ঝামেলাও তাঁকে দেননি। বরং পাশে থেকে প্রেরণা যুগিয়েছেন, শক্তি যুগিয়েছেন, উৎসাহিত করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের চালানো পাশবিক অত্যাচারের কথাও এ সময় তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর জাতির পিতা পাশবিক অত্যাচারের শিকার ওসব নারীর জন্য নারী পুনর্বাসন বোর্ড গঠন করে তাদের চিকিৎসার জন্য সুইজারল্যান্ড, ইংল্যান্ড, জার্মানি থেকে ডাক্তার, নার্স নিয়ে আসেন। তাদেরকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধিতে ভূষিত করে সম্মাননা দেন।
নিপীড়িত অনেক নারীকে তাঁদের বাবা-মা তখন সামাজিক কারণে ঘরে ফিরিয়ে নিতে চাননি উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, যখন তাদের (বীরাঙ্গনা) বিষয়ে ব্যবস্থা করা হলো, তখন আমার মা নিজে উপস্থিত থেকে অনেকের বিয়ে দিয়েছিলেন। তখন প্রশ্ন উঠেছিল, বিয়ের কাবিননামায় বাবার পরিচয়টা কী লিখবে? তখন জাতির পিতা বলে দিয়েছিলেন- ‘লিখে দে, পিতার নাম শেখ মুজিবুর রহমান, ধানম-ি ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়ি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির ক্রান্তিলগ্নে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমার মা অত্যন্ত সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যার ফলে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। তিনি যদি এভাবে সংসার, নিজের সংগঠনের এই দায়িত্ব না নিতেন, সেই সঙ্গে আমরা যারা ছেলেমেয়েরা ছিলাম আমাদেরকে মানুষ করার দায়িত্ব না নিতেন- তাহলে আমার বাবা (বঙ্গবন্ধু) নিশ্চিন্ত মনে দেশের সেবায় আত্মনিয়োগ করতে পারতেন না। এখানেই ছিল তাঁর বিশাল মাহাত্ম্য।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় নারীর উন্নয়নে তাঁর সরকারের নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগ ও ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে বলেন, তাঁর সরকার প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়ে প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেশের নারী সমাজ তাদের দক্ষতার প্রমাণ রাখতে সক্ষম হচ্ছেন। আমরা প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছি, যাতে তারা এগিয়ে যেতে পারে। কাজেই তারা যেখানেই যাচ্ছে তাদের দক্ষতা দেখাচ্ছেন।
তিনি বলেন, আমাদের দেশের মেয়েরা ভারত্তোলন থেকে শুরু করে এভারেস্ট পর্যন্ত বিজয় করে ফেলেছে। খেলাধুলায় আমাদের যেসব মেয়ে ভাল করছে তাদেরকে আমরা উৎসাহ দিচ্ছি এবং সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে যাচ্ছি। মেয়েরা যে পারে সেটা আজ প্রমাণিত। তিনি বলেন, আমাদের হাইকোর্ট এবং সুপ্রীমকোর্টে বিচারপতি পদে কখনও কোন মেয়ে পদোন্নতি পায়নি। তবে, প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পরই সে সময়কার রাষ্ট্রপতিকে বলেছিলাম, এখানে মহিলা বিচারপতি নিয়োগ দিতে হবে এবং সেই থেকেই শুরু আর এখন অনেক মহিলা বিচারপতি আছেন।