কাজিরবাজার ডেস্ক :
রাজধানী ঢাকায় এখন ভয়ঙ্কর আতঙ্কের নাম ভুয়া র্যাব, পুলিশ, ডিবি অপরাধী চক্র। অবিকল র্যাব-ডিবি ও পুলিশ। কিন্তু তারা ভুয়া। পেশাদার অপরাধী চক্র। র্যাব-পুলিশ ও ডিবির পোশাক পরিহিত। দেখলে সহজে বুঝার উপায় নেই, তারা দুর্বৃত্ত। মনে হবে, সত্যিকার র্যাব, পুলিশ বা ডিবি। প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাসে ঘুরে বেড়ায়। হাতে ওয়াকিটকি। হ্যান্ডকাফ পরিয়ে তুলে নেয়। টার্গেট করে টাকাওয়ালা, বিদেশ ফেরত প্রবাসী গাড়ির লক ভেঙ্গে চুরির পর নম্বর প্লেট পরিবর্তন করে গুরুতর অপরাধ সংঘটিত করছে এ ধরনের অপরাধীরা। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে এ ধরনের প্রায় এক ডজন অপরাধী গ্রেফতার করে তাদের কাছ থেকে প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, র্যাব-পুলিশের পোশাক, হ্যান্ডকাফ, ওয়াকিটকি উদ্ধার করেছে পুলিশ।
বিশ্বে নিরাপদ শহরের তালিকায় অনেকটাই তলানির দিকে ঢাকার অবস্থান। বিশ্বের ৬০টি শহরের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। ওই সূচক অনুযায়ী ৬০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ৫৪তম। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ঢাকার নিচে রয়েছে শুধু পাকিস্তানের করাচি। ডিজিটাল নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, অবকাঠামো, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও পরিবেশগত নিরাপত্তা বিবেচনা করে এ সূচক নির্ধারণ করা হয়েছে। নিরাপদ শহরের তালিকায় ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য নগর নিয়ে আসতে ব্যক্তি নিরাপত্তাসহ যাবতীয় সেবা নিশ্চিত করা না গেলে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ, উন্নত জীবন যাত্রা কোনটারই সুফল পাওয়া যাবে না বলে মনে করেন অপরাধ বিশেষজ্ঞগণ।
পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, রাজধানীর দুই কোটি জনঅধ্যুষিত মেগাসিটি পরিচিত ঢাকায় বসবাসের জন্য প্রয়োজনীয় নিরবচ্ছিন্ন নিরাপত্তা ব্যবস্থায় আঘাত হেনেছে ভুয়া র্যাব, পুলিশ, ডিবি চক্র। রাজধানী ঢাকার জনাকীর্ণ স্থানে প্রায় প্রতিদিনই সংঘটিত হচ্ছে ছিনতাই, ডাকাতি, চুরির মতো অপরাধ। অপরাধীরা সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত নিরিবিল সড়ক, ফ্লাইওভার, লঞ্চ ও বাস টার্মিনাল, পার্ক, বিপণি বিতানের আশপাশের এলাকায় অভয়ারণ্যের মতো অপরাধ করে বেড়ায়। এসব অপরাধী এতটাই বেপরোয়া যে, অপরাধ সংঘটিত করার সময়ে বাধাপ্রাপ্ত হলে খুন করতেও দ্বিধা করে না। তবে চুরি-ছিনতাই-ডাকাতি আগের চেয়ে অনেক কমেছে। শহরজুড়ে সিসিটিভি ক্যামেরা থাকায় এসব অপরাধ অতীতের চেয়ে কমেছে এবং অপরাধীও ধরা পড়ছে। অভিযোগ কিংবা খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৮ মাসে রাজধানীর ৫০টি থানায় চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি সংক্রান্ত মোট মামলা হয়েছে ২ হাজার ২৯১টি। গত ৩ বছরে রাজধানীতে ছিনতাই হয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। এসব ছিনতাইয়ের ঘটনায় প্রাণ গেছে কয়েকজনের, আহতও হয়েছেন অনেকে। ২০২০ সালে ছিনতাইয়ের দ্রুত বিচার আইনে মামলা হয় ৮৭১টি। আগের বছর ২০১৯ সালে এ মামলার সংখ্যা ছিল ৫৩১টি। এ হিসাবে ২০১৯ সালের তুলনায় পরের বছর ছিনতাই মামলা বেড়েছে ৩৪০টি। সংশ্লিষ্টদের মতে, ছিনতাইয়ের ঘটনা মামলার হিসাবের চেয়ে বেশি, যার কিছু গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। এছাড়া বহু ঘটনা নীরবে হজম করেছেন ভুক্তভোগীরা।
ভয়ঙ্কর আতঙ্কের নাম ভুয়া র্যাব-পুলিশ : ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের টাকা তোলা ব্যক্তিদের টার্গেট করে রাজধানী ঢাকায় সক্রিয় ভুয়া র্যাব-পুলিশ অপরাধী চক্র। এই চক্রের লোকেরা প্রথমে টার্গেটকে অনুসরণ শুরু করে। পথে সুবিধাজনক স্থানে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে টার্গেটকে নিজেদের গাড়িতে তুলে নেয়। শেষ ধাপে মারধর করে কেড়ে নেয়া হয় টাকা। এমন এক চক্রের ৯ সদস্যকে গত ২৬ অক্টোবর রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও মতিঝিল এলাকা থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে একটি ওয়াকিটকি, একটি পিস্তল, এক জেড়া হাতকড়া, ট্রাভেল ব্যাগ, দুটি জ্যাকেট, চারটি নতুন গামছা, একটি প্রাইভেটকার, একটি মাইক্রোবাস ও পাঁচ হাজার পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়।
অভিযানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ডিবি কর্মকর্তা জানান, রাজধানী ঢাকা ও আশপাশ এলাকায় ভুয়া র্যাব ও ভুয়া ডিবি পরিচয় দিয়ে ব্যাংকে টাকা জমা দিতে যাওয়া অথবা ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলনকারী ব্যক্তিদের জোরপূর্বক মাইক্রোবাসে তুলে নিচ্ছিল চক্রটি। এরপর তাদের কাছ থেকে নগদ টাকা ও তাদের ডেবিট, ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে টাকা উত্তোলন করে হাতিয়ে নেয় এই অপরাধী চক্রের সদস্যরা। গত ১৬ অক্টোবর রাতে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকা থেকে ডাকাত চক্রের ৩ জনকে গ্রেফতার করে ডিবি।
টার্গেট বিদেশ ফেরত প্রবাসীরা : দীর্ঘ পাঁচ বছর পর গত ৭ সেপ্টেম্বর মিসর থেকে দেশে আসেন লিটন সরকার। ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলেন তিনি। এ সময় কয়েকজন দুর্বৃত্ত ধারালো চাকুর ভয় দেখিয়ে তার সঙ্গে থাকা হ্যান্ডব্যাগ ও লাগেজ ছিনিয়ে নিয়ে যায়। হ্যান্ডব্যাগ ও লাগেজে ছিল পাসপোর্ট, মিসরের ভিসা, ফ্লাইটের টিকিট, স্বর্ণের চেন, দুটি মোবাইল সেট, একটি স্মার্টকার্ড ও নগদ ৪০ হাজার টাকা। পরে ওই চক্রের সদস্যরা লিটন সরকারকে ঘটনাস্থল থেকে একটি বাসে তুলে এ বিষয়ে কাউকে না জানানোর জন্য ভয়ভীতি ও হুমকি দিতে থাকে। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বিমানবন্দর থানায় একটি মামলা করেন লিটন সরকার। মামলার তদন্ত শুরু করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উত্তর বিভাগ। এরপর গত ১৬ অক্টোবর রাতে রাজধানীর হাতিরঝিল থানাধীন মীরবাগ এলাকা থেকে ডাকাত চক্রের ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, এই অপরাধী চক্রের টার্গেট বিদেশ ফেরত প্রবাসীরা।
লক ভেঙ্গে গাড়ি চুরির পর নম্বর প্লেট পরিবর্তন : মুহূর্তেই চোখের পলকে যে কোন গাড়ির লক ভাঙ্গা কিংবা বিকল্প চাবি ব্যবহার করে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চুরি করতে পারদর্শী অপরাধী চক্র। এমনকি গাড়ি শনাক্তের জিপিএস ট্র্যাকিং ডিভাইসও বিকল করে গাড়ি নিয়ে পালাত তারা। এরপর গাড়ির মালিককে ফোন করে অর্থ হাতিয়ে নিতো অথবা গাড়িটি বিক্রি করে দিত তারা। গত ১১ আগষ্ট এমন একটি গাড়ি চোর চক্রের ৫ সদস্যকে গ্রেফতার করে র্যাব। র্যাব জানায়, গত ৩ বছরে এ চক্রের সদস্যরা শতাধিক গাড়ি চুরি করেছে। গ্রেফতার এড়াতে চক্রটি বাটন মোবাইল ব্যবহার করত। এছাড়া একটি মোবাইল তারা পাঁচদিনের বেশি ব্যবহার করত না এবং রাতে ঘুমানোর সময় তাদের কাছ থেকে মোবাইলগুলো এক কিলোমিটার দূরে রেখে ঘুমাতেন। গত ১১ আগস্ট গাড়ি চোর চক্রের ৫ সদস্যকে গ্রেফতার করে র্যাব।
ছিনতাইয়ে বাধা দিলেই খুন : মাসিক ১১ হাজার টাকা বেতনে ঢাকার আশুলিয়ার শিমুলতলার দি ভাই ভাই ফার্নিচারে কাজ করতেন রমজান মিয়া (১৯)। গত ১ সেপ্টেম্বর রাতে কাজ শেষে ওই এলাকার মোল্লা বাজারের ভাড়া বাসায় ফিরছিলেন তিনি। পথে পলমল গার্মেন্টসের সামনে পৌঁছালে তার কাছে থাকা মোবাইল ও নগদ টাকা ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে ছিনতাইকারীরা। রমজান মিয়া কষ্টার্জিত টাকায় কেনা মোবাইল ও টাকা না দিলে ছিনতাইকারীরা ধারালো ছুরি দিয়ে তার বুকে ও পেটে জখম করে এবং সরু রড দিয়ে গলায় আঘাত করে। পরে মৃত্যু নিশ্চিত করে তাকে সেখানে ফেলে পালিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। গত ১৮ অক্টোবর এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ৩ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
সিআইডির তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, গ্রেফতার হওয়া ৩ জন ওই এলাকাসহ আশপাশ এলাকায় গভীর রাত থেকে ভোর পর্যন্ত রাস্তায় চলাচলকারী পথচারীদের টার্গেট করে তাদের গতিরোধ করে ছিনতাই করত। কেউ তাদের ছিনতাই কাজে বাধা দিলে ধারালো ছুরি, লোহার রড দিয়ে আঘাত করে পালিয়ে যেত। এতে জখম ব্যক্তির প্রাণহানিও ঘটত।
ভাসমান মাদকাসক্ত : ডিএমপির পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, রাজধানীতে ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত ভাসমান মাদকাসক্ত। যখন তাদের কাছে মাদক কেনার টাকা থাকে না তখনই তারা মোবাইল ছিনিয়ে নিচ্ছে ও পকেট থেকে টান মেরে টাকা ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। তাদের প্রতিরোধে পুলিশের ক্রাইম বিভাগের পেট্রোল টিম ও ডিবির ছিনতাই প্রতিরোধ টিম রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে দায়িত্ব পালন করে। সেসব পয়েন্ট থেকে নিয়মিত এসব অপরাধীকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। প্রতিদিনই কিছু না কিছু ছিনতাইকারী গ্রেফতার হচ্ছে। গ্রেফতার হওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। এ ধরনের চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই যেন না বাড়ে তার জন্য কঠোর নির্দেশনা আছে।
ডিএমপির একজন কর্মকর্তা বলেছেন, রাজধানী থেকে চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই নির্মূল করার জন্য ঢাকা মহানগর পুলিশের আটটি ক্রাইম ডিভিশন ও ডিবির আটটি ডিভিশন যৌথভাবে কাজ করছে। এসব ডিভিশনকে ডিএমপি কমিশনার কড়াভাবে নির্দেশ দিয়েছেন, যেন রাজধানী থেকে চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই নির্মূল হয়ে যায়।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, রাজধানী ঢাকায় ক্রমেই বাড়ছে অপরাধের ঘটনার মামলা। পাল্টে যাচ্ছে অপরাধের ধরন। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ থেকেই ধারণা করা যায়, রাজধানীতে চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ কীভাবে বাড়ছে?