পিন্টু দেবনাথ কমলগঞ্জ থেকে :
চা বাগান অধ্যুষিত মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলা। এ উপজেলায় নানা সম্প্রদায়ের বসবাস রয়েছে। বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মধ্য চা শ্রমিক ও শব্দকর সমাজ। তারা যেমন শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত তেমনি বিভিন্ন পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অভাবে বিভিন্ন রোগ বিরাজমান থাকে। তাছাড়া স্বল্প শিক্ষিতের কারণে বাল্য বিবাহ দেয়ার ফলে ক্রমশ মাতৃ মৃত্যু বেড়েছে। এছাড়া স্যানিটেশন ও বিশুদ্ধ পানি পর্যাপ্ত না থাকা এবং বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। এসব এর মূল কারণ হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি উন্নতি করতে পারে না। শুরুতে শিক্ষা, শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। একজন মানুষ শিক্ষিত হলে মনের দিক থেকে অনেক কিছু করতে পারে। তাই প্রতিটি মানুষের শিক্ষা গ্রহণ করা অধিকার। এ ব্যাপারে অভিভাবকের পাশাপাশি সরকার ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বাস্তবমুখী শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
কমলগঞ্জের চা বাগান এলাকার প্রাথমিক শিক্ষার বেহাল অবস্থায় পরিণত হয়েছে। একটি জরাজীর্ণ বিদ্যালয়ে তাকালে বুঝা যায় এটি বিদ্যালয় নয় এমনিতেই একটি ঘর পড়ে আছে। শিক্ষার পরিবেশ ছাড়া শিক্ষা দেয়া বা গ্রহণ করা কষ্টের। মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের কুরমা চা বাগান। বাগান কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পরিচালিত ৪ জন শিক্ষক দিয়ে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত “কুরমা চা বাগান প্রাথমিক বিদ্যালয়”। এই বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের সম্মানী মাত্র ১২০০/- টাকা। এই টাকা সম্মানী পেয়ে ১ম শ্রেণী থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত শিশুদের ক্লাস নিচ্ছেন। জরাজীর্ণ একটি ঘরের মাঝখানে বাঁশের বেড়া দিয়ে দুইটি কক্ষ করা হয়। বিদ্যালয়টির দরজা জানালা নেই বললেই চলে। ভাঙাচোরা ডেস্ক বেঞ্চ আছে গোটা দশেক আর চেয়ার টেবিল মাত্র ২ টা। শিক্ষকদের বসারই জায়গা নেই। ২ টি টয়লেট থাকলেও এক ধরনের অকেজো। কোন টিউবওয়েল নেই। এই বিদ্যালয়টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটকেন্দ্র। গত ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের আগের দিন রাতে এই ঘরেই মহিলা আনসার সহ ১৫ জন মানুষকে বসে বসে রাত কাটাতে হয়েছে। এলাকার ভোটার সংখ্যা ৩৭২২ জন। আশপাশে ৫/৬ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে আর কোন প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই।
কুরমা চা বাগানের মন্দির ভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা প্রাক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক অধীর কায়স্ত লালা বলেন, বাগানের প্রাথমিক বিদ্যালয় নানা সমস্যায় জর্জরিত। আমার একটি মেয়ে ৪র্থ শ্রেণীতে পড়ে। কোন কিছুই পারে না। শিক্ষার আলো থেকে এভাবে অন্যান্য শিশুরাও বঞ্চিত হচ্ছে। দূরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকায় শিক্ষার্থীরা যেতে পারছে না। কি নিধারুন কষ্টের মধ্যে চা বাগানের শিশুরা রয়েছে। এলাকার অনেক শিশু এখনো অক্ষর জ্ঞানহীন। এরা শুধু চা শ্রমিকের সন্তান বলেই কি এত উদাসীনতা? কমলগঞ্জের বিভিন্ন চা বাগানে চা বাগান কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিদ্যালয় একই অবস্থা।
অন্যদিকে বলা যায়, শব্দকর সম্প্রদায়ের শিক্ষার সুযোগ রয়েছে। কমলগঞ্জ উপজেলায় অধিকাংশ পাড়ায় পাড়ায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিদ্যালয়ে খাতায় দেখা যায় শব্দকর সমাজের ছাত্রদের নাম তালিকাভুক্ত রয়েছে। তারা নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছে। তাদের অভিভাবকরা বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করছেন। কারণ হিসাবে জানা গেল, বিদ্যালয়ে ঠিক মতো উপস্থিত না হলে উপবৃত্তি থেকে বঞ্চিত রাখা হবে। শিশু পড়–ক আর নাই বা পড়–ক বিদ্যালয়ে যেতে হবে। সরজমিন শব্দকর সমাজের অনেক শিশুকে জিজ্ঞাসা করা হলে অধিকাংশই বিশেষ করে ৫ম শ্রেণী, ৪র্থ শ্রেণী. ৩য় শ্রেণীর ছাত্ররা পারে না। আবার কোন মতে ৫ম শ্রেণীর পাস করার পর ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হতে চায় না বা অভিভাবকরা এ ব্যাপারে আর চাপ সৃষ্টি করে না। ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হতে ভর্তি ফি বাবত ১২/১৫শ টাকা এরপর নিয়মিত মাসিক বেতন। এসব টাকা না দিতে পারায় অনেক শব্দকর সমাজের শিশুরা নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে গ্রামগঞ্জে দেখা যায়, পিতার পেশা রিক্সা চালিয়ে যায় না হয় যে কোন শিশুশ্রমে লগে যায়। এসব কারণেই শিশুরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
কমলগঞ্জ উপজেলার চা শ্রমিক ও শব্দকর সমাজের শিশুরা নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি ভাবে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেয়া হলে হয়তো তারা এগিয়ে আসবে। কোন গোষ্ঠী শিক্ষা থেকে পিছিয়ে থাকলে সমাজ বা দেশের উন্নয়ন করা সম্ভব হয় না। তাই জরুরি ভিত্তিতে এ সকল সমস্যা নিরসনে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।