হবিগঞ্জে আর্থিক সঙ্কটে ঝিমিয়ে পড়ছে সাংস্কৃতিক চর্চা

13

কাজিরবাজার ডেস্ক :
সিলেট বিভাগে সংস্কৃতির চারণভূমি হিসেবে পরিচিত হবিগঞ্জ। বছরজুড়ে এ জেলা জমজমাট থাকতো ভাটিয়ালি গানের আসর আর মঞ্চনাটকের উৎসবে। কালের পরিক্রমায় এখন তার ছিটেফোঁটাও নেই। প্রায় দেড় দশক ধরে জেলায় নেই কোনো বড় উৎসব। বর্ণমালা, খেলাঘর বর্ষবরণের আয়োজনে সীমাবদ্ধ। আর শিল্পকলায় হয় শুধুই সরকারি অনুষ্ঠানাদি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে জেলার ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোতে এখন দৈন্যদশা। আর্থিক সঙ্কটে কোনো আয়োজনই করতে পারছেন না সাংস্কৃতিককর্মীরা। তার ওপর উল্টো গুনতে হচ্ছে হল ভাড়া। শুধু নাটকের দিনে নয়, রিহার্সেল বা মহড়ায়ও ভাড়া দিতে হয়। ফলে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে মঞ্চনাটক, ভাটিয়ালি আসরসহ সাংস্কৃতিক চর্চা ও আয়োজন।
তবে কেউ কেউ বলছেন, আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে মঞ্চনাটকসহ ঐতিহ্যবাহী ভাটিয়ালির আসরে এখন মানুষের আগ্রহ কমেছে। নাট্যকর্মী সঙ্কটও রয়েছে। অল্প সময়ে সস্তা পরিচিতি পেতে আনাড়ি শিল্পীরা ফেসবুক-ইউটিউবের জন্য বিভিন্ন নাটক, মিউজিক ভিডিও বানাতে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছেন। তারা মঞ্চনাটকে আসতে আগ্রহী নয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হবিগঞ্জে ১৫টিরও বেশি সাংস্কৃতিক সংগঠন রয়েছে। আছে দু’টি শিশু সংগঠনও। নতুন-পুরোনো মিলে রয়েছে পাঁচটি অডিটেরিয়াম ও হল। সেগুলো হলো- পৌরসভার মালিকানাধীন এম সাইফুর রহমান টাউন হল, কিবরিয়া পৌর মিলনায়তন, শিল্পকলার মালিকানাধীন শিল্পকলা ভবন, জেলা পরিষদের মালিকানাধীন জেলা পরিষদ অডিটেরিয়াম ও হবিগঞ্জ সাংস্কৃতিক পরিষদের অধীনে আর ডি হল (পুরাতন শিল্পকলা অ্যাকাডেমি)।
এর মধ্যে সাইফুর রহমান টাউন হলের দৈনিক ভাড়া ছয় হাজার টাকা। কিন্তু নাটকের জন্য তিন হাজার টাকা। আগে ভাড়া ছিল ২০০ টাকা। রিহার্সেল বা মহড়ার জন্য কোনো ভাড়া ছিল না। কিন্তু এখন মহড়ার জন্যও ভাড়া দিতে হয়। কিবরিয়া অডিটরিয়ামের ভাড়া দৈনিক ১০ হাজার টাকা। কিন্তু এটি শহরের এক প্রান্তে নির্জন স্থানে হওয়ায় সেখানে কেউ যেতে চান না। সাউন্ড সিস্টেমও ভাল না।
শিল্পকলার ভাড়া ৭-৯ হাজার টাকা। যা এখনও চূড়ান্ত নির্ধারণ হয়নি। জেলা পরিষদ অডিটেরিয়াম নাটকের জন্য উপযুক্ত না হওয়ায় সেখানে কেউ যায় না। আর আর ডি হল ভাঙাচুরা হওয়ায় সেখানেও নাটক বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের উপযুক্ত পরিবেশ নেই।
জেলার প্রাচীন নাট্য সংগঠন খোঁয়াই থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক ইয়াছিন খাঁ জানান, ২০০৬ সাল থেকে মূলত নাটক ও সাংস্কৃতিক উৎসবে ঐতিহ্যবাহী হবিগঞ্জ পিছিয়ে পড়েছে। পুরোনো টাউন হল ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণের পর থেকেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এখন অনেক বড় বড় মঞ্চ হয়েছে, সুউচ্চ ভবন হয়েছে। সঙ্গে এগুলোর ভাড়াও বেড়েছে।
তিনি বলেন, ‘এখানে (হবিগঞ্জে) যারা নাট্যচর্চা করেন, তাদের নিজেদের পকেট থেকে খরচ করে কাজ করতে হয়। পৃষ্ঠপোষকতা নেই বললেই চলে। আগে সরকার থেকে কিছু দেয়া হতো। এখন তাও দেয়া হয় না। রিহার্সেলের জন্য কোনো টাকা দিতে হতো না। এখন সেটা লাগে। রিহার্সেলের পর্যাপ্ত জায়গা নেই। এতো টাকা হল ভাড়া দিয়ে অনুষ্ঠান করার সাধ্য আসলে সংগঠনগুলোর নেই।’
ইয়াছিন খাঁ বলেন, ‘সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় বছরে একটি অনুদান দিতো। কিন্তু গত ১৫ বছর ধরে খোঁয়াই থিয়েটার তা পায় না। মানুষ এখনও মঞ্চ নাটক দেখতে চায়। কিন্তু পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকায় সংগঠনগুলো নাটক মঞ্চায়নে সাহস পায় না। তাও নিজেরা অনেক কষ্টে বিভিন্ন সময় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।’
মঞ্চশিল্পী প্রভাষক সুকান্ত গোপ জানান, একাধিক নতুন ও আধুনিক হল নির্মাণ হয়েছে ঠিক, কিন্তু এগুলোর মঞ্চের ডিজাইন পরিকল্পিত হয়নি। আবার আগে যেখানে খুব অল্প টাকায় নাট্যসংগঠনগুলো হল ভাড়া পেতো, সেখানে এখন কয়েকগুণ বেশি টাকা দিতে হয়। যা সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর জন্য রীতিমতো বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
আরেক মঞ্চশিল্পী জোবায়েদ হোসেন মনে করেন আকাশ সংস্কৃতিকর কারণেই মঞ্চ নাটক ও ঐতিহ্যবাহী আয়োজন হারিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘মঞ্চনাটকে আসলে ব্যাপকভাবে পরিচিতি মেলে না। অথচ ফেসবুক, ইউটিউবে খুব সহজেই অল্প সময়ে সস্তা পরিচিতি মেলে। ফলে এখন অনেকেই মঞ্চে আসতে চায় না।’
জোবায়েদ হোসেন বলেন, ‘নতুন প্রজন্মের মঞ্চের প্রতি আগ্রহ কমেছে। আনাড়ি শিল্পীরা নিম্নমানের নাটক, টেলিফিল্ম নির্মাণ করে ফেসবুক, ইউটিউবে প্রচার করছে। তাতেই মানুষের আগ্রহ বেশি।’
বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অনিরুদ্ধ কুমার ধর শান্তনু জানান, সরকারি অনুদান পেতে ঝামেলার শেষ নেই। সংগঠকরাও বিভক্ত। নাটক চর্চার হলগুলো পাওয়া যায় না। সবাই ফিস চান।
তিনি বলেন, ‘একটা হল ভাড়া নিতে লাইট, এসিসহ ৭-৮ হাজার টাকা দিতে হয়। শিল্পকলার ভাড়া ২০১৫ সালের নীতিমালা অনুযায়ী দৈনিক সাড়ে তিন হাজার টাকা। কিন্তু তারা এখন সাড়ে ৯ হাজার টাকা চাইছেন।’
তরুণ নির্মাতা ও পরিচালক মুক্তাদির ইবনে সালাম বলেন, দেশবরেণ্য শিল্পী সুবির নন্দী, ঝুনা চৌধুরী, মরমী সাধক শেখ ভানু, দ্বীনহীন, সৈয়দ শাহনুরদের মতো গুণীজনের জন্ম হয়েছে। অথচ পৃষ্ঠপোষকতার জন্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পিছিয়ে পড়ছে। এক সময় জেলা প্রশাসন থেকে পৃষ্ঠপোষকতা করা হতো। সংগঠনগুলোকে টাকা দেয়া হতো। এখন তেমন কোনো বরাদ্দ নেই।’
জানতে চাইলে শিল্পকলা অ্যাকাডেমির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান আহ্বাক কমিটির সদস্য শামীম আহমেদ জানান, কেন্দ্র থেকে যে প্রোগ্রাম দেয়া হয়, সেগুলো তারা পালন করেন। জেলা প্রশাসনের অনুষ্ঠানগুলোও পালন করেন। তবে গত বছরের মার্চ থেকে করোনার কারণে কোনো অনুষ্ঠানা করা হচ্ছে না।
শামীম আহমেদ দাবি করেন, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে তারা সব ধরণের সহযোগিতা করেন। আগামী এক বছরের জন্য হলভাড়াও না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। রিহার্সেল বা নাটকে কোনো ভাড়া নয়। উল্টো আর্থিক সহযোগিতা করা হয় বলে দাবি করেন তিনি।