২০৪০ সালে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে আইনের সংশোধন জরুরি

6

আ ফ ম রুহুল হক :

২০১৬ সালের ৩০ জানুয়ারি। এদিন থেকে ঢাকায় সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) অর্জন সম্পর্কিত দুই দিনব্যাপী দক্ষিণ এশিয়া স্পিকার্স সম্মেলন শুরু হয়। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সহযোগিতায় ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন (আইপিইউ) এবং তামাকমুক্ত শিশু প্রচারাভিযান কার্যক্রম এ সম্মেলনের আয়োজন করে। সোনারগাঁও হোটেলে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান, মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কার সংসদের স্পিকাররা অংশ নেন। সম্মেলনে মূল ফোকাস পয়েন্ট ছিল তামাক নিয়ন্ত্রণ প্রচারণার ওপর। সম্মেলনের শেষ দিন ৩১ জানুয়ারি সমাপনী ভাষণ প্রদান করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর সেদিনই তিনি ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাক ব্যবহার নির্মূল করার ঘোষণা দেন। এ ঘোষণাটি এতটাই যুগোপযোগী ও প্রাসঙ্গিক ছিল যে তামাকবিরোধী সব সংস্থাসহ সর্বক্ষেত্রে তা প্রশংসিত হয়। পৃথিবীর ইতিহাসেও বিষয়টি রীতিমতো নজির স্থাপন করে। কারণ এর আগে কোনো দেশের কোনো সরকারপ্রধান তামাক নির্মূলে এমন নির্দিষ্ট টাইম ফ্রেমের ঘোষণা দেননি।
অবশ্য এর আগে ২০০৫ সালে বাংলাদেশ সরকার এফসিটিসির আলোকে ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫’ প্রণয়ন করে। এরপর ২০১৩ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনা হয় এবং এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়।
আমরা জানি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুনত্বের উদ্ভব হয়। নতুন নতুন চাহিদা ও সমস্যার বিষয়ও সামনে আসে। আগে তামাক কম্পানিগুলো যেভাবে তাদের প্রচার-প্রচারণা চালাত, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারাও প্ল্যান-প্রগ্রাম পরিবর্তন করছে। ফলে ২০০৫-এর পর থেকে আইনের মাধ্যমে যেভাবে তামাকের ব্যবহার ধীরে ধীরে কমে আসতে শুরু করেছে, সেটির ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য হলেও আগামী দিনগুলোতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্য তামাকের ব্যবহার কমিয়ে আনতে আইনের সংশোধন প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভের (গ্যাটস) ২০১৭-এর রিপোর্টে তামাক ব্যবহারের বেশ কিছু বিষয় উঠে এসেছিল। সেই বিষয়গুলোতে দৃষ্টি রাখলে তামাক ব্যবহারের ভয়াবহ কিছু চিত্র দেখা যাবে।
গ্যাটসের রিপোর্ট মোতাবেক, তামাক ব্যবহারকারীর প্রায় অর্ধেক মারা যায় তামাকের কারণে। আর বিশ্বজুড়ে প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর প্রধান আটটি কারণের ছয়টির সঙ্গেই তামাক জড়িত। তামাক ব্যবহারকারীদের তামাকজনিত রোগ, যেমন হৃদরোগ, স্ট্রোক, সিওপিডি বা ফুসফুসের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি ৫৭ শতাংশ বেশি এবং তামাকজনিত অন্যান্য ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি ১০৯ শতাংশ বেশি। এ কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর এক লাখ ৬১ হাজারেরও বেশি মানুষ তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারজনিত রোগে মৃত্যুবরণ করে।
প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে ৩৫ শতাংশ তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করে। সংখ্যার হিসাবে যা সাড়ে তিন কোটিরও বেশি। আবার ১৩ থেকে ১৫ বছরের অপ্রাপ্তবয়স্করাও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার থেকে পিছিয়ে নেই। শতকরা হিসাবে সেটিও প্রায় ৬.৯ শতাংশ।
যারা ধূমপান করে না; কিন্তু পরোক্ষভাবে ধূমপানের ক্ষতির শিকার হয়, এমন মানুষের সংখ্যা সামগ্রিকভাবে মোট ধূমপায়ীর সংখ্যার চেয়েও বেশি। সংখ্যার হিসাবে তা প্রায় চার কোটি মানুষ, যা প্রত্যক্ষ ধূমপায়ীর চেয়ে বেশি।
তবে বাংলাদেশে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ফলে তামাক নিয়ন্ত্রণে বেশ অগ্রগতি হয়েছে। ২০০৯ ও ২০১৭ সালে পরিচালিত গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে থেকে সেটি দেখা যায়। ২০০৯ সালের চেয়ে বর্তমানে তামাকের ব্যবহার তুলনামূলকভাবে ১৮.৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে (রিলেটিভ রিডাকশন)। এ ক্ষেত্রে ধূমপানে ২২ শতাংশ তুলনামূলক হ্রাস এবং ধোঁয়াবিহীন তামাকের ব্যবহারে ২৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি সত্ত্বেও তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩৫ লাখ কমেছে। বিভিন্ন পাবলিক প্লেসে পরোক্ষ ধূমপানের হার, যেমন রেস্তোরাঁয় ৩০ শতাংশ, কর্মক্ষেত্রে ১৯ শতাংশ, হাসপাতালে ১১ শতাংশ ও গণপরিবহনে প্রায় ১০ শতাংশ কমেছে, যা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক।
২০১৩ সালে আমি স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকাকালীন বর্তমান সরকার জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে আইনটি সংশোধন করে। প্রায়োগিক দিক বিবেচনা করলে দেখা যায়, বর্তমান আইনের বেশ কিছু জায়গা সংশোধন ও পরিমার্জন করার সুযোগ রয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অন গ্লোবাল টোব্যাকো এপিডেমিক ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ধূমপানমুক্ত পরিবেশ এবং তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করার বিষয়ে এখনো সর্বোত্তম মান অর্জনের ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি। জনস্বাস্থ্য, বিশেষ করে কিশোর ও তরুণদের জন্য নতুন হুমকি ই-সিগারেটের মতো ইমার্জিং টোব্যাকো প্রডাক্ট নিষিদ্ধ করার বিষয়ে এখনো বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য গ্রহণ করা হয়নি।
আবার সব ধরনের তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কের ৫০ শতাংশজুড়ে সচিত্র সতর্কবাণী মুদ্রণ বাধ্যতামূলক করা হলেও মোড়কের আকার নির্ধারণ করা হয়নি। ফলে বিড়ি ও ধোঁয়াবিহীন তামাক দ্রব্যের ক্ষুদ্র আকারের মোড়কে সচিত্র সতর্কবার্তা সেভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। বিদ্যমান আইনে গণপরিবহন ও রেস্তোরাঁগুলোতে ক্ষেত্র বিশেষে ধূমপানের সুযোগ পরোক্ষ ধূমপান নিয়ন্ত্রণ বাধাগ্রস্ত করছে। বিক্রয়কেন্দ্রে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা হয়নি। বিড়ি-সিগারেটের সিংগেল স্টিক বা খুচরা শলাকা বিক্রি নিষিদ্ধ নয়। ই-সিগারেটের মতো ইমার্জিং টোব্যাকো প্রডাক্টগুলো আমদানি ও বিক্রয় নিয়ন্ত্রণ বা নিষিদ্ধের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। সব ধরনের তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কের আকার/আয়তন নির্ধারণ না করায় সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। তামাক কম্পানির ‘সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচি’ বা সিএসআর কার্যক্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়নি।
ডাব্লিউএইচওর (হু) রিপোর্ট মোতাবেক বললে নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের ৪৩টি দেশে বিক্রয়কেন্দ্রে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ হয়েছে। অনুরূপভাবে বিশ্বের ৮৬টি দেশে সিগারেটের খুচরা শলাকা বিক্রি নিষিদ্ধ। অথচ আমাদের দেশের আইনে বিড়ি-সিগারেটের খুচরা শলাকা বিক্রির বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই।
সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় তামাক নিয়ন্ত্রণ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তবে এ বিষয়গুলো সমাধানের জন্য বিদ্যমান আইনের সংশোধনের বিকল্প নেই বলেই মনে করছি। আর তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ২০৪০ সালে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করে আগামী প্রজন্মকে একটি তামাকমুক্ত দেশ উপহার দেওয়ার জন্য ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন সংশোধন করার প্রতি সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবার কাছে অনুরোধ রইল।
লেখক : সংসদ সদস্য ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী।