শিল্প খাত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, বেড়েছে রফতানি ॥ দুর্গা পূজায় কেনাকাটা বেড়েছে

6

কাজিরবাজার ডেস্ক :
করোনাভাইরাসের প্রকোপ অনেকটা কমে আসায় ঘরে ও বাইরে নির্বিঘ্ন কাজ করছে মানুষ। কল-কারখানাসহ সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকা-স্থল খুলে দেয়ায় বেড়েছে রফতানি আয়, শেয়ারবাজারে ফিরেছে উর্ধগতি, প্রাণ ফিরেছে পর্যটন কেন্দ্রে। খরা কাটতে শুরু করেছে বিনিয়োগে। সব মিলিয়ে গতি ফিরে পাচ্ছে দেশের অর্থনীতি। শপিংমলগুলো ক্রেতার পদচারণায় মুখর হয়ে উঠছে। করোনাজনিত লোকসান কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে পোশাক ব্যবসায়ীদের জন্য সনাতন সম্প্রদায়ের শারদীয় দুর্গাপূজা যেন বড় সুযোগ হয়ে এসেছে। ইতোমধ্যে নামীদামী ফ্যাশন হাউস থেকে শুরু করে সাধারণ পোশাকের দোকানগুলোতে বেচাকেনা বেড়েছে। এতে আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। মঙ্গলবার দেশে করোনা শনাক্তের হার ছিল ২ দশমিক ৩৫ শতাংশ। এই পরিসংখ্যানই বলছে, কতটা কমেছে করোনার প্রকোপ। গত ১১ আগষ্ট সব কিছু চালু হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চাঙ্গা হতে শুরু করে। দোকানপাট, শপিংমল, অফিস-আদালত, ছোট-বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বীমা, শিল্প-কারখানা ও সড়ক, নৌ, রেল, আকাশপথের পরিবহনসহ সব কিছু স্বাভাবিকভাবে চলছে। শুধু তাই নয়, মানুষের মনের এই স্বস্তি সামষ্টিক অর্থনীতিতেও এক ধরনের ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনীতি গতিশীল রাখতে সরকারের প্রণোদনা ঘোষণা ছিল সময়োপযোগী পদক্ষেপ। সরকার প্রদত্ত প্রণোদনার অর্থ ও নীতি সহায়তা এবং লকডাউন উঠে যাওয়ায় দেশের সার্বিক অর্থনীতি দেড় বছর পর আবার ছন্দে ফিরতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মোঃ হেলালউদ্দিন বলেন, অর্থনৈতিক কর্মকা- শুরু হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থানগুলো আবার ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। মানুষ কাজ করছে। তবে মানুষের মনে অজানা একটা আতঙ্ক তো রয়েছেই। যদিও সেটা আগের তুলনায় অনেকটা কম। শিল্প খাতের উৎপাদন শুরু হয়েছে।
পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, বিপুলসংখ্যক মানুষকে করোনার টিকা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরেছে। তাই সেসব দেশের ক্রেতা প্রতিষ্ঠান আগামী গ্রীষ্ম ও বসন্ত মৌসুমের জন্য করোনার আগের মতো ক্রয় আদেশ দিচ্ছে। তা ছাড়া মিয়ানমারে সেনাশাসন ও ভারতে করোনার ভয়াবহতার কারণেও কিছু ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে স্থানান্তর করা হচ্ছে। বড়দিন কেন্দ্র করেও প্রচুর ক্রয়াদেশ আসছে। তার আগেই চীন থেকে কিছু ক্রয়াদেশ বাংলাদেশসহ অন্য দেশে স্থানান্তর করেন ইউরোপ-আমেরিকার ক্রেতারা। সম্প্রতি ভিয়েতনামে করোনার লকডাউন থাকার কারণেও কিছু ক্রয়াদেশ আসছে। সব মিলিয়ে ২০১৯ সালের তুলনায় ১৫-২০ শতাংশ ক্রয়াদেশ বেশি এসেছে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে ৪১৬ কোটি ৫৫ লাখ ডলারের পোশাক রফতানি হয়েছে, যা গত বছরের একই মাসের চেয়ে সাড়ে ৩৮ শতাংশ বেশি।
শিল্প ও সেবা খাতের জন্য প্রণোদনা তহবিল ৩৩ হাজার কোটি টাকার। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে এ তহবিলের ঋণ বিতরণ শুরু হয়। এখন পর্যন্ত দুই হাজার প্রতিষ্ঠান এ তহবিল থেকে ৩২ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ। এর মধ্যে অর্ধেক সুদ জনগণের করের টাকায় সরকার বহন করছে। বাকি সাড়ে ৪ শতাংশ সুদ দিতে হচ্ছে ঋণগ্রহীতা ব্যবসায়ীদের। এই ঋণের শর্ত শুধু চলতি মূলধন হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোই কেবল এ ঋণ পাচ্ছে। প্রণোদনার ঋণ নিয়ে বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো অনেকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, লজিস্টিক সাপোর্ট ভাল থাকায় বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলো করোনার মধ্যেও তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। তারা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে টাকা দিয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠান ছোট হওয়ার কারণে রাজস্ব কম দেয়, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশি। ফলে রাজস্ব আহরণ তথ্য হেলদি দেখাচ্ছে।
করোনার কারণে ২০২১ অর্থবছরের বড় একটা সময় ব্যাংকিং কার্যক্রম সীমিত ছিল। তারপরও আগের বছরের তুলনায় এ খাত থেকে সরকারের আয় বেড়েছে ৩০ শতাংশের বেশি। ব্যাংক হিসাব খোলা, ঋণপ্রদান, ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, ঋণের হিসাব, আমদানি-রফতানিসহ ব্যাংকের সব ধরনের সার্ভিস চার্জ থেকে সরকার ১৫ শতাংশ ভ্যাট পায়। এ ছাড়া ব্যাংকের কেনাকাটায়ও দিতে হয় উৎসে ভ্যাট। এনবিআরের তথ্য বলছে, ২০২১ অর্থবছরে ব্যাংকের এসব চার্জের ওপর ২ হাজার ২৫১ কোটি টাকা ভ্যাট পেয়েছে সরকার। আগের বছর এ খাতে আদায়কৃত ভ্যাট ছিল ১ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা। করোনাকালে ভাল ব্যবসা করেছে ওষুধশিল্প। গত বছর করোনার লকডাউনের মধ্যেও সচল ছিল আবাসনসহ নির্মাণ খাত। এ খাতের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত কনস্ট্রাকশন ফার্মগুলো থেকে সরকারের রাজস্ব আহরণ বেড়েছে প্রায় ১৪ শতাংশ। এ খাতের অনুষঙ্গ রড, সিমেন্ট ও সিরামিকস থেকেও রাজস্ব ১০ শতাংশের বেশি হারে বেড়েছে। এনবিআরের তথ্যানুসারে, গত বছর স্টিল ও রডশিল্প থেকে রাজস্ব আহরণ বেড়েছে ২৭ শতাংশ, সিমেন্ট খাত থেকে ১১ শতাংশ ও সিরামিকস থেকে ৩৬ দশমিক ১৬ শতাংশ।
করোনায় দেশে বিনিয়োগের যে খরা তৈরি হয়েছিল, তা কাটতে শুরু করেছে। ব্যাংক ব্যবস্থায় ঋণের জন্য আবেদন বাড়ছে। বেড়েছে বিতরণও। ফলে ব্যাংকে যে অতিরিক্ত তারল্য জমে ছিল, তা ছোট হতে শুরু করেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ঋণ বিতরণ হয়েছে ৫৪ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রথম প্রান্তিকে মার্চ পর্যন্ত বিতরণ ছিল ১৮ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত বিতরণ হয়েছে এর প্রায় দ্বিগুণ। ঋণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমছে উদ্বৃত্ত আমানত। কেবল জুলাইয়ে উদ্বৃত্ত আমানত কমেছে ২৮ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, গত জুলাইয়ে বেসরকারী খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ, যা সম্প্রতি সবচেয়ে বেশি। জুনে এ প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ। তারও আগে মে মাসে তা ছিল ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ। গত আগস্ট মাসে ৩৩৮ কোটি ডলারের বা ২৮ হাজার ৭৩০ কোটি টাকার পণ্য রফতানি হয়েছে। এই আয় গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৪ শতাংশ বেশি। গত আগস্টে ২৯৭ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছিল। চলতি অর্থবছরের জন্য ৪ হাজার ৩৫০ কোটি ডলারের পণ্য রফতানির লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে সরকার। বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছর রফতানি হয় ৩ হাজার ৮৭৬ কোটি ডলারের পণ্য।
পূজার বিক্রিতে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন ব্যবসায়ীরা : শপিংমলগুলো ক্রেতার পদচারণায় মুখর হয়ে উঠছে। করোনাজনিত লোকসান কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে পোশাক ব্যবসায়ীদের জন্য সনাতন সম্প্রদায়ের শারদীয় দুর্গাপূজা যেন বড় সুযোগ হয়ে এসেছে। ইতোমধ্যে নামীদামী ফ্যাশন হাউস থেকে শুরু করে সাধারণ পোশাকের দোকানগুলোতে বেচাকেনা বেড়েছে। এতে আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। সরেজমিনে মঙ্গলবার শপিংমলে গিয়ে দেখা গেছে, পূজা উপলক্ষে জমজমাট কেনাবেচা চলছে। সেখানে আড়ং, দেশী দশ, অঞ্জন’সসহ বিভিন্ন পোশাকের শোরুমগুলোতে খুব ভিড় না থাকলেও মোটামুটি ভাল বেচাবিক্রি হচ্ছে। জুতার দোকানগুলোতেও দেখা গেল একই চিত্র। বাটাসহ অন্য ব্র্যান্ডের জুতার শো রুমে চলছে কেনাকাটা। এমনকি পাড়া-মহল্লার ছোট ছোট দোকানেও সনাতন সম্প্রদায়ের লোকজনের আনাগোনা চোখে পড়ার মতো। করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর গত দেড় বছরে মাঝেমধ্যে উৎসব উপলক্ষে বিধিনিষেধ শিথিল করলেও এখনকার মতো বেচাবিক্রি হয়নি বলে জানান বিক্রেতারা। সে জন্য তারা এবারের পূজাকে ব্যবসা পুনরুদ্ধারের শুরু বলে মনে করছেন। রিটন মন্ডল একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের চাকরি করেন। তিনি জানান, প্রতিবারই পূজায় পরিবারের সবার জন্য পোশাক-জুতাসহ অন্য উপহারসামগ্রী কিনলেও গতবার করোনার কারণে কয়েক মাস বেকার থাকায় তা করতে পারেননি। এ বছরের জানুয়ারিতে নতুন চাকরি পেয়েছেন বিকাশ। তাই এবারের দুর্গাপূজা সামনে রেখে সাধ্য অনুযায়ী কেনাকাটা করেছেন। এতে মা, স্ত্রী ও সন্তান সবাই খুশি বলে জানান তিনি। জানতে চাইলে ‘রং’ বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক সৌমিক দাশ বলেন, ‘গত দুই বছরের বেচাকেনার সঙ্গে তুলনা করে লাভ নেই। পূজার বেচাকেনার মাধ্যমে আমরা ব্যবসা-বাণিজ্য পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ায় ঢুকেছি। পুরোপুরি লোকসান পুষিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে আরও তিন-চার বছর লাগবে। আমরা খুশি, করোনার প্রকোপ কমে যাওয়ায় এবারের দুর্গাপূজা উৎসবে মানুষ কেনাকাটা করতে আসছেন।’