কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রাণঘাতী করোনা মহামারীর মধ্যেও সারাবিশ্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘নজির ও দৃষ্টান্ত স্থাপন’ করা আশ্রয়ণ প্রকল্পের ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য নির্মিত ও নির্মিতব্য বাড়ি-ঘর সরেজমিনে পরিদর্শনে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছুটে গেছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের (পিএমও) পাঁচটি টিম। আগামী কয়েকদিন আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় দেশের আটটি বিভাগে নির্মিত ও নির্মাণাধীন বাড়িগুলোর অবস্থা দেখতে বিভিন্ন জেলা-উপজেলা সদর থেকে প্রান্ত পর্যন্ত চষে বেড়াবেন এসব টিমে থাকা উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। সরেজমিন পরিদর্শন ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলায় যেসব নির্মিত ঘরগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা দ্রুত সরকার থেকে মেরামত করে দেয়া হবে। শুক্রবার সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একযোগে এসব টিম সারাদেশের বিভিন্ন জেলার উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। প্রথম দফায় সারাদেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলাকে পাঁচটি ব্লকে ভাগ করে পরিদর্শন শুরু করেছে এসব টিম। পরিদর্শনকারী টিমগুলোকে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় নির্মিত এবং নির্মাণাধীন বাড়িগুলোর নির্মাণশৈলী ও গুণগতমান, অনুমোদিত ডিজাইন ও প্রাক্কলন অনুযায়ী হয়েছে কিনা তা সরেজমিনে যাচাই করে ছবিসহ প্রতিবেদন তৈরির নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
এ পর্যন্ত আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে সারাদেশে এক লাখ ১৮ হাজার ৩৮০ জন ভূমিহীন-গৃহহীন-ছিন্নমূল মানুষকে দুই শতক জায়গার ওপর দুই কক্ষবিশিষ্ট একটি করে বাড়ি নির্মাণ তা বিনামূল্যে রেজিস্ট্রি দলিল করে মুজিববর্ষের উপহার দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু এর মধ্যে বিভিন্ন জেলায় টানা অতিবৃষ্টি, বন্যাসহ নানা কারণে প্রায় শতাধিক ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, অতিবৃষ্টি ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এসব ঘর দ্রুত সরকারীভাবে সংস্কার করে দেয়ার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পাঁচটি টিম সারাদেশে চষে বেড়িয়ে সরেজমিন পরিদর্শনকালে আশ্রয়ণ প্রকল্পের এসব ঘর নির্মাণের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন। একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তারা ছাড়াও আশ্রয়ণ প্রকল্পের পদস্থ কর্মকর্তারা সারাদেশে ভূমিহীনদের ঘর নির্মাণ সম্পর্কিত যাবতীয় কার্যক্রম কঠোর নজরদারিতে রাখবেন।
সরেজমিন পরিদর্শনে যাওয়া উচ্চ পর্যায়ের পাঁচটি টিমের একটিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মোঃ মাহবুব হোসেন নিজেই। দুপুরে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের পরিচালক মাহবুব হোসেনের নেতৃত্বে দু’টি টিম মুন্সীগঞ্জ জেলার সদর উপজেলায় পৌঁছায়। সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় নির্মিত আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাড়িগুলো পরিদর্শন ও উপকারভোগীদের সঙ্গে মতবিনিময়ও করেন তারা।
এ দু’টি টিমে অন্যান্যের মধ্যে মুন্সীগঞ্জে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব হাসান জাহিদ তুষার, আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ জাহেদুর রহমান, মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসক কাজী নাহিদ রসুল, প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সচিব এ বি এম সরওয়ার-ই-আলম সরকারসহ প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় ও মাঠ প্রশাসনের উর্ধতন কর্মকর্তারা। মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাড়ি পরিদর্শন শেষে টিম দু’টি আলাদা হয়ে ভিন্ন ভিন্ন জেলায় সরেজমিন পরিদর্শনে যাবেন।
এছাড়া আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প পরিচালক মাহবুব হোসেনের নেতৃত্বে একটি টিম টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলা এবং বগুড়া জেলা সদর, শেরপুর ও শাজাহানপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় নির্মিত ও নির্মাণাধীন বাড়িগুলো সরেজমিন পরিদর্শন করবে। আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ জাহেদুর রহমানের নেতৃত্বে অপর টিম হবিগঞ্জ সদর, মৌলভীবাজার সদর ও সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার বাড়িগুলো পরিদর্শন করবে।
এছাড়া বাকি তিনটি টিমের মধ্যে আশ্রয়ণ প্রকল্প প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে একটি টিম ময়মনসিংহ ও জামালপুর জেলা, প্রকল্পের উপ-প্রকল্প প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে একটি টিম নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলা, সহকারী প্রকল্প পরিচালক বদরুল আলমের নেতৃত্বে একটি টিম পাবনা, মানিকগঞ্জ, নাটোর জেলার বিভিন্ন এলাকার বাড়ি সরেজমিন পরিদর্শনে গেছেন।
মুন্সীগঞ্জে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ভূমিহীনদের জন্য নির্মিত বাড়ি পরিদর্শনকালে প্রকল্প পরিচালক মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আমরা পাঁচটি টিম করে দিয়েছি, সারাদেশে আজকে (শুক্রবার) থেকে পরিদর্শন শুরু হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সব জেলাতে যাবে। বিশেষ করে যেসব এলাকায় এ কথাগুলো (অনিয়মের অভিযোগ) উঠছে, সেসব অভিযোগ সঠিক কিনা সেটা যাচাইয়ের জন্য কমিটি করে তদন্ত করতে বলি।
এক্ষেত্রে কোন অনিয়ম সহ্য করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, এটা প্রধানমন্ত্রীর প্রকল্প, স্বপ্নের প্রকল্প। একটা গরিব লোক যিনি ঘর পাচ্ছেন, এটা তার একটা স্বপ্নের সূচনা হয়। কাজেই এটা নিয়ে আমরা কোন অবহেলা করব না এবং কোন অবহেলা সহ্য করব না। সবাই আপনারা জানেন যে, প্রধানমন্ত্রীর ড্রিম প্রজেক্ট হলো আশ্রয়ণ প্রকল্প। আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে বিনে পয়সায় ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে বিনে পয়সায় জমি ও ঘরের মালিকানা দেয়া হচ্ছে। যেটাকে আমরা বলি ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে শেখ হাসিনা মডেল’।
মুন্সীগঞ্জে একটি এলাকায় কিছু বাড়ির ফ্লোর ফেঁটে যাওয়ার বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রকল্প পরিচালক বলেন, এটা নিয়ে আমরা কমিটি গঠন করেছি। প্রাথমিকভাবে আমি যে তথ্য পেয়েছি ওখানে ইটের সলিং দেয়ার কথা, সেটা তারা দেয়নি। ঢালাইটাও মানসম্মত না। অভিযোগ পাওয়ার পর কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী মেরামত শুরু করা হয়েছে। মুন্সীগঞ্জ সদরে এ কাজের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত ছিল তারা সবাই ওএসডি হয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে মাহবুব হোসেন আরও বলেন, উপজেলা প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি সবাই মিলে কিন্তু কাজটা করছেন। এ করোনাকালীন ১ লাখ ১৮ হাজার ৩৮০টি ঘর দেয়া এটা কম কথা নয়। তাদের কাজকে আমরা অবশ্যই সাধুবাদ জানাই এবং কৃতজ্ঞতা জানাই। কিন্তু আমাদের মনটাই খারাপ হয় যখন আমরা দুই চারটা সমস্যার কথা শুনি।
অতিবৃষ্টি, বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয়ণের কিছু বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া নির্মাণে ত্রুটির কারণেও বিভিন্ন এলাকায় বেশকিছু বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি নির্মাণে ত্রুটির বিষয়টি সামনে আসতেই নড়ে চড়ে বসেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর নির্মাণে অনিয়ম, অবহেলা ও অর্থ আত্মসাতকারীদের ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে এগোচ্ছে। অভিযোগ তদন্ত করে অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে সরকার। এরইমধ্যে পাঁচজন সরকারী কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছে।
‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে শেখ হাসিনা মডেল’ বাস্তবায়নে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় এ পর্যন্ত সর্বমোট ১ লাখ ১৮ হাজার ৩৮০টি পরিবারকে দুই শতাংশ খাস জমিসহ দুই কক্ষবিশিষ্ট আধাপাকা বাড়ি দেয়া হয়েছে। মুজিববর্ষে ডিসেম্বরের মধ্যে আরও এক লাখ ছিন্নমূল পরিবারকে স্বপ্নের নিজস্ব ঠিকানা প্রদানের লক্ষ্যে সারাদেশে ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। ‘বাংলাদেশের একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ নির্দেশনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দেশে ২ লাখ ৯৩ হাজার ৩৬১টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবার এবং জমি আছে ঘর নেই অথবা অত্যন্ত জরাজীর্ণ ঘর এ রকম ৫ লাখ ৯২ হাজার ২৬১টি পরিবারের তালিকা করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সবাইকে বাড়ি নির্মাণ করে দেবে সরকার।