সংসদে আলোচনা ॥ রাজনীতিবিদরা তৃতীয় লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন, আর দেশ চালাচ্ছেন আমলারা

14

কাজিরবাজার ডেস্ক :
আমলাতান্ত্রিকতার কারণে দেশে রাজনীতিবিদদের কর্তৃত্ব ধীরে ধীরে ‘স্লান’ হয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে এ নিয়ে জাতীয় সংসদে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন সরকার ও বিরোধী দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা। তাঁরা বলেন, দেশের যে কোন দুর্যোগ-সঙ্কটে রাজনীতিবিদরাই জনগণের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়, আর এ দেশ স্বাধীন করেছে রাজনীতিবিদরাই। রাজনীতিবিদরাই দুর্দিনে বাতি জ্বালান, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যান। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে রাজনীতির মঞ্চগুলো আস্তে আস্তে আমলা-ব্যবসায়ীরা দখল করছে। কর্মকাণ্ড দেখলে মনে হয় দেশ চালাচ্ছেন আমলারা, আর রাজনীতিবিদরা যেন এখন তৃতীয় লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন! এতে একটা রাজনৈতিক সরকার এবং রাজনীতিবিদদের যে কর্তৃত্ব কাজ, সেটা কিন্তু স্লান হয়ে যাচ্ছে। এটাই হচ্ছে দুর্ভাগ্য।
স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সোমবার জাতীয় সংসদ অধিবেশনে প্রস্তাবিত ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে তারা এসব কথা বলেন। আলোচনার সময় নাশকতার সঙ্গে জড়িত হেফাজতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করারও দাবি ওঠে। আলোচনায় অংশ নেন আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমেদ, বেগম মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, সরকারী দলের শফিকুল ইসলাম শিমুল, এম এ মতিন, আনোয়ার হোসেন হেলাল, কাজিম উদ্দিন আহমেদ, গণফোরামের মোকাব্বির খান, জাতীয় পার্টির প্রধান হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গা, ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কাজী ফিরোজ রশীদ, ডাঃ রুস্তম আলী ফরাজী এবং বিএনপির জাহিদুর রহমান।
আলোচনায় অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেন, আমার দুর্ভাগ্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জেনারেল জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, তিনি রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে দেবেন। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজটা করেছেন এটা আমাদের দুর্ভাগ্য। যারা রাজনীতিবিদ, যারা নির্বাচিত প্রতিনিধি, তাঁদের জন্য নির্ধারিত স্থান যেখানে আছে, সেখানে তাদের থাকা উচিত। কারণ আমাদের জেলায় একজন সচিব যাবেন। আমরা তাঁকে বরণ করে নেব, ঠিক আছে। কিন্তু তাঁরা যান না। তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন মন্ত্রীরা জেলার দায়িত্ব পালন করতেন। সেখানে গেলে কর্মীরা আসত। মন্ত্রীরা গ্রাম-গঞ্জে যেতেন। কোথায় যেন সে দিনগুলো হারিয়ে গেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ সবদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে তোফায়েল আহমেদ আরও বলেন, আমরা যারা জাতীয় সংসদের সদস্য, এমন একজনও নেই যিনি করোনাকালীন এই সময়ে নিজস্ব অর্থায়নে বা যেভাবেই হোক গরিব দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়াননি। সবাই দাঁড়িয়েছেন। আমার আমরা নিজের এলাকায় ৪০ হাজার মানুষকে রিলিফ দিয়েছি। কথাটা বলা কতটা যুক্তিসঙ্গত হবে জানি না, এখন আমাদের জেলায় জেলায় দেয়া হয়েছে প্রশাসনিক কর্মকর্তা। মানুষ মনে করে আমরা যা দেই, সেটা প্রশাসনিক কর্মকর্তারাই দেয়! মাঠে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা যান না উল্লেখ করে তিনি বলেন, যাকে দেয়া হয়েছে তিনি এখন পর্যন্ত যাননি। এটা কিন্তু ঠিক না। একটা রাজনৈতিক সরকার এবং রাজনীতিবিদদের যে কর্তৃত্ব কাজ, সেটা কিন্তু ম্লান হয়ে যাচ্ছে। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, ফেরাউনের সময়ও আমলা ছিল। এসব কথাবার্তা মানুষ পছন্দ করে না। এমপিদের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স, দ্য এমপিস আর এভাব দ্য সেমিট্রিস। এই জিনিসটা খেয়াল রাখতে হবে।
জাতীয় পার্টির জ্যেষ্ঠ নেতা কাজী ফিরোজ রশীদও বিষয়টি সমর্থন করে বলেন, আজকে দেশে কোন রাজনীতি নেই। রাজনীতি শূন্য, কোথাও রাজনীতি নেই। প্রত্যেকটা জেলার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সচিবদের। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ডিসিদের সঙ্গে কথা বলেন। আর এমপিরা পাশাপাশি বসে থাকেন দূরে। তারপর বলে- ডিসি সাহেব, আমি একটু কথা বলবো প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। এই হচ্ছে রাজনীবিদদের অবস্থা।
তিনি অভিযোগ করেন, রাজনীতির মঞ্চগুলো আস্তে আস্তে ব্যবসায়ীরা দখল করছে। দেশ চালাচ্ছে কারা? দেশ চালাচ্ছেন জগৎশেঠরা। দেশ চালাচ্ছেন আমলারা। আমরা রাজনীতিবিদরা এখন তৃতীয় লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। এই হচ্ছে আমাদের দুর্ভাগ্য। অথছ এই দেশ স্বাধীন করেছে রাজনীতিবিদেরা। পদ্মা সেতু, পায়রা বন্দর বা মেট্রোরেল করা হলেও রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ছাড়া জনগণ এটার সুফল পাবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, রাজনীতিবিদ ছাড়া ব্যবসায়ীদের মধ্যে পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট থাকে না। বাতাস যেদিকে তারা সেদিকে ছাতা ধরে। ক্ষমতায় আমরাও ছিলাম, তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের আছে।
হেফাজতে ইসলামকে স্বাধীনতাবিরোধী জঙ্গি সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করে সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ এবং জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম। আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে বিএনপি, জামায়াত, হেফাজত দেশের বিভিন্ন স্থানে তাণ্ডব চালিয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সরকার পতন। স্বাধীনতা দিবস ওরা সহ্য করতে পারে না, ওদের বুকে ব্যথা লাগে। কথা নাই বার্তা নাই বায়তুল মোকাররমে জমা হয়ে তাণ্ডব চালায়। সেখানে মুসল্লিরা নামাজ পড়তে পারেন না। বায়তুল মোকাররমে এ ধরনের সমাবেশ নিষিদ্ধ করা উচিত। তারা বায়তুল মোকাররমকে প্লাটফর্ম বানিয়েছে। কোরান শরিফ পুড়িয়েছে, মানুষ পুড়িয়েছে। এই হেফাজতে ইসলাম এরা ছিল স্বাধীনতাবিরোধী নেজামে ইসলামী। মানুষ মেরে এরা ইসলামকে হেফাজত করবে কিভাবে? আসলে এটা জঙ্গি সংগঠন, এ সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হোক। যেভাবে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখানো হয়েছে ঠিক সেভাবে।
তিনি বলেন, আমাদের প্রধান শত্রু সাম্প্রদায়িকতা। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ রাজনীতি করা, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তি আন্তর্জাতিক চক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে জিয়া-মোশতাকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। জিয়াউর রহমান এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করে মুক্তি দিয়ে রাজনীতি করার এবং দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠন করেছেন, যার বাংলা করলে দাঁড়ায়- ‘বি’ মানে বাংলাদেশ, ‘এন’ মানে না এবং ‘পি’ মানে পাকিস্তান। অর্থাৎ বাংলাদেশ না পাকিস্তান। স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি ও মুক্তিযোদ্ধাদের শেষ করে দিতে এই জিয়া এদেশে জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের রাজনীতিতে স্থান করে দেয়। আর স্ত্রী খালেদা জিয়া বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাসহ পুরো আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল। এরা গণতন্ত্র, মানবতা ও জনগণের শত্রু।
সাবেক কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী বিএনপির কঠোর সমালোচনা করে বলেন, যারা বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যার বিচার বন্ধে ইনডেমনিটি জারি করেছিল, আজ তারাই গণতন্ত্র ও মানবতার কথা বলে! যারা প্রতি রাতে কার্ফু দিয়ে কার্ফু গণতন্ত্র কায়েম করেছিল, তাদের মুখে গণতন্ত্রের কথা মানায় না। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে বারবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে খালেদা জিয়া সরকারের সম্পূর্ণ নীলনক্সা ও পরিকল্পনায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল। আর বিনা বিচারে তাঁর স্বামী জিয়াউর রহমান শত শত সামরিক অফিসারসহ মানুষকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেছে।
তিনি বলেন, করোনার মধ্যেও অর্থনীতির চাকাকে সচল রেখে শত ষড়যন্ত্রকে ভেদ করে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুকন্যার রাজনীতিই হচ্ছে- ‘কেউ পেছনে পড়ে থাকবে না’। তাঁর দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিস্ময়কর উত্থান ঘটেছে। স্বাধীনতার পর দেশের ৮০ ভাগ মানুষ গরিব ছিল, সেখানে দরিদ্র্যতা ২০ ভাগে নেমে এসেছে। মাথাপিছু আয় ২ হাজার ২২৭ মার্কিন ডলার, রিজার্ভ এখন ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রাজ্ঞ, সাহসী ও সুদৃঢ় নেতৃত্বের কারণে সারাবিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেশকে এগিয়ে যাচ্ছেন বিস্ময়কর গতিতে।
জাতীয় পার্টির আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, জাতির পিতা বলেছিলেন- বাঙালীকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। সেটাই আজ প্রমাণিত হয়েছে। মাথাপিছু আয়ে বাংলাদেশ আজ ভারতকেও পেছনে ফেলেছে। উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে মহামারী করোনা মোকাবেলায় কোন দিক-নির্দেশনা নেই। ভ্যাকসিন ছাড়া এই মহামারী নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না। আমরা এখন গরিব নই। তাই বিপদের দিনে মানুষকে আগে বাঁচাতে হবে।
গণফোরামের মোকাব্বির খান বলেন, দুর্নীতিবাজ কিছু প্রশাসনিক ও আমলাতন্ত্রের কারণে সরকারের অনেক অর্জনকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এই অসৎ ও দুর্নীতিবাজদের সিন্ডিকেটকে ধ্বংস করতে না পারলে বাজেটের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জিত হবে না। গত প্রায় দেড় বছর ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় একটি প্রজন্মের জীবন এখন ধ্বংসের পথে।
জাতীয় পার্টির ডাঃ রুস্তম আলী ফরাজী আমলাতন্ত্রের সমালোচনা করে বলেন, প্রশাসনের সর্বত্র দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। আমলারা দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। এখন বেগম পাড়ার কথা উঠেছে। কেউ বলেছে, এক হাজারের ওপরে বেগম পাড়া রয়েছে কানাডায়। কারা করেছেন? তাঁরা কী সব এমপি? অবশ্যই নয়, বেশিরভাগই সরকারী কর্মকর্তা, কিছু ব্যবসায়ী আর কিছু আমাদের নষ্ট রাজনীতিবিদ। প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশে করে তিনি বলেন, পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনা না গেলে দেশের অর্থনীতি সুন্দর হবে না। ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে, এদের আর কোন দয়া নয়। দুর্নীতিবাজদের সামনে নত হয়ে কথা বলা লাগলে তার চেয়ে দুঃখের আর কিছু হতে পারে না।
বিরোধী দলের চীফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, গত ১১ বছরে বিদ্যুতের দাম ৯০ ভাগ বেড়েছে, পানির দাম ১১ বার বাড়ানো হয়েছে। অনেক খাতেই এখন যেন দুর্নীতির উৎসব চলছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক লুটপাট ও বিদেশে অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটেছে। এসব পাচারকৃত অর্থ ফেরত এনে মানবকল্যাণে ব্যয় করতে হবে।
বিএনপির জাহিদুর রহমান অবিলম্বে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ পাঠানোর দাবি জানিয়ে বলেন, খালেদা জিয়া কার্যত গৃহবন্দী হয়ে আছেন। জাতি আজ মহাদুর্যোগকাল অতিক্রম করছে। ধনী-গরিবের বৈষম্য বেড়েই চলেছে। করোনাকালে নতুন করে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়ে গেছে।