কাজিরবাজার ডেস্ক :
অতিমারী করোনায় শেষ পর্যন্ত ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছে মানুষ। ঘর থেকে বেরোতে মানুষ এতটাই মরিয়া যেন বিধিনিষেধ শিথিলের আগেই সবকিছু খুলে ফেলেছে। আগামীকাল বুধবার থেকে দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পর্যটন কেন্দ্র ছাড়া সবকিছুই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালু হচ্ছে। আর একটি দিনও অপেক্ষা করতে পারলেন না তারা। সোমবারের পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে দেশে কঠোর বিধিনিষেধ বলতে কিছু নেই।
রবিবার সরকারী প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকেই উধাও হয়েছে স্বাস্থ্যবিধি। দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফেরার তাগিদ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে চাপে ফেলছে। যেকোন সময়ের চেয়ে রেকর্ড মৃত্যু ও সংক্রমণ মানুষকে থামাতে পারছে না। মানুষের বেপরোয়া চলাচলের কারণে আগামীতে করোনা পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনা, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সচল রাখতে এবং সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় চলমান কঠোর বিধিনিষেধ আগামীকাল বুধবার থেকে শিথিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ। প্রজ্ঞাপন অনুসারে, ওইদিন থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব ধরনের গণপরিবহন চলবে। এ ছাড়াও খোলা থাকবে সব ধরনের অফিস, মার্কেট, শপিংমল, রেস্তোরাঁ ও শিল্প-কারখানাও। রবিবার বিকেলে এই প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
সরকারী প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ পরিস্থিতি পর্যালোচনা সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার সিদ্ধান্ত, দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, অর্থনৈতিক কর্মকা- সচল রাখতে এবং সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নতুন করে বিধিনিষেধ কিছুটা শিথিল করা হলো।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, মানুষের জীবন ও জীবিকার স্বার্থে সরকার লকডাউন শিথিল করছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় আবারও কঠোর লকডাউন দেয়া হবে বলেও তিনি জানান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইলোরোজী বিভাগের অধ্যাপক ডাঃ সায়েদুর রহমান জানান, ভাইরাস যতই শক্তিশালী হোক না কেন, মাস্ক পড়ে ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাচল করলে সেটি প্রতিরোধ করা সম্ভব। নাক মুখ ও চোখ দিয়েই করোনাভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে থাকে। তাই নিয়মিত মাস্ক পড়ার অভ্যাস করলেই করোনাকে পরাজিত করা যাবে। এতে নিজেকে ও অপরকেও সুরক্ষা দেয়া সম্ভব।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র ডাঃ নাজমুল ইসলাম বলেন, গত এক মাস ধরে দেশে করোনা পরিস্থিতি একই পর্যায়ে রয়েছে। কোন উন্নতি ঘটেনি। করোনা সংক্রমণ ২৭ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। তবে মৃত্যুর সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে। কঠোর বিধিনিষেধ শিথিল করার পরে জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে ঢিলেঢালাভাব থাকলে করোনা সংক্রমণ আরও বাড়তে পারে।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডাঃ মুসতাক হোসেন বলেন, করোনা প্রতিরোধে টিকাকরণই সবচেয়ে কার্যকরী উপায়। বর্তমানে দেশে ব্যাপক আকারে টিকাকরণ কর্মসূচী শুরু হচ্ছে। তবে সেটি প্রয়োজনের তুলনায় যথেস্ট নয়। করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বাড়ার মধ্যেই অর্থনীতি সচল রাখতে কঠোর বিধিনিষেধ শিথিল করা হচ্ছে। গণপরিবহন, অফিস আদালত, দোকানপাট, রেস্তরাঁ সবকিছুই খুলে দেয়া হচ্ছে। এই সময়ে স্বাস্থ্যবিধি পালনের ওপর বিশেষ নজর দেয়া উচিত। শুধু নিজের জন্য নয়, অন্যের জন্য মাস্ক পড়তে হবে। এছাড়া স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
গত বছরের মার্চ মাস থেকে টানা লকডাউন ও বিধিনিষেধের কর্মসূচী চলছিল। কিন্তু আগামীকাল বুধবার থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পর্যটন, বিনোদন কেন্দ্র বাকি রেখে সবকিছু সীমিত আকারে চলার কথা রয়েছে। এসব কিছু খোলার আগেই ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা পুরোদমে বাণিজ্যিক কর্মকান্ডে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ইতোমধ্যে রাজধানীসহ সারাদেশের কাঁচা বাজার এবং নিত্যপণ্যের দোকানগুলোতে কেনাবেচা চলছে। রাজধানীর মহল্লা ও অলিগলির দোকানপাট নির্দিষ্ট সময়ের পর গভীর রাত পর্যন্ত চালু রাখা হচ্ছে। হোটেল ও চায়ের দোকানগুলোতে যুবক ও তরুণেরা আড্ডা দিচ্ছে। তাদের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বালাই নেই। স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার তোয়াক্কা না করে ভ্যানে করে পাড়া-মহল্লায় শাক-সবজি, মাছ ও ফলমূল বিক্রি করা হচ্ছে।
কঠোর বিধিনিষেধ শিথিলের একদিন আগেই রাস্তা ঘাটে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা কিছুটা কমেছে। রাস্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখের সামনে দিয়ে অবাধে চলাচল করছে অটোরিক্সা, মোটরসাইকেল, সিএনজি ও প্রাইভেটকারসহ নানা ধরনের যানবাহন। অভিজাত এলাকা বা সিটি কর্পোরেশনের নিবন্ধিত মার্কেট, শপিংমল, ফ্যাশন হাউস ও গণপরিবহন বিশেষ করে বাস চলাচল পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। চেকপয়েন্টগুলোতে পুলিশী তৎপরতা তেমন না থাকায় সড়ক-মহাসড়কে স্বাভাবিক চলাফেরা শুরু করেছে নগরবাসী।
কঠোর বিধিনিষেধ শিথিলের আগে গত শুক্রবার থেকে দেশের অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়। এর আগে বিধিনিষেধ চলাকালীন শুধু প্রবাসীদের জন্য অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচলের অনুমতি দেয়া ছিল। কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পেয়ে শুক্রবার থেকে সাধারণ যাত্রীরাও দেশের অভ্যন্তরে বিমানে চলাচল শুরু করে। এছাড়া ১ আগস্ট থেকে অর্থনীতি সচল রাখতে রফতানিমুখী শিল্প কারখানা চালু করা হয়েছে। কারখানাতে যোগ দিতে সারাদেশ থেকে মানুষ স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করেই কাজে যোগ দেয়। প্রথম গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও একদিনের জন্য গণপরিবহন চালু করেছিল সরকার। ফের গণপরিবহন বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
যা যা শিথিল হচ্ছে : আগামীকাল বুধবার থেকে সব সরকারী, আধা-সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারী অফিস, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্যবিধি মেনে খোলা থাকবে। সড়ক, রেল ও নৌপথে আসন সংখ্যার সম পরিমাণ যাত্রী নিয়ে গণপরিবহন বা যানবাহন চলাচল করতে পারবে। সড়ক পথে গণপরিবহন চলাচলের ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন (সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসক) নিজ নিজ অধিক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সংশ্লিষ্ট দফতর বা সংস্থা, মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করে প্রতিদিন মোট পরিবহন সখ্যার অর্ধেক চালু করতে পারবে। এছাড়া শপিংমল, মার্কেট ও দোকানপাট সকাল ১০টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে খোলা রাখা যাবে। সব শিল্প-কলকারখানা চালু থাকবে। আর খাবারের দোকান, হোটেল-রেস্তোরাঁয় অর্ধেক আসন খালি রেখে সকাল আটটা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা যাবে। এছাড়া আদালতের বিষয়ে সুপ্রমীকোর্ট প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবে।