পারিবারিক অপরাধ ॥ ইসলামী আইন ও তার প্রতিকার

42

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

সমাজের একক হচ্ছে পরিবার। সমাজের অস্তিত্বের জন্য সুষ্ঠু-সুন্দর ও অপরাধমুক্ত পারিবারিক জীবন অপরিহার্য। অথচ বিভিন্ন কারণে পারিবারিক জীবনে অপরাধ সংঘটনের হার ক্রমশ বাড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে পারিবারিক জীবনে সংঘটিত অপরাধ দমনে ইসলামের নির্দেশনা ও আইনসমূহের ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। প্রবন্ধে পরিবারের পরিচয়, অপরাধের পরিচয়, পারিবারিক জীবনে সংঘটিত অপরাধসমূহ, সংঘটিত অপরাধসমূহের কারণ, এসব অপরাধ দমনে ইলামের নির্দেশনা আলোচনা করা হয়েছে। প্রবন্ধটির মাধ্যমে পারিবারিক জীবনে অপরাধ সংঘটনের কারণসমূহ, অপরাধ যেন না ঘটে সে ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশনা জানা যাবে। গবেষণার ক্ষেত্রে বর্ণনামূলক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে।
পৃথিবীর প্রথম মানব-মানবী আদম ও হাওয়া আ. এর মাধ্যমে যে পরিবার ব্যবস্থার উৎপত্তি হাজার হাজার বছর পরেও তা বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষ, বস্তুবাদী জীবনধারা চর্চার অসুস্থ প্রবণতা, বিশ্বায়ন ও সাম্রাজ্যবাদের বহুমুখী আগ্রাসন, অপসংস্কৃতি ও ধর্মবিচ্যুতির প্রবলতার দ্রুত বিকাশমানতা, নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়, আর্দশহীন রাজনীতি ও সমাজনীতির বিস্তার, যে কো মূল্যে ক্ষমতা দখল ও অর্থ উপার্জনের প্রতিযোগীতাসহ বিভিন্ন কারণেও বহুবিধ নেতিবাচক উপাদানের উপস্থিতির ফলে পারিবারিক জীবনব্যবস্থা আজ হুমকির মুখে। অথচ ইসলাম মানুষে পারিবারিক জীবনকে সুন্দর ও শান্তিময় করার যাবতীয় ব্যবস্থা কুরআন ও সুন্নাহয় বর্ণনা করে দিয়েছে। ইসলামী মূল্যবোধের অবক্ষয় পারিবারিক জীবনে অপরাধের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। যেহেতু পারিবারিক জীবন ছাড়া মানবসমাজ ধ্বংস হয়ে যেতে বাধ্য, তাই বৃহত্তর স্বার্থে ও লক্ষ্যে ইসলাম পারিবারিক জীবনকে অপরামুক্ত করতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করেছে। যেগুলো বাস্তাবায়নের মাধ্যমে একদিকে যেমন পারিবারিক জীবন হুমকি মুক্ত হয়ে শান্তিময় ও সুশৃঙ্খল হবে, অপরদিকে সমাজ রাষ্ট্র ও বিশ্ব হবে নিরাপদ ও সৌহার্দ্যময়।
আভিধানিক অর্থে পরিবার বলতে পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, পোষ্যবর্গ, একান্নবর্তী সংসার, পত্নী ইত্যাদি বুঝায়। ইংরেজিতে পরিবারের প্রতিশব্দ হলো Family.  আরবীতে আহল, ‘আয়িলা উসরা শব্দাবলি দ্বারা পরিবার বুঝায়। উল্লেখ্য যে, আরবী শব্দ উসরাহ আসরুন শব্দ থেকে উদ্ভুত। এর অর্থ শক্তি। মানুষ তার আত্মীয়-স্বজন ও নিকতম ব্যক্তিবর্গ সমেত পরিবারের দ্বারপা শক্তিশালী হয় বলে এ নামকরণ করা হয়েছে। আল-কুরআনুর কারীমে উসরাহ শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি। আমাদের জানা মতে, ফকীহগণ তাদের কিতাবাদিতেও এ শব্দটি ব্যবহার করেননি। তবে বর্তমানে কোন ব্যক্তির পোষ্যবর্গ যেমন স্ত্রীসহ ঊর্ধ্বতন ও অধস্তন সদস্যগণকে বুঝাতে উসরাহ শব্দটি প্রয়োগ হচ্ছে। অতীতকালে ফকীহগণ পরিবার বুঝাতে আল, আহল ও ইয়াল শব্দসমূহ ব্যবহার করতেন। আল-কুরআনুল কারীম ও হাদীসেও পরিবার বুঝাতে উপরোক্ত তিনটি শব্দই ব্যবহার হয়েছে। পরিভাষায় পরিবার বলতে সাধারণত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজন ও নিকটতম ব্যক্তিবর্গকে বুঝায়। আল-মাওসূআতুল ফিক্হিয়্যাহ-তে পরিবারের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, পরিবার হলো কোন ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজন ও তার ঘরের লোকজন। সমাজবিজ্ঞানীগণ বিভিন্নজন বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবারকে সংজ্ঞায়িত করেছেন।
সমাজবিজ্ঞান শব্দকোষ-এ পরিবার এর পরিচয় লেখা হয়েছে এভাবে, পরিবার বলতে বুঝায় স্বামী-স্ত্রীর এমন একটি অপেক্ষাকৃত স্থীয় সংখ্যা, যেখানে সন্তান সন্ততি থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে। বস্তুত পরিবার হচ্ছে একটি ক্ষুদ্র সামাজিক সংগঠন, যেখানে স্বামী-স্ত্রী তাদের সন্তান সন্তুতি নিয়ে বসবাস করে। ব্যাপক অর্থে মাতা-পিতা, সন্তান সন্তুতি, নিকট রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয় এবং দাস-দাসী বা চাকর-চাকরানী নিয়েই হচ্ছে পরিবার। আল-ফিকহুল মানহাজী’ গ্রন্থে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে পরিবারের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ইসলামের দৃষ্টিতে পারিভাষিক অর্থে পরিবার বলতে বুঝায় বাবা-মা, দাদা-দাদী, নানা-নানী, ছেলে-মেয়ে ও নাতি-নাতনিদের সমন্বয়ে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে।
অপরাধ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে দোষ-ত্রুটি, আইন-বিরুদ্ধ কাজ, দন্ডনীয় কর্ম, পাপ, অর্ধম ইত্যাদি। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হল Crime, Offence, Fault, Defect, Sin, Guilt ইত্যাদি। অপরাধ বুঝাতে আরবীতে যানবুন, জারীমাহ, জিনায়াহ, খাতীআহ, ইছমুন, ইত্যাদি শব্দ ব্যবহৃত হয়।
পরিভাষায় সাধারণতভাবে সমাজবিরোধী কার্যকলাপ বা কোন সমাজে প্রচলিত লিখিত আইন বা প্রথাকে অমান্য বা লঙ্ঘন করাকে অপরাধ বলা হয়। সাধারণ অর্থে আইনত দন্ডনীয় বা নিষিদ্ধ কাজই অপরাধ। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মবিরোধী কোন কথা বা কাজই অপরাধ। অপরাধবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানে বিভিন্নভাবে অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। সমাজবিজ্ঞান শব্দকোষ-এ অপরাধ এর পরিচয়ে লেখা হয়েছে, সমাজ স্বীকৃত পথ ব্যতীত অন্য পথে চলা, আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে বেআইনী কাজ করাই অপরাধ। অর্থাৎ সরকার বা আইনসভা কর্তৃক অনুমোদিত নয়, এমন কাজ করা অপরাধ।
বিখ্যাত আইন বিশেষজ্ঞ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আবুর হাসান আল-মাওয়ারদী [৩৬৪-৪৫৫ হি.] রহ. অপরাধ এর সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে, ইসলামী শরীয়তে অপরাধ হলো শরঈ দৃষ্টিতে বর্জনীয় ঐ সকল কর্মকান্ড, যেগুলো সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা হদ্দ বা তাযীয় দ্বারা হুমকি প্রদান করেছেন। প্রখ্যাত আইনবিদ আব্দুল কাদের আওহাদ অপরাধ এর সংজ্ঞায় বলেন, অপরাধ হলো আইনত নিষিদ্ধ এরূপ কোনো কাজ সম্পাদন করা অথবা আইনত পালনীয় এরূপ কোনো কাজ করা থেকে বিরত থাকা।
পারিবারিক জীবনে যেসব সংঘটিত হয় সেগুলো মৌলিকভাবে সাধারণ অপরাধ থেকে ভিন্ন নয়। তবে কারণগত ও পদ্ধতিগত দিক থেকে কিছুটা ভিন্ন। পারিবারিক জীবনে সংঘটিত অপরাধ সংক্রান্ত ঘটনাবলি পর্যালোচনা করে দেখা যায়। এর সংখ্যা খুব বেশি নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, হত্যাকান্ড কিংবা শারীরিকভাবে আহত করার মধ্যেই এর অপরাধগুলো সীমাবদ্ধ থাকে। তবে ক্ষেত্রবিশেষে মানসিক ভাবে নির্যাতন করা হয়, যা কারো কারো ক্ষেত্রে শারীরিক নির্যাতনের চেয়েও বেশিস প্রভাব বিস্তার করে। এগুলো ছাড়াও গুম করা, ভয়ভীতি দেখানো ইত্যাদি অপরাধ ও সংঘটিত হয়। নিম্নে অপরাধসমূহ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলো: পারিবারিক জীবনে সংঘটিত অপরাধ সমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো খুন, খুনের হুমকি বা চেষ্টা, লাঞ্ছিতকরণ, অ্যাসিড নিক্ষেপ, শারীরিক নির্যাতন
ধর্ষণ ও ধর্ষণ-চেষ্টা, আত্মহত্যায় প্ররোচনা, যৌনবৃত্তিতে বাধ্য করা, যুক্তিসঙ্গত ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা, অর্থনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, যৌন নির্যাতন, মনস্তাত্তিক/ আবেগজনিত বা মানসিক নির্যাতন, অযৌক্তিক লিঙ্গ বৈষম্য, খোটা দেয়া, অপবাদ দেয়া, যৌতুক আদায়, কম খেতে দেয়া, অকথ্য গালিগালাজ, মাত্রাতিরিক্ত ঘাটানো, গায়ে অগুন ধরিয়ে দেয়া, অন্যায়ভাবে তালাক দেয়া, আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্ক রাখতে না দেয়া, ভরণ-পোষণের খরচ না দেয়া, যিনা ব্যভিচার লিপ্ত হওয়া, অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া, হিল্লা বিয়েতে বাধ্য করা, বৈষম্যমূলক গর্ভপাত, বাধ্যতামূলক গর্ভপাত ইত্যাদি। উপরোল্লিখিত অপরাধসমূহ ছাড়াও বহু ধরনের অপরাধ পারিবারিক জীবনে সংঘটিত হয়। যেগুলো দন্ডবিধিতে বা অন্য কোন আইনে সংজ্ঞায়িত হয়নি। তাই এই অপরাধগুলোকে অনেক ক্ষেত্রেই মামলাযোগ্য বা আদালনত বিচারযোগ্য নয়। যে কোন ঘটনা বা দুর্ঘটনার পিছনে কোন না কোন কারণ অবশ্যই থাকে। সেসব কারণ উদঘাটন ব্যতীত সমাধানের পথে হাঁটা প্রায় অসম্ভব। তাই সম্প্রতি দ্রুত ক্রমবর্ধমান পারিবারিক জীবনে অপরাধ দমনের উপায় বের করার পূর্বে এর কারনগুলো কি কি তা জানা আবশ্যক। সাধারণ যে কোন অপরাধের কারণ এবং পারিবারিক জীবনে সংঘটিত অপরাধের কারণ সবসময় এক হয় না। যদিও অপরাধের ধরন ও পদ্ধতি প্রায় একই হয়। বর্তমান গবেষণার উদ্দেশ্য যেহেতু পারিবারিক জীবনে সংঘটিত অপরাধ দমনে ইসলামের নির্দেশনা ও আইনসমূহের ভুমিকা জানা, সেহেতু সর্বপ্রথম পারিবারিক পরিমন্ডলে সংঘটিত অপরাধগুলো কেন ঘটছে, এর পিছনে কি কি করণ রয়েছে তা জানা জরুরি। তাই সংশ্লিষ্ট কিছু ঘটনা পর্যালোচনা করে এবং সংশ্লিষ্ট সাহিত্য পর্যালোচনা করে কিছু কারণ সংক্ষেপে নিম্নে বর্ণনা করা হলো:
অনুসন্ধানে দেখা গেছে পারিবারিক অপরাধের মধ্যে হত্যাকান্ড, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ইত্যাদির পেছনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থাকে পরকীয়া প্রেমের সম্পর্ক। পরকীয়া প্রেম বলতে সাধারণত নিজের স্বামী বা স্ত্রী বাদে অন্যের স্বামী বা স্ত্রীর কিংবা অন্য কারো সাথ অবৈধ প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করা। এক্ষেত্রে দুইপক্ষই বিবাহিত হতে পারে কিংবা এক পক্ষ বিবাহিত আর অপরপক্ষ অবিবাহিত হতে পারে। পরকীয় প্রেমকে দেশীয় ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে অবৈধ ও অনৈতিক মনে করা হলেও এটি এখন আর গোপন কিছু নয়। বিভিন্ন কারণে পরকীয় সম্পর্কের হার ক্রমশ বর্ধমান। আগে শুধু শহরে এ উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেলেও এখন তা প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। পরকীয় প্রেমের কারণে কোন এক পক্ষ কর্তৃক তার অবৈধ কর্মের বাধা হিসেবে আর্বিভূত ব্যক্তিকে হত্যা করা বা কারানোর প্রবণতা দৃশ্যমান। কখনো স্বামী তার স্ত্রীকে কিংবা স্ত্রী তার স্বামীকে হত্যা করে। সাথে সন্তান থাকলেও তারাও হত্যাকান্ড থেকে রেহাই পায় না। পরকীয় প্রেম এতো শক্তিশালী যে, এর সামনে যেই বাধা হয়ে দাড়াবে সেই হত্যাকান্ড কিংবা অন্য কোন অপরাধের শিকার হতে পারে। বিগত ২০১৫ সালের ৫ নভেম্বর তারিখে ঢাকায় মিরপুরে ব্যাংক কর্মকর্তা এক স্বামীর পরকীয়ার বলি হয়েছে তার স্ত্রী ও সাত বছরের শিশুপুত্র। এভাবে প্রায়শই পারিবারিক হত্যাকান্ড ঘটছে পরকীয় প্রেমের কারণে। পরকীয় প্রেম যেন এক মূর্তিমান আতঙ্ক। এটি একদিকে যেমন বাধাদানকারী নিকটাত্মীয়কে হত্যা করতে উৎসাহিত করে, অপরদিকে পরিবার ও সমাজকে হুমকির মুখে ঢেলে দেয়। তাই পারিবারিক জীবনে সংঘটিত অরাধের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে পরকীয় প্রেমকে দায়ী করা যায়। উল্লেখ্য যে, পরকীয় প্রেমে জড়িয়ে পরারও পেছনেও কিছু কারণ রয়েছে। সেগুলো পরবর্তী আলোচনায় ওঠে আসবে।
পশুর সাথে মানুষের যে কয়টি বিষয়ে পার্থক্য দৃশ্যমান সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চা। পশুর জীবনাচারে নৈতিকতার বালাই নেই বলে তাদের মূল্যবোধও নেই। তা নিয়ে কেউ প্রশ্নও তোলে না। কারণ তাদের নৈতিকতাহীন জীবনাচার সমাজজীবনে কোন প্রভাব ফেলেনা। কিন্তু মানুষের নীতি নৈতিকতাহীনতা ও মূল্যবোধহীনতা মানবসমাজকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে জোর গলায় নৈকিতা ও মূল্যবোধের কথা বলা হলেও তার চর্চা ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত অনুপস্থিত। নৈতিকতা ও মূল্যবোধ এখন শুধু পাঠ্যপুস্তুকে সীমাবদ্ধ। ব্যক্তির পরিবার বা সমাজের দায়িত্বকে অস্বীকার না করেই বলা যায়, রাষ্ট্র যেভাবে তার নাগরিকদের নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে সংরক্ষণ করতে পারে অন্য কেউ তা সেভাবে পারে না।
বাংলাদেশের জনগণ এতটা নৈতিকতাহীন পূর্বে কখনো ছিলনা যতটা আজ দেখা যাচ্ছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আগমন দেশের যুবসমাজের জন্য আর্শীবাদ না হয়ে সর্বনাশ ডেকে আনছে। আজকাল পারিবারিক জীবনে সে অপরাসমূহগ দেখা যাচ্ছে যেগুলোর অনেকাংশের পিছনে ব্যক্তির নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অভাবকে বিশেষজ্ঞগণ দায়ী করেছেন। কিশোর-কিশোরী বা যুবক-যুবতীর প্রেম, পরকীয় প্রেম ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে অনেক ক্ষেত্রে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। বলা বাহুল্য, যথাযথ নীতি-নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের ছায়ায় গড়ে ওঠা কোন ব্যক্তি এরূপ অপরাধ ঘটাতে পারে না। তাই পারিবারিক জীবনে সংঘটিত অপরাসমূহের পিছনে নীতি-নৈকিতার অনুপস্থিতি ও মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় অনেকাংশেই অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে।
ওয়ারিছ সূত্রে প্রাপ্ত জমির ভাগ-বন্টনকেন্দ্রিক ঝগড়া পারিবারিক অপরাধের একটি বড় কারণ। সাধারণত দেখা যায়, পিতার রেখে যাওয়া সম্পত্তির বণ্টন ও দখল পাওয়াকে কেন্দ্র করে ভাই-ভাই কিংবা চাচা-ভাতিজা অথবা পরিবারের অন্য কারো মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টি হয়। যা পর্যায়ক্রমে মারামারি থেকে খুনোখুনি পর্যন্ত পৌছায়। প্রায়শই পত্রিকার পাতায় দেখা যায়, জমি বন্টনকে কেন্দ্র করে ভাইয়ের হাতে ভাই খুন। পার্থিব সম্পদের প্রতি অতিমাত্রার মোহ আপন ভাইকে হত্যা করতেও বাধা দেয় না। দেশের নিম্ন আদলতে এবং উচ্চ আদালতে বিচারাধীন মামলার একটি বড় অংশই হচ্ছে জমি-জামা কেন্দ্রিক মামলা। পরবর্তীতে মামলাকে কেন্দ্র করে পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক দ্বন্ধ আরো প্রকট আকার ধারন করে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বংশানুক্রমিক ভাবে এসব মামলা চলতে থাকে। ফলে জমিতো কেউ ভোগ করতে পারে না, উপরন্তু মামলার পিছনে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়।
মন ও দেহের যৌথ সুস্থতার ওপর ব্যক্তির সার্বিক জীবনাচার নির্ভর করে। ব্যক্তির মানসিক বিষন্নতা তার স্বাভাবিক কর্মকান্ডকে শুধু ব্যবহতই করে না, বরং তা তাকে অনেক ক্ষেত্রে হিংস্র করে তোলে। তাই মানসিক বিষন্নতাকে অপরাধ বিশেষজ্ঞগন অপরাধের কারণ হিসেবে মনে করেন। সমাজবিজ্ঞানীগণ বলেছেন, যৌথ পরিবার ভেঙে বস্তুতান্ত্রিক নগরব্যবস্থার একক পরিবারের একাকিত্বে মানুষ বিষণ্ন হয়ে পড়ছে। ফলে বাড়ছে পারিবারিক কলহ। ধীরে ধীরে তা ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে নৃশংসতায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের Social Welfare Research  এর অধ্যাপক রবিউল ইসলাম বলেন, সামাজিক আদর্শ ও মূল্যবোধের পরিবর্তন হচ্ছে। শিল্পায়ন, নগরায়ন, বস্তুতান্ত্রিক চিন্তাচেতনা আমাদের একাকী করে দিচ্ছে। যৌথ পরিবার ভেঙ্গে যাচ্ছে। সামাজিক বিকাশ ব্যবহত হচ্ছে। মানুষ যখন মানসিকভাবে বিষন্ন হয়ে পড়ে, তখন সে তার হিতামিহ জ্ঞান হারিয়ে যে কোন অপরাধে যুক্ত হতে পারে।
মানবজীবন আনন্দময় ও উপভোগ্য করার ক্ষেত্রে প্রাচীনকাল থেকেই সংস্কৃতির কার্যকর ভুমিকা রয়েছে। দেশ-কাল-ধর্ম ভেদে সংস্কৃতির বৈচিত্র্যও লক্ষনীয়। বাংলাদেশে অনুসৃত দেশজ সংস্কৃতি ও ধর্মীয় সংস্কৃতি যথেষ্ট মার্জিত ও পরিশীলিত। যদিও কোন কোন ক্ষেত্রে দেশজ সংস্কৃতি বা অন্য ধর্মীয় সংস্কৃতির সাথে দেশের নব্বই শতাংশ জনগোষ্ঠীর ইসলাম ধর্মীয় সংস্কৃতির সাথে পার্থক্য ও বিরোধীতা দেখা যায়। গত কয়েক দশক যাবৎ স্যাটেলাইট মিডিয়া ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিদেশী, বিশেষ করে ভারতীয় ও পশ্চিমা সংস্কৃতি এদেশে অবাধে প্রবেশ করেছে এবং সর্বস্থরের জনগণের দেশীয় ও ধর্মীয় মুলবোধের বিরোধী অনুষ্ঠান প্রচার করছে। যার ফলে দেশের শিশু-কিশোর ও তরুন-যুবকরা সংস্কৃতি চর্চার নামে অপসংস্কৃতিতে ঢুবে যাচ্ছে। বিভিন্ন স্যাটেলাইট চ্যানেলে প্রচারিত নাটক, সিনেমা, সিরিয়াল ইত্যাদির মাধ্যমে অপসংস্কৃতির বীজ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করিয়ে দেয়া হচ্ছে। এসব মাধ্যমে অবৈধ প্রেম, পরকীয়া প্রেম, বউ-শাশুড়ির যুদ্ধ, দেবর-ভাবির অবৈধ ঘনিষ্টতাসহ নানাবিধ নষ্ট, ভ্রষ্ট ও অশ্লীল অপসংস্কৃতি মুসলিম সমাজে প্রভাব ফেলছে। বিভিন্ন নাটক, সিনেমা ও সিরিয়ালে আসক্ত আজকের যুব ও নারী সমাজ এসব দেখে সেগুলোকে নিজেদের জীবনাচার হিসেবে গ্রহণ করছে। এসব অসংস্কৃতির কৃ-প্রভাবে পরিবার পর্যন্ত ভেঙ্গে যাচ্ছে। তাই পারিবারিক অপরাধ ক্রমশ যে বাড়ছে তার পিচনে অপসংস্কৃতিও একটি বড় ভুমিকা পালন করছে বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন।
পরিবার হলো মানবশিশুর প্রথম শিক্ষাকেন্দ্র। এখানে মা-বাবা ও অন্যান্য সদস্যদের অনুশাসনে শিশুরা বড় হয়। শিশু-কিশোররা এই বয়সে যথাযত পারিবারিক অনুশাসনে না থাকলে পরিবারে বিশৃঙ্খলা অনিবার্য। বর্তমান পাশ্চাত্যে পরিবার ব্যবস্থা অবহেলিত এবং অনেক ক্ষেত্রে নেই বললেই চলে। তাই তাদের সংস্কৃতি ও জীবন ব্যবস্থা অনুসরণ করে আমাদের সমাজেও পরিবার ব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়েছে। ফলে পারিবারিক অনুশাসন ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। পরিবারে ছোটবেলা থেকে অনুশাসনের মধ্যে বড় না হলে সন্তান অনেক ক্ষেত্রে দায়িত্বহীন ও স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে এদের দ্বারাই বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারিবারিক অপরাধ সংঘটিত হয়। তাই পরিবারের অভ্যন্তরে পারিবারিক অনুশাসন না থাকাও পারিবারিক অপরাধে অন্তুনির্হিত কারণ বলে প্রতীয়মান হয়।
পরিবারের এক সদস্যের সাথে অপর কোন সদস্যের ভূল বোঝাবুঝি কোন কারণে ঝগড়া বিবাদে কিংবা রাগারাগি কখনো অপরাধ সংঘটনের দিকে নিয়ে যায়। বিশেষ করে স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য কোন্দল অনেক ক্ষেত্রে এক পক্ষ কর্তৃক অপরপক্ষকে হত্যা পর্যন্ত করতে দ্বিধা করে না। কখনো এই কোন্দলের, বিশেষ করে স্বামী-স্ত্রীর কোন্দলের কারণে একটি পরিবার ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। দাম্পত্য কোন্দলের পেছনে সাধারণত যৌতুক, পরকীয়া প্রেম, অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িত হওয়া, পুত্র সন্তানের আকাঙ্কা, কন্যা সন্তানকে বোঝা মনে করা, পর্দা ব্যবস্থা না মানা, একই পরিবারে বিপরীত সংস্কৃতির অনুসরণ, পারিবারিক বৈষম্য, আত্মীয়-স্বজনের সাথে বিরোধ ইত্যাদি কারন অনুঘটক হিসেবে কাজ করে।
বাংলাদেশে পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন অন্যতম। তাছাড়া দন্ডবিধি সহ অন্যান্য আইনেও পারিবারিক অপরাধের বিচার করা সম্ভব। কিন্তু আইনগুলোর যথাযথ প্রয়োগ খুব কমই হয়। অনেক ক্ষেত্রে বিচারিক দীর্ঘসূত্রিতার কারণে ভুক্তভোগীরা আইনের আশ্রয় নেন না। পারিবারিক সম্মান বিনষ্টের আশঙ্কায় অনেকে আইনের শরণাপন্ন হতে দেন না। (অসমাপ্ত)