কাজিরবাজার ডেস্ক :
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি। ইতোমধ্যে নতুন কমিশন গঠন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা শুরু হয়েছে। গতবারের মতো সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। এছাড়া অন্যান্য বিকল্প পন্থা নিয়েও চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে।
গত দুটি নির্বাচন কমিশন সার্চ (অনুসন্ধান) কমিটির মাধ্যমে গঠন করা হয়েছে। আইন করার বিষয়টিও জোরালোভাবে সামনে এসেছে। দীর্ঘ মেয়াদে আইন করার বিষয়টি সরকারের সক্রিয় বিবেচনায় থাকলেও আগামী কমিশন গঠনে সময় স্বল্পতায় আইন করার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলছে সরকারের নীতি-নির্ধারণী মহল। রাষ্ট্রপতি তার ইচ্ছা অনুযায়ী সরাসরি কমিশন গঠন করে দিতে পারেন এমন বিষয়ও আলোচনায় আসছে। তবে কোন প্রক্রিয়ায় কমিশন গঠন হবে তা এখনো চূড়ান্ত নয়।
নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়টি তো সংবিধানেই বলে দেওয়া আছে। রাষ্ট্রপতি এটা করে থাকেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ রেডি আছে। যেভাবে সিদ্ধান্ত হবে সেভাবেই কাজ করবো আমরা
অবশ্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগসহ সরকারের সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমেই আগামী নির্বাচন কমিশন গঠনের সম্ভাবনা প্রবল।
সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশন গঠনের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির। সংবিধানে এ বিষয়ে আইন করার কথাও বলা হয়েছে। এতোদিন রাষ্ট্রপতি সরাসরি নির্বাচন কমিশন গঠন করে দিতেন। রাষ্ট্রপতি বিগত দুটি কমিশন গঠন করেছেন সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে সাচিবিক দায়িত্ব পালন করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সভায় উপস্থিত সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে প্রতিটি শূন্য পদের বিপরীতে দুইজন ব্যক্তির নাম সুপারিশ করে সার্চ কমিটি। রাষ্ট্রপতি তাদের মধ্য থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনার নিয়োগ দিয়ে থাকেন।
নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে জানতে চাইলে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘এটা মহামান্য রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত, দেখা যাক কী হয়।’
কমিশন গঠনে নতুন আইন হতে পারে কি না, জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘আইনের বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে, তবে এই অল্প সময়ের মধ্যে হয়তো করা সম্ভব হবে না। এটা ডিফিকাল্ট। লং টার্মে (দীর্ঘ মেয়াদে) নিশ্চয়ই আইন করা হবে।’
এবার কি তাহলে আগের মতো সার্চ কমিটি গড়ে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে, জানতে চাইলে আনিসুল হক বলেন, ‘এখন পর্যন্ত তো আমি তাই জানি।’
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়টি তো সংবিধানেই বলে দেওয়া আছে। রাষ্ট্রপতি এটা করে থাকেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ রেডি আছে। যেভাবে সিদ্ধান্ত হবে সেভাবেই কাজ করবো আমরা।’
তিনি আরও বলেন, ‘কমিশন গঠনের প্রক্রিয়াটি এখন চূড়ান্ত হয়নি। এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে কোথাও কোনো প্রস্তাবও পাঠানো হয়নি। এটি আজকে-কালকের মধ্যে হবে, এমন নয়। আলাপ-আলোচনা হয়ে একটা সিদ্ধান্ত হবে। কিন্তু সেই পর্যায়ও এখনো আসেনি। আইনগত প্রক্রিয়া মেনে যে কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ তৈরি, এক্ষেত্রে আমরা সবসময় ইকুইপ্ট, কোনো অসুবিধা নেই।’
বর্তমান কমিশনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) সাবেক সচিব কে এম নূরুল হুদা। কমিশনার হিসেবে রয়েছেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব তালুকদার, সাবেক সচিব মো. রফিকুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত রাজশাহী জেলা জজ কবিতা খানম এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদৎ হোসেন চৌধুরী। ২০১৭ সালের ১৫ মার্চ শপথ নিয়েছিলেন তারা। দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে পাঁচ বছর তাদের মেয়াদ থাকবে। সে হিসেবে তাদের মেয়াদ আছে আর ছয় মাসের মতো।
সংবিধানে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আইনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কোনো সরকারই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়নি। কমিশন গঠনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে। সরকারও এবার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়েছে।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জি এম কাদের বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও নির্বাচন কমিশন গঠনে দেশে একটি আইন নেই, এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। সংবিধানে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে, নির্বাচন কমিশন গঠনে একটি আইন প্রণয়ন করতে হবে। আমরা চাই, সংবিধানের আলোকে আইনের মাধ্যমেই নির্বাচন কমিশন গঠন করা হোক, যে কমিশন দেশের মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করবে। এতে নির্বাচন কমিশন গঠনে স্থায়ী সমাধান হবে।
যেভাবে গঠিত হয়েছিল সর্বশেষ নির্বাচন কমিশন
১৯৭২ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১২ জন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও ২৭ জন নির্বাচন কমিশনার দায়িত্ব পালন করেছেন।
কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ কমিশনের মেয়াদের শেষের দিকে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সার্চ কমিটি করতে ২০১৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। সংলাপ শেষ হয় পরের বছরের ১৮ জানুয়ারি। এ সময় রাষ্ট্রপতি আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ ৩১টি দলের সঙ্গে সংলাপ করেন।
প্রায় প্রতিটি দলই নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন প্রণয়নের প্রস্তাব দেয়। তবে আইন না হওয়া পর্যন্ত সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে নতুন কমিশন গঠনের প্রস্তাবও দেয় দলগুলো।
সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের নির্দেশে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ নির্বাচন কমিশন গঠনে কমিটি গঠন করে আদেশ জারি করে। ছয় সদস্য বিশিষ্ট সার্চ কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি (বর্তমানে প্রধান বিচারপতি) সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। ২০১২ সালের সার্চ কমিটিরও প্রধান ছিলেন তিনি।
কমিটির সদস্যদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক, মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মাসুদ আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য শিরিন আখতার।
কমপক্ষে একজন নারীসহ প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে সুপারিশ দিতে বলা হয় সার্চ কমিটিকে। এই প্রেক্ষাপটে প্রথমবারের মতো নারী কমিশনার পায় নির্বাচন কমিশন। কমিটিতে সময় দেওয়া হয় ১০ কর্মদিবস।
নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে অংশ নেওয়া দলগুলোর কাছ থেকে পাঁচটি করে নাম নেওয়া ছাড়াও দুই দফায় ১৭ জন বিশিষ্টজনের সঙ্গে বৈঠক করে। ৬ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও কমিশনারদের নাম প্রকাশ করে।
সংবিধানে যা আছে
দেশের সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে। ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং সর্বোচ্চ চারজন নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকবে এবং এ বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দেবেন।
একাধিক নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠিত হলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এর সভাপতি হিসেবে কাজ করবেন। এই সংবিধানের বিধানাবলী-সাপেক্ষে কোনো নির্বাচন কমিশনারের পদের মেয়াদ কার্যভার গ্রহণের তারিখ থেকে পাঁচ বছর থাকবে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন, এমন কোনো ব্যক্তি প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ পাওয়ার যোগ্য হবেন না। অন্য কোনো নির্বাচন কমিশনার অনুরূপ পদে কর্মাবসানের পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার যোগ্য হবেন, তবে অন্য কোনো ভাবে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগের যোগ্য হবেন না।