কাজিরবাজার ডেস্ক :
শনিবার বেলা ১টা ৫০। প্রবীণ আইনজীবী রফিক-উল হক তার প্রিয় কর্মস্থল বা ভালোবাসার জায়গা সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে এলেন। তবে এবার তার আসার ধরণ একেবারে ভিন্ন। শেষবারের মতো তিনি এলেন কফিনে মোড়ানো নিথর শরীরে।
প্রিয় মানুষটিকে বিদায় আর জানাযায় অংশ নিতে এরইমধ্যে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে জড়ো হয়েছেন প্রিয় সহকর্মীরা। বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা সেরে বেলা ২টার একটু পরে কোর্ট মসজিদের ইমাম আবু জাফরের ইমামতিতে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়।
জানাযা শেষ হওয়ার আগেই আকাশ থেকে অঝরে ঝরতে থাকল বৃষ্টি। যেন প্রিয় মানুষকে শেষ বিদায় জানানোর জন্যই আকাশের এই কান্না! কোর্ট প্রাঙ্গণে ভারাক্রান্ত মনে প্রিয় সহকর্মীকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন, মৎস্য ও প্রাণীসম্পদমন্ত্রী আইনজীবী শ ম রেজাউল করিম, ঢাকা দক্ষিণ সিটি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন।
প্রিয় রফিক-উল হককে স্মৃতিচারণে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘একজন পরিপূর্ণ আইনজীবী ছিলেন। এক-এগারোর সময় তিনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে কারাগার থেকে মুক্ত করতে লড়াই করেন। দল-মত নির্বিশেষে সবার উপকার করেছেন তিনি। তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।’
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘তার অবদান জাতি কোনোদিন ভুলবে না। এদেশের আইনজীবীরা কখনও রফিক-উল হককে ভুলতে পারবে না। তিনি তার কর্মের মাধ্যমে আমাদের সবার মাঝে বেঁচে থাকবেন।’
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী ও আইনজীবী শ ম রেজাউল করিম বলেন, ‘ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের মৃত্যুতে বিচারব্যবস্থায় অতুলনীয় ক্ষতি হলো, আইন অঙ্গনে অতুলনীয় ক্ষতি হলো। তিনি যেমন আইন অঙ্গনের প্রবীণ পুরোধা ছিলেন তেমনি সাংবিধানিক বিষয়েও তার অপরিসীম দক্ষতা ছিল।’
সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে মুক্ত করতে ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের আইনি লড়াইয়ের কথা পুরো রাজনৈতিক অঙ্গনের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে বলে মনে করেন আইনজীবী শ ম রেজাউল করিম।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ও আইনজীবী ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘এক-এগারোর ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিন সরকারের সময় যখন আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মিথ্যা মামলায় কারারুদ্ধ করা হলো, তখন সব আইনজীবী মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানায়। একমাত্র ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেছিলেন- জাতির পিতার কন্যার মামলা আমি লড়বো। সেই আইনি লড়াইয়ে তিনি নেত্রীকে মুক্ত করেছিলেন। তেমনি গণতন্ত্রকে পুনঃরুদ্ধার করেছিলেন। সেই দিন তিনি আদালতে দাঁড়িয়েছিলেন বলেই ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচন সম্পূর্ণ হয়েছিল। তার জীবনীকে মূল্যায়ন করতে হবে।’
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘উনি অথরিটি ছিলেন। উনি যা বলতেন সেটাই অথরিটি। তার এই মৃত্যু আইন জগতে বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি করল। আমরা তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।’
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল রফিক-উল হক শনিবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে রাজধানীর আদ-দ্বীন হাসপাতালে মারা যান। তিনি দফা জানাজা শেষে তার মরদেহ বনানী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়েছে।
রফিক–উল হকের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিশিষ্টজনেরা।
দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ভাবমূর্তি রক্ষায় বরাবরই সোচ্চার ছিলেন রফিক-উল হক। দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক ও আইনি বিষয় নিয়ে সরকারকে সহযোগিতা করেছেন জাঁদরেল এই আইনজীবী।
১৯৯০ সালের ৭ এপ্রিল থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন রফিক-উল হক। কিন্তু কোনো সম্মানী নেননি। পেশাগত জীবনে তিনি কখনো কোনো রাজনৈতিক দল করেননি। তবে নানা সময়ে রাজনীতিবিদরা তাকে পাশে পেয়েছেন। রাজনীতিবিদদের সম্মান সবসময়ই অর্জন করেছেন তিনি।