মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান :
(পূর্ব প্রকাশের পর)
কুরআনের উপরোক্ত আয়াত ও হাদীছ হতে প্রমাণিত হয় যে, মানুষ যা কিছু করে এবং মঙ্গল-অমঙ্গল যা কিছু সংঘটিত হয় সবকিছু ভাগ্যলিপি অনুসারে হয়ে থাকে। এতে কারও কোন ক্ষমতা নেই। সুতরাং ক্বাদারিয়াদের আক্বীদা ভ্রান্ত।
জাবারিয়া মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা হলেন জাদ বিন দিরহাম। পরবর্তীতে জাহম বিন ছাফওয়ান এ মতবাদের প্রসার ঘটান। জাবরিয়ারা বলে মানুষ আল্লাহর লিখা ভাগ্যের অধীন, তার কোন ক্ষমতা নেই। তাকে দিয়ে যা করানো হয়, তাই সে করে। পক্ষান্তরে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মতে, বান্দার কর্মের স্বাধীনতা রয়েছে। সৎকর্ম করলে তাদেরকে প্রতিদান দেওয়া হবে। আর অসৎকর্ম করলে তাদেরকে শাস্তি দেওয়া হবে। মানুষকে আল্লাহর পক্ষ থেকে কর্মের এমন একটি শক্তি প্রদান করা হয়েছে, যা সৃষ্টি ক্ষমতা রাখে না। কিন্তু অর্জনের ক্ষমতা রাখে। মানুষের মধ্যে এই অর্জনের ক্ষমতা আছে বলেই ভালোর জন্য প্রতিদান এবং মন্দের জন্য তাকে শাস্তি দেওয়া হবে। আবার এ ক্ষমতাটি স্বয়ংসম্পূর্ণ না হওয়ায় মানুষকে নিজ ইচ্ছা ও কর্মের স্রষ্টা বলে অভিহিত করা যায় না। অনুরূপভাবে মানুষের মধ্যে এ শক্তি আছে বলে তাকে শক্তিহীন জড়-পদার্থের মতও গণ্য করা যায় না। শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী (রহঃ) বলেন, বান্দার ইখতিয়ার ও স্বাধীনতা তো আছে তবে এ ইখতিয়ার আল্লাহ তাআলার ইখতিয়ারের অধীন। অর্থাৎ কর্মের ইচ্ছা ও কর্মের শক্তি মানুষের মধ্যে আছে। কিন্তু এর সাথে আল্লাহর ইচ্ছার প্রতিফলন না ঘটলে কোন কিছুই বাস্তবায়িত হবে না। মানুষ ও মানুষের কর্ম সবই আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে ‘আল্লাহ্ই সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে ও তোমরা যা কর সেগুলোকেও’ (ছফফাত ৩৭/৯৬)। অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে,‘আল্লাহ সবকিছুর স্রষ্টা। আর তিনি সবকিছুর অভিভাবক এবং কর্ম সম্পাদনকারী’ (যুমার ৩৯/৬২)।
আল্লাহ হলেন কর্মের স্রষ্টা এবং বান্দা হল কর্মের বাস্তবায়নকারী। অদৃষ্টবাদী জাবারিয়ারা বান্দাকে ইচ্ছা ও কর্মশক্তিহীন বাধ্যগত জীব বলে মনে করে, যা সম্পূর্ণ ভুল।
তাক্বদীরে বিশ্বাস ঈমানের একটি রুকন। যা আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস সৃষ্টি করে। কাজ ও তার কারণ ও উপায় সকলই আল্লাহর নির্ধারিত ভাগ্যলিপির জন্য হয়ে থাকে।নিজের কর্ম কৌশলের জন্য গর্ববোধ না করে কাজে সফলতার জন্য আল্লাহর শুকরিয়া করা। কারণ সফলতা আল্লাহর নেয়ামত যা নির্ধারিত হয়েছে আল্লাহর নির্ধারিত লিখন ভাগ্যের দ্বারা। তাই এজন্য শুকরিয়া আদায় করা হবে। মনে শান্তি ও তৃপ্তি লাভ করে। যখন সে বিশ্বাস করে কাজটি আল্লাহর সিদ্ধান্ত অনুসারে হয়েছে। তাই সে না চাইলেও বিষয়টি সংঘটিত হবেই। তখন তার অন্তরে প্রবোধ পায়। এজন্য ভাগ্যের প্রতি বিশ্বাসী ব্যক্তির চেয়ে সাচ্ছন্দ্য জীবন ও শান্ত মন এবং অধিক তৃপ্ত ব্যক্তি অপর কেউ হতে পারে না। তাক্বদীরে বিশ্বাসী ব্যক্তি কোন কাজে আশা পূরণ না হওয়ার সময় অথবা অপছন্দনীয় কিছু ঘটার সময় হাহুতাশ করে না। সে বিশ্বাস করে এসবই আল্লাহর সিদ্ধান্তে ঘটেছে যার অধিকারে রয়েছে আকাশ সমূহের ও যমীনের রাজত্ব।
ভাগ্য বিশ্বাসের ফলে দুশ্চিন্তা দূর হয়। কারণ রাসূল (সা.) বলেন, ‘যখন ঈমানদার ব্যক্তির কোন দীর্ঘ কলান্তি বা সাময়িক অশান্তি এবং দুঃখ-কষ্ট বা কোন বেদনা পৌঁছায়, এমনকি কাটা ফুটে যায়, এর কারণে আল্লাহ তার গুনাহ মাফ করে দেন’। ফলে সে ক্ষতি থেকে নির্ভীক হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইবনে আববাস (রা.)-কে বলেন, সমস্ত পৃথিবীর সকলে মিলে তোমার কোন উপকার করতে পারবে না, ততটুকু ব্যতীত যা আল্লাহ তোমার ভাগ্য লিপিতে লিখে রেখেছেন।তাই ভাগ্য বিশ্বাসী ব্যক্তি সৃষ্টি জগতের দ্বারা লাভ-ক্ষতির কোনই ভয় করে না।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মুমিন ব্যক্তির ব্যাপারটা আশ্চর্য ধরনের। প্রত্যেকটা ব্যাপারই তার জন্য কল্যাণকর। এ ব্যাপারটা ঈমানদার ছাড়া আর কারো জন্য হয় না। তার কাছে যদি কল্যাণ পৌঁছায় তবে সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। এটা তার কল্যাণ বহন করে। আর যদি তার কাছে দুঃখ-কষ্ট পৌঁছায় তবে সে ধৈর্য ধারণ করে। এটাও তার জন্য কল্যাণকর হয়’।তাক্বদীর একটি গায়েবী বিষয়, যার রহস্য মহান আল্লাহ ব্যতীত কেউ অবগত নয়। এজন্য সাধারণভাবে বিষয়টি এভাবে ব্যাখ্যা করা যায় যে, যেমন একজন লোকের সামনে ফলের রস ভর্তি গ¬াস রাখা রয়েছে। সে ইচ্ছা করলে তা পান করতে পারে, নাও পারে। অর্থাৎ সে পান করতে বাধ্য নয়। অতঃপর যদি সে পান করে, তবে তা আল্লাহর জ্ঞানে পূর্ব থেকেই রক্ষিত আছে। আবার যদি পান না করে, তাও আল্লাহর জ্ঞানে আগে থেকেই রক্ষিত আছে। যদি বলা হয়, এর ব্যাখ্যা কি? জবাব এতটুকু দেওয়া যায় যে, অসীম জ্ঞানের অধিকারী মহান আল্লাহর সৃষ্টি রহস্য মানুষের স্বল্পজ্ঞান দিয়ে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। মানুষের সৎ অসৎ যাবতীয় কর্মের ক্ষেত্রেও অনুরূপ বক্তব্যই প্রযোজ্য। একজন পাপাচারী পাপকর্মের দিকে প্রবৃত্ত হয় এবং নিজ হাতে তা বাস্তবায়ন করে। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, নিজ ইচ্ছা ও ক্ষমতা প্রয়োগ করে সে পাপাচারে লিপ্ত হচ্ছে। এজন্যে তার শাস্তিও হবে।
এক্ষণে বান্দা যেহেতু নিজের তাক্বদীর জানে না, সেহেতু তাকে মন্দ কর্ম হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করতে হবে এবং সর্বদা আল্লাহর বিধান মেনে কাজ করে সুন্দর পরিণতি লাভের চেষ্টা করতে হবে। তার সাধ্যমত চেষ্টার পরেও যেটা ঘটবে, বুঝতে হবে সেটাই ছিল তার তাক্বদীরের লিখন। সুতরাং তাক্বদীর সত্য। কাদারিয়া, জাবারিয়া সম্প্রদায়ের আক্বীদা মিথ্যা। (সমাপ্ত)