বিভাগীয় মামলার নিষ্পত্তি সম্পর্কে কিছু কথা

7

শুভ্রেন্দু ভট্টাচার্য :

সরকারী কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপীল বিধি অনুযায়ী কোন সরকারী কর্মচারী যদি চাকরিকালে শৃঙ্খলা ভঙ্গজনিত কার্যকলাপে লিপ্ত হয় সেক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজু করার বিধান রয়েছে। কর্মচারী কর্তৃক জনস্বার্থবিরোধী বা গুরুতর অপরাধের আশঙ্কা থাকলে অভিযোগের তথ্য পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে চাকরি হতে সাময়িক বরখাস্ত করা যেতে পারে। বিভাগীয় মামলার ক্ষেত্রে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিধিতে নির্দেশিত পদ্ধতি অনুসরণ করে কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত কর্মচারীকে অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় লঘু বা গুরুদন্ড আরোপ করতে পারেন। কর্তৃপক্ষের সংজ্ঞায় সাধারণত নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকেই বোঝানো হয়। কিন্তু মূল কর্তৃপক্ষ হচ্ছেন রাষ্ট্রপতি। তাঁর পক্ষে সাধারণত অভিযুক্ত কর্মচারী যে প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় বা বিভাগে কাজ করেন সে অধিক্ষেত্রের সচিব বা বিশেষ আদেশ দ্বারা কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করা হয়।
এই বিধি সরকারী কর্মচারীর কোন দেওয়ানি বা ফৌজদারি অপরাধ সংঘটনের বিচার সম্পর্কিত নয়। বিধিতে কর্মচারীর দায়িত্ব পালনকালে অসদাচারণ, পলায়ন (ডিসারশন), দুর্নীতি, নাশকতা, রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ, নৈতিক স্খলন ইত্যাদি শৃঙ্খলাবিরোধী কার্যকলাপের জন্য বিভাগীয় মামলার তদন্ত ও বিচারের পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়েছে। বিধিতে অপরাধ প্রমাণিত হলে লঘু ও গুরু এরূপ দুধরনের দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। কোন অপরাধের জন্য কি শাস্তি হবে সে সম্পর্কেও বিধিতে উল্লেখ আছে। যেমন- দুর্নীতি, নাশকতা ইত্যাদি গুরুতর অভিযোগ প্রমাণিত হলে গুরুদন্ড প্রদান করতে হবে এবং এ সমস্ত অভিযোগের ক্ষেত্রে তদন্ত পদ্ধতিও বিধিতে নির্দেশিত আছে। গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে শুধু কারণ দর্শানোর জবাবে অভিযুক্তকে প্রাথমিক শুনানি দিয়ে কর্তৃপক্ষ তিরস্কারের মতো লঘুদন্ড প্রদান করে মামলা নিষ্পত্তি করতে পারবে না, যা অনুমিত লঘুদন্ডের মামলায় হতে পারে।
প্রসঙ্গত, বিভাগীয় মামলাকে কোয়াসি জুডিসিয়াল মামলার সমতুল্য বিবেচনা করায় নিষ্পত্তির পদ্ধতিতে কর্তৃপক্ষকে যথাসম্ভব আদালতের মামলা নিষ্পত্তির পদ্ধতি অনুসরণ করাই সঙ্গত। কতিপয় ক্ষেত্রে বিভাগীয় মামলার নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে কোর্ট মামলায় নিষ্পত্তি পদ্ধতির সঙ্গে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। অবশ্য বিভাগীয় মামলার ক্ষেত্রে সাক্ষ্য আইনের বিধান প্রযোজ্য নয়। এ ধরনের মামলায় ল’ অব ইকুইটি বা ন্যাচারেল জাস্টিসের নীতিমালা অনুসরণ করা হয়। তাৎপর্য এই যে, ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করতে আইনগত পদ্ধতি যথাসম্ভব অনুসরণ করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। অভিযুক্ত কর্মচারীকে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য যুক্তিসঙ্গতভাবে পর্যাপ্ত সুযোগ প্রদান করতে হবে। এ লক্ষ্যে তদন্তকালে তার বিরুদ্ধে উপস্থাপিত সাক্ষীদের জেরা করার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ দেয়া প্রয়োজন। প্রয়োজনে ন্যায়বিচারের স্বার্থে কোন সাক্ষীকে রিকল করতে চাইলে অভিযুক্তকে সে সুযোগও প্রদান করা যেতে পারে। অভিযুক্ত কর্মচারীকে প্রয়োজন হলে তার পক্ষে বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য অন্য কোন অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীকে নিয়োগ প্রদানের সংস্থান রাখা যায়। বিভাগীয় মামলায় যদিও কর্মচারীর পক্ষে আইনজীবী নিয়োগের বিধান নেই, কিন্তু মামলার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত বা প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত কোন বিষয় হলে তার পক্ষে ব্যাখ্যা দানের জন্য তদন্তকালে উকিলের সাহায্য গ্রহণ করলে ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করা যায়।
বিভাগীয় মামলা কুয়াসি জুডিসিয়াল হলেও বিচারিক মামলার কার্যক্রম হতে ভিন্ন ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এখানে অভিযুক্ত কর্মচারীকে কারণ দর্শানো হতে শুরু করে প্রাথমিক শুনানি অন্তে নিষ্পত্তি আদেশ, অভিযোগনামা প্রণয়ন, তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ, আইও’র প্রতিবেদন পর্যালোচনা থেকে কর্মচারীর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পর্যন্ত সকল ক্ষমতাই কর্তৃপক্ষের ওপর ন্যস্ত থাকে। প্রাথমিক শুনানিতে কর্তৃপক্ষ মনে করলে অপরাধীকে অব্যাহতি/দোষী সাব্যস্ত করে সিদ্ধান্ত দিতে পারেন; নতুবা বিধি মোতাবেক অন্যান্য পদ্ধতি অনুসরণ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। বিচারিক মামলার মতো এক্ষেত্রে কার্যত মামলা প্রমাণের জন্য বাদীপক্ষ (প্রসিকিউশন), তদন্তকারী সংস্থা, বিবাদীপক্ষে সাধারণত আইনজীবীর মাধ্যমে যুক্তিতর্ক, সাক্ষীদের জেরা, বিবাদী পক্ষে সাক্ষী, উভয়পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন ইত্যাদির কোন আনুষ্ঠানিক পদ্ধতির সংস্থান নেই। এখানে বাস্তব ক্ষেত্রে অভিযুক্ত কর্মচারীকেই কর্তৃপক্ষ এবং তদন্তকারী অফিসারের নিকট আত্মপক্ষ সমর্থনে, জবাব দাখিল, বক্তব্য উপস্থাপন, নথিপত্র পেশসহ ইত্যাদি সার্বিক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়।
এখানে যে বিষয় নিয়ে প্রশ্ন জাগে তা হলো কর্তৃপক্ষ মামলার চূড়ান্ত আদেশ দেন, তিনিই আবার বিবাদীকে কারণ দর্শান, অভিযোগনামা প্রণয়ন করেন, আইও নিয়োগ করেন, শুনানি ইত্যাদি বাদীপক্ষের মতো সকল দায়িত্ব নির্বাহ করেন। একই ব্যক্তি যদি শুনানি গ্রহীতা, অভিযোগ প্রণেতা, আইও’র রিপোর্ট পর্যালোচনা ইত্যাদিসহ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রদান করেন তা হলে বিচারিক পুরো পদ্ধতিকেই প্রকৃতিগতভাবে একপেশে মনে হওয়ার অবকাশ থাকে। এখানে কর্তৃপক্ষকেই মনে হয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরকার পক্ষের সকল দায়িত্ব পালন করছেন। কর্তৃপক্ষ যদি বাদীপক্ষের মতো কাজ করেন সেক্ষেত্রে অভিযুক্ত কর্মচারী স্বাভাবিকভাবেই তাকে মানসিকভাবে প্রতিপক্ষ মনে করতে পারে যে, বিষয়টি ল’ অব ইকুইটি এবং ন্যাচারেল জাস্টিসের নীতিমালার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে নাও হতে পারে। তাছাড়া অভিযুক্ত কর্মচারীকে আত্মপক্ষ সমর্থনের পর্যাপ্ত সুযোগ প্রদানের কথা বিধিতে বলা হলেও বাস্তব ক্ষেত্রে একক প্রচেষ্টায় উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সামনে একজন সাময়িক বরখাস্তকৃত কর্মচারীকে কর্তৃপক্ষ, আইও তথা সমগ্র প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনেক ক্ষেত্রে দোষী না হলেও নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য মনোবলের অভাব হতে পারে। অবশ্য প্রকৃত দোষী কর্মচারীর জন্য নথিপত্র পরীক্ষায়ই অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে রেকর্ড পর্যালোচনায় অনেক কিছু স্পষ্টরূপে ভেসে ওঠে।
অন্যদিকে, বিধিতে একজন কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা নিষ্পত্তির একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা দেয়া আছে। সময়সীমার মধ্যে তদন্ত ও মামলা নিষ্পত্তি না হলে অভিযুক্ত কর্মচারীর অভিযোগ হতে অব্যাহতির বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রায়ই সময়সীমার মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি সম্ভব হয় না। এতে করে একদিকে যেমন অভিযুক্তের দুর্ভোগের মাত্রা বাড়তে থাকে, অন্যদিকে মামলা দীর্ঘায়িত হওয়ায় হতাশাগ্রস্ত কর্মচারীর কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। চাকরিতে পুনর্বহাল হলেও সে প্রত্যাশিত সেবাদানে সক্ষম থাকে না। আবার মামলা দীর্ঘায়িত হলে ডিপি কেসে বিচারাধীন একজন কর্মচারীকে দীর্ঘকাল ওএসডি হিসেবে কর্মহীন সময় কাটাতে হয়। এ অবস্থায় একদিকে তার কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়, অন্যদিকে সমাজের কাছে হেয়প্রতিপন্ন হয়। পক্ষান্তরে চাকরিজীবীগণ অনেক সময় স্বেচ্ছায় হোক বা অজ্ঞতায় অথবা ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঘটনাচক্রে গুরুতর অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। কোন সময় দেখা যায় এ ধরনের অপরাধ সংঘটিত হওয়ার ফলে সরকার বা জনসাধারণের বিপুল পরিমাণ অর্থের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কর্মচারীদের বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলনের দৃষ্টান্তও বিরল নয়। যেমন কিছুদিন পূর্বে এক জেলা প্রশাসকের সঙ্গে তার মহিলা পিয়নের অনৈতিক সম্পর্কের কথা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। যদিও এ সমস্ত আচরণ ফৌজদারি অপরাধের শামিল, তথাপি সরকারী কর্মচারী হওয়ায় বিধি মোতাবেক বিভাগীয় মামলায়ই এ ধরনের গুরুতর অভিযোগের নিষ্পত্তি করা হয়।
এখন পদ্ধতিগত কারণে ক্ষমতার এককেন্দ্রীকতা থাকায় কর্তৃপক্ষের পক্ষে অনেক ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ জটিল হয়ে পড়ে। কারণ মামলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তাকে এককভাবেই নিতে হয়। এখানে সহায়তা গ্রহণের কোন সুযোগ নেই। তাছাড়া সরকারী অর্থ আত্মসাৎ বা সরকারী অর্থ অপচয়ের বিষয় থাকলে এ সমস্ত ঘটনায় অনেক সময় প্রভাবশালী মহলের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হওয়ার বিষয় থাকে। এ অবস্থায় সিদ্ধান্তদাতা কর্মকর্তাকে অনেক সময় বিভিন্নমুখী চাপের সম্মুখীন হতে হয়।
মামলা নিষ্পত্তির বিলম্বের কারণেও অনেক সময় কোন গুরুতর অপরাধে জড়িত কর্মচারী অব্যাহতি পেয়ে যায়। এ কথা অনস্বীকার্য, নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে একজন সচিব, মহাপরিচালকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী ব্যক্তিগণকে প্রশাসনিক, উন্নয়নমূলক, সভা, সমিতি, প্রটোকল ইত্যাদি কাজে এত ব্যস্ত থাকার কারণে ডিপি কেসের নথি অনেক ক্ষেত্রে সময়সীমার মধ্যে নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয় না। ফলে মামলার স্তূপ বাড়তে থাকে, ওএসডির সংখ্যাধিক্য হয়, দীর্ঘদিন কাজ না থাকায় অনিশ্চয়তার মাঝে থেকে হতাশাগ্রস্ত কর্মচারীর কাজের স্পৃহা ও ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং সর্বোপরি সরকারী কোষাগার থেকে বেতন-ভাতা বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়।
সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনায় মনে হয় বিধিতে নির্দেশিত সময়সীমার মধ্যে মামলা নিষ্পত্তিকরণ সম্ভব হলে এর সঙ্গে জড়িত অন্যান্য সমস্যারও সমাধান হয়। যেমন- ওএসডির সংখ্যা হ্রাস, সরকারী অর্থের অপচয় রোধ, ভোগান্তি কমিয়ে কর্মচারীর মনোবল চাঙ্গা রাখা, সময়সীমা অতিক্রমের কারণে প্রকৃত অপরাধীর অভিযোগ হতে অব্যাহতির সুযোগ না পাওয়া, তদবির ও কর্তৃপক্ষের ওপর অহেতুক চাপ প্রয়োগের সুযোগ সঙ্কোচন এবং সর্বোপরি মামলার জট কমানো, লোকবলের অভাব দূরীকরণ ইত্যাদি। উল্লেখিত লক্ষ্য অর্জনে ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করার স্বার্থে ডেলিগেশন অব পাওয়ারের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের দ্বারা উদ্ভূত সমস্যার কিছুটা সমাধান হতে পারে। বিচার প্রক্রিয়ার অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো বিভাগীয় মামলার বিচার পদ্ধতিতেও জাস্টিস ডিলেইড, জাস্টিস ডিনাইডের মতো জনশ্রুতি ভাবনায় রাখা প্রয়োজন।
লেখক : সাবেক সরকারী চাকরিজীবী।