মো: আব্দুল মালিক :
বাঙালি জাতির জীবনে নানা যুদ্ধ হয়েছে। তবে নিকট অতীতের দুটি যুদ্ধই উল্লেখযোগ্য। প্রথমটি পলাশীর যুদ্ধ, দ্বিতীয়টি মুক্তিযুদ্ধ। প্রথম যুদ্ধে পরাজয়, দ্বিতীয় যুদ্ধে বিজয়। এই নিবন্ধে উক্ত দুটি যুদ্ধের একটি বিশেষ মিল নিয়ে আলোচনা করব। পলাশীর যুদ্ধ হয় নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ও ক্লাইভ বাহিনীর মধ্যে। উক্ত যুদ্ধ হঠাৎ করে শুরু হয় নাই। এর পিছনে বহু ইতিহাস ও বহুদিনের ষড়যন্ত্র ছিল। সেই ষড়যন্ত্রে শুধু বৃটিশরা জড়িত ছিলনা, জড়িত ছিল সিরাজ-উদ-দৌলার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ আত্মীয় মীরজাফর আলী খান, ঘসেটি বেগমরাও। ২৩শে জুন পলাশীর প্রান্তরে উভয় পক্ষে যুদ্ধ হয়। উক্ত যুদ্ধে নবাবের সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৫০,০০০। কামান ছিল ৫০টি। ইংরেজদের সৈন্যসংখ্যা ছিল মাত্র ৩,০০০। নবাবের পক্ষে মীরমদন, মোহনলাল ও সিঁনফ্রে প্রাণপণে যুদ্ধ করতে থাকেন। নবাবের প্রধান সেনাপতি বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর তার বিশাল বাহিনী নিয়ে নিরব থাকে। মীরমদন ও মোহনলালের প্রাণপণ যুদ্ধের সম্মুখে ইংরেজ বাহিনী টিকে থাকতে না পেরে পিছু হটতে শুরু করে। এমন সময় মীরমদন নিহত হন। স্বজাতি শত্রুদ্বারা পরিবেষ্ঠিত নবাব হতাশ হয়ে পড়েন। অন্যকোনো উপায় না দেখে তিনি মীরজাফরের স্মরণাপন্ন হন। বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ছুঁয়ে শপথ করে বলেছিল সাহায্য করবে কিন্তু করেনি। মীরজাফর মুখে সাহায্য করার কথা বললেও তার অন্তরে ছিল বিশ্বাসঘাতকতা। সে নবাবকে পরামর্শ দিলো সেদিনের মতো যুদ্ধ বন্ধ করতে। নবাবও মীর জাফরের সর্বনাশা সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে মোহনলালকে যুদ্ধ বন্ধের আদেশ দেন। মোহনলাল যুদ্ধে জয় নিশ্চিত জেনে প্রথমে সে আদেশ মানেন নি। কিন্তু নবাবের পুনঃপুনঃ আদেশে তিনি যুদ্ধ বন্ধ করতে বাধ্য হন। মোহনলালের যুদ্ধ বন্ধের মধ্য দিয়ে নবাবের পতন তরান্বিত হয়। নবাবের ৫০,০০০ সৈন্যের বিরাট বাহিনী ও ৫০টির বেশি কামান থাকা সত্বেও মাত্র ৩০০০ সৈন্যের ইংরেজ বাহিনীর কাছে নবাবের শোচনীয় পরাজয়!!!
যুদ্ধের বিচারে পলাশীর যুদ্ধ তেমন বড় কোন যুদ্ধ ছিল না। এ যুদ্ধে ইংরেজদের মাত্র ২৩জন সৈন্য নিহত ও ৪৯ জন আহত হয়। নবাবের ৫০০ সৈন্য শহীদ হন। কিন্তু এই যুদ্ধের সুদূর প্রসারী ফল ছিল অনেক অনেক বেশি। এই যুদ্ধের ফলে বণিকের মানদন্ড রাজদন্ডে উন্নীত হয়। বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়। কালক্রমে পুরো ভারত উপমহাদেশ ইংল্যান্ডের অধীনে চলে যায়। বহু আত্মত্যাগের বিনিময়ে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান এবং ভারত স্বাধীন হয়। বাঙালিরা এক পরাধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে আরেক পরাধীনতার শৃংখলে আবদ্ধ হন। পাকিস্তানের সাথে যোগ দেয়ার মাত্র ২৪ বছরের মধ্যে বাঙালিদেরকে আরেকটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়। সেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাতে। মুক্তিযুদ্ধ হঠাৎ করে শুরু হয়নি। এর পটভূমি অনেক ব্যাপক। এর পিছনে রয়েছে ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যূত্থান, ৭০’র সাধারণ নির্বাচন ইত্যাদি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগের সরকার গঠনের কথা ছিল। বাঙালিরা পাকিস্তানের শাসক হবে এটা পশ্চিম পাকিস্তানীরা কল্পনাও করতে পারে না। তাই শুরু হলো পর্দার অন্তরালে নানা ষড়যন্ত্র।
পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর না করার উপায় হিসেবে বেছে নেয় শক্তি । সেই শক্তি প্রয়োগের নিমিত্তে টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর নিয়োগ করে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি এবং বাঙালি সৈনিকদের নিরস্ত্র করার পরিকল্পনা করে। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ৭১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বিমানে করে প্রথম একদল সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানে এসে পৌঁছে। ঐদিন এম.ভি সোয়াত জাহাজও ১০ হাজার টন অস্ত্র, গোলাবারুদ নিয়ে চট্টগ্রামে বন্দরে এসে পৌঁছে। সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র গোলাবারুদ, ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসার চেষ্ঠা করলে বন্দরের শ্রমিকরা বাঁধা দেয়। তারা এসব অস্ত্র গোলাবারুদ জাহাজ থেকে নামাতে অস্বীকৃতি জানায়। পরবর্তী সময়ে ডক শ্রমিকদের সাথে চট্টগ্রাম সরকারী কর্তৃপক্ষের একটি চুক্তি হয়। সেই চুক্তি অনুযায়ী জাহাজের অস্ত্র, গোলাবারুদ নামিয়ে বন্দরে রাখা হবে, ক্যান্টনমেন্টে নেওয়া হবে না। ১লা মার্চ ইয়াহিয়া কর্তৃক অধিবেশন স্থগিত ঘোষনার প্রেক্ষিতে ৩রা মার্চ প্রদেশেব্যাপী হরতালের সময় চট্টগ্রামে নিরস্ত্র বাঙালিদের মিছিলে অবাঙালিরা হামলা চালায়। এর সাথে যোগ দেয় ২০ বেলুচের সৈনিকরা। ঐদিন প্রায় ১০০ বাঙালি নিহত ও বহু বাঙালি আহত হন। এই সময় চট্টগ্রামে বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় প্রতিদিনই খুন-জখম, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি হত।
২০ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এডজুটেন্ট জেনারেলকে সঙ্গে নিয়ে চীফ অব স্টাফ জেনারেল হামিদ চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে যান। সেখানে তিনি ষ্টেশন কমান্ডার বাঙালি ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ও অন্যান্য বাঙালি অফিসারকে পাশ কাটিয়ে ২০ বালুচ রেজিমেন্টের পাকিস্তানী কমান্ডিং অফিসার লে. কর্ণেল ফাতমীর অফিসে যান এবং গোপন সলাপরামর্শ করে বিকালে ঢাকা চলে যান। ঐদিন চট্টগ্রামের বেসামরিক প্রশাসনের কাছে ‘মার্শাল ল’ হেডকোয়ার্টার থেকে একটি নির্দেশ আসে। এই নির্দেশে বলা হয় শহরের সকল বন্দুকের দোকান ও রাইফেল ক্লাবে যেসব বন্দুক ও গুলি রয়েছে, সেগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসতে। সে অনুযায়ি ২১ মার্চ বন্দুকের দোকান থেকে পুলিশ বন্দুক সরিয়ে আনতে গেলে ক্ষুদ্ধ জনতা পুলিশকে বাঁধা দেয়। কোন অবস্থাতেই তারা বন্দুক সরিয়ে নিতে দিবে না। শেষ পর্যন্ত একটি সমঝোতা হল। সমঝোতা অনুযায়ি দোকানগুলোতে দুটি করে তালা লাগিয়ে সেগুলো সীল করে রাখা হবে, একটির চাবি থাকবে জনগণের পক্ষে আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের কাছে, অন্যটি থাকবে জেলা প্রশাসকের কাছে।
২৪ মার্চ সকাল বেলা চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে আসেন ১৪ ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ও মেজর জেনারেল মিঠ্ঠা খান। ষ্টেশন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার মজুমদার তাদের অভ্যর্থনা জানান। সেখান থেকে তারা চলে যান ২০ বালুচ রেজিমেন্টে। তারপর পোর্ট এলাকায় এবং শেষে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। এসব জায়গায় মিঠ্ঠা খান চালাকি করে বাঙালি ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে নিয়ে যেতেন একদিকে, সেই সুযোগে খাদিম হোসেন রাজা অবাঙালি সিনিয়র অফিসারদের সাথে গোপন পরামর্শ সেরে নিতেন। ৮ম ইস্ট বেঙ্গলে খাদিম হোসেন রাজা জানতে চান এ ইউনিট কেন তখন পর্যন্ত তাদের ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্র জমা দেয় নি ? সেগুলো অবিলম্বে জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে তিনি ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যান। ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে যেই হেলিকাপ্টারে তিনি এসেছিলেন, সেই হেলিকাপ্টরে করে তিনি ঢাকা রওয়ানা হলেন, সঙ্গে নিয়ে গেলেন চট্টগ্রামের দায়িত্বে নিয়োজিত বাঙালি ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে। ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ঢাকা গিয়েই তাঁর পাকিস্তানী পুরাতন বন্ধু ব্রিগেডিয়ার আবরারের সাথে দেখা করেন। আবরার মজুমদারকে জানান তাঁকে চট্টগ্রাম থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং তাঁর স্থলে ব্রিগেডিয়ার আনসারীকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য ব্রিগেডিয়ার আনসারীকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং অতি সঙ্গোপনে তাঁকে চট্টগ্রামে রেখে যাওয়া হয়। হেলিকপ্টারটি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলে পাকিস্তানী ব্রিগেডিয়ার আনসারি ঘোষনা করেন ব্রিগ্রেডিয়ার মজুমদারের দায়িত্ব তিনি গ্রহণ করেছেন।
ব্রিগ্রেডিয়ার আনসারীর ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে ঐ দিনই সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র-গোলাবারুদ নামানোর কাজ শুরু হয়। যেহেতু ডক শ্রমিকরা আগে থেকে অস্ত্র, গোলাবারুদ নামাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল তাই সেখানে ই.বি.আর.সির রিক্রুটদের নিয়োগ করা হলে চট্টগ্রামের জনগণ প্রচন্ড বিক্ষোভে পথে নেমে আসল। পোর্ট এলাকা থেকে ক্যান্টনমেন্ট পর্যন্ত সমস্ত রাস্তায় অসংখ্য ব্যারিকেড সৃষ্টি করল। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে আনসারী ব্যারিকেড সরাতে সেনাবাহিনী নিয়োগ করলেন। তিনি ২৫ মার্চ অস্ত্র খালাসের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে প্রচেষ্ঠা চালান। আর বীর চট্টলাবাসী তা প্রতিরোধের জন্য সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্ঠা করতে থাকেন।
পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত একমাত্র চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট নিয়েই পশ্চিম পাকিস্তানীদের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ছিল সবচেয়ে বেশী। তার কারন চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে বাঙালি অফিসার-সৈনিকদের আধিক্য। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের অধিনায়ক অর্থাৎ জিওসি ছিলেন ২৪ মার্চ পর্যন্ত বাঙালি ব্রিগেডিয়ার মাহমুদুর রহমান মজুমদার, প্রধান প্রশিক্ষক লে. কর্ণেল এম আর চৌধুরী সহ অন্যান্যরা বাঙালি। পাকিস্তানী একমাত্র ২০ বালুচ রেজিমেন্টের অধিনায়ক লে. কর্ণেল ফাতমী সৈন্যসংখ্যা মাত্র ৩০০। ৮ম ইস্ট বেঙ্গল সহ আরো কয়েকটি ছোট ছোট ইউনিটে কিছু পাকিস্তানী সৈন্য ছিল। সর্বমোট পাকিস্তানী সৈন্য সংখ্যা হবে ৫০০। ই.বি.আর.সি এবং ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ২৩০০ বাঙালি সৈন্য রয়েছে। ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিলেন মেজর জিয়া। অন্যদিকে চট্টগ্রামে ই.পি.আর-এ বাঙালি সৈন্যের সংখ্যা প্রায় ১৬০০, পাকিস্তানী সৈন্যের সংখ্যা প্রায় ৫০০। ই.পি.আর-এ কর্মরত একমাত্র বাঙালি উর্ধ্বতন কর্মকর্তা হচ্ছেন ক্যাপ্টেন রফিক। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা পাকিস্তানী মেজর সিদ্দিক সালিক তার ‘উইথনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে এই অসম সৈন্য সংখ্যার উল্লেখ করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
মেজর রফিক তাঁর ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ বইতে সে সময়কার চট্টগ্রামের পরিস্থিতি ও তাঁর ভূমিকা সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। তাঁর বই পাঠে জানা যায়- তিনি চট্টগ্রামে কর্মরত উর্ধ্বতন সামরিক অফিসার, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে সময়ে সময়ে মতবিনিময় করেছেন। যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছেন, প্রতিরোধ সংগ্রামে বীরত্বের সঙ্গে লড়েছেন। তিনি আরও লিখেছেন ২৪ মার্চ তিনি পশ্চিমা অফিসার সৈনিকদেরকে নিরস্ত্র করে গ্রেফতার সহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তাঁর অধীনস্থ ইউনিটগুলোকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেদিন রাতে লে. কর্ণেল এম আর চৌধুরী ও মেজর জিয়া ক্যাপ্টেন রফিকের বাসায় যান এবং আলোচনা করেন। ক্যাপ্টেন রফিক বলেন, ‘এখনই আক্রমন করে ওদের ধ্বংস করতে হবে, অন্যথায় ওরা আমাদের সবাইকে জবাই করে ফেলবে’। জবাবে মেজর জিয়া বলেন, ‘চিন্তা করো না রফিক, ওরা এমন চরম ব্যবস্থা নিবে না।’ লে. কর্ণেল এম আর চৌধুরীও এতে সায় দিলেন। ওনারা ক্যাপ্টেন রফিককে বললেন, ‘এখনই তোমার সৈন্যদের কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা থেকে থামিয়ে দাও’। পরিস্থিতির প্রতিকূলতায় সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করেও রফিক তা স্থগিত করতে বাধ্য হন। ২৫ মার্চ রাত ৮:৪৫ মিনেটের দিকে ক্যাপ্টেন রফিক তাঁর স্থগিত কার্যক্রম আবার শুরু করেন। বিভিন্ন ইউনিটে আবার পূর্বের ম্যাসেজ পাঠান এবং রাজনৈতিক নেতাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকেন। এদিকে মেজর জিয়া ২৫ মার্চ রাত ১টার সময় তাঁর পাকিস্তানী কমান্ডিং অফিসার জানজুয়ার নির্দেশে বন্দরে যাচ্ছিলেন অস্ত্র খালাসের জন্য। ইতোমধ্যে ক্যাপ্টেন রফিক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে অনুরোধ করেন ষোলশহরে মেজর জিয়া ও ইবিআরসিতে তাঁর তৎপরতার খবর পৌঁছে দিতে।
রফিকের ম্যাসেজ নিয়ে যিনি গিয়েছিলেন, তিনি জিয়াকে না পেয়ে তাঁরই অধীনস্থ একজন বাঙালি অফিসারের নিকট ম্যাসেজটি দিয়ে আসেন। এদিকে ক্যাপ্টেন রফিক ১১:৪৫ মিনিটের মধ্যে ইপিআরের পাকিস্তানী সৈনিক ও অফিসারদের গ্রেফতার করে পুরো চট্টগ্রাম প্রায় তাঁর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। তাঁর পূর্ব ধারণা থেকে অনুমান করেন লে. কর্ণেল এম আর চৌধুরী ও মেজর জিয়া ক্যান্টনমেন্ট ততক্ষণে তাঁদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু না, জিয়া যখন তাঁর পাকিস্তানী কমান্ডারের নির্দেশ পালন করতে বন্দরে যাচ্ছেন অস্ত্র খালাস করতে, তখন ২০ বালুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা ইবিআরসিতে ঘুমন্ত বাঙালি সৈন্যদের উপর এবং তাঁদের পারিবারিক বাসস্থানে অতর্কিত আক্রমন চালিয়ে লে. কর্ণেল এম আর চৌধুরী সহ প্রায় ১০০০ সৈনিককে হত্যা করে।
এদিকে ক্যাপ্টেন রফিকের ম্যাসেজ ক্যাপ্টেন অলি ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানকে দেন। তিনি মেজর জিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। রাস্তায় ব্যারিকেড সরিয়ে যেতে মেজর জিয়ার দেরী হচ্ছিল। তাই আগ্রাবাদের নিকট খালেকুজ্জামান জিয়াকে পেয়ে যান এবং এক পাশে নিয়ে তাঁকে ব্যাপারটা বললে জিয়া মত পরিবর্তন করে ষোল শহরে ফিরে আসেন। ষোল শহরে এসে তিনি ৮ম ইস্ট বেঙ্গলকে নিয়ে বৈঠকে বসেন এবং করণীয় ঠিক করেন। এই বৈঠকে জুনিয়র অফিসারদের কেউ কেউ ইবিআরসিতে বাঙালি সৈনিকদের সাহায্যে যাওয়ার জন্য মত দেন কিন্তু উর্ধ্বতন অফিসাররা সেখানে যাওয়া নিরাপদ নয় বা বেলুচ রেজিমেন্টের সাথে যুদ্ধে জড়ানো আত্মঘাতি হবে বলে মত দেন। এই মত পাথর্ক্যরে ফলে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল ক্যান্টনমেন্টের দিকে না গিয়ে মেজর জিয়ার নেতৃত্বে শহর ছেড়ে পটিয়ার দিকে চলে যায়।
১৯৭২ সালে মেজর জিয়াউর রহমানের একটি লেখা প্রকাশিত হয়। উক্ত লেখায় জিয়া অনেক কিছু লিখেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘সশস্ত্র সংগ্রাম যেকোন সময় শুরু হতে পারে আমরা ধরে নিয়েছিলাম। মানসিক দিক দিয়ে আমরা ছিলাম প্রস্তুত। পরদিন আমরা পথের ব্যারিকেড অপসারনের কাজে ব্যস্ত ছিলাম। তারপর এলো সেই কালোরাত। রাত ১টায় আমার কমান্ডিং অফিসার আদেশ দিল ‘নৌবাহিনীর ট্রাকে করে চট্টগ্রাম বন্দরে গিয়ে জেনারেল আনসারীর নিটক রিপোর্ট করতে।’ আমরা বন্দরের পথে বেরোলাম। আগ্রাবাদে আমাদের থামতে হলো। পথে ছিল ব্যারিকেড। এই সময় সেখানে এলো ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরী। ক্যাপ্টেন অলি আহমদের কাছ থেকে একবার্তা এসেছে। খালেক আমাকে একটু দূরে নিয়ে গেল। কানে কানে বললো- তারা ক্যান্টনমেন্ট ও শহরে সামরিক তৎপরতা শুরু করেছে। বহু বাঙালিকে ওরা হত্যা করেছে।’ ‘একটি জাতির জন্ম’- মেজর জিয়া। ১৯৭২ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রার প্রথম বিজয় দিবস সংখ্যায় লেখাটি ছাপা হয়। জিয়ার এ লেখাটির মধ্যে অনেক স্ববিরোধীতা লক্ষণীয়। তিনি লিখেছেন, ‘১৭ মার্চ গোপন বৈঠকে চূড়ান্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন’ কিন্তু বাস্তবতা তা প্রমাণ করে না। বাস্তব ঘটনাবলী প্রমাণ করে ইবিআরসি ও ৮ম ইস্ট বেঙ্গলের এ বিষয়ে কোন পরিকল্পনাই ছিল না। ২৪ মার্চ বাঙালি ব্রিগেডিয়ার মজুমাদরকে ইবিআরসি থেকে প্রত্যাহার, পাকিস্তানী ব্রিগেডিয়ার আনসারীকে নিয়োগ, ২৫ মার্চ রাত ১২-৩টার মধ্যে ইবিআরসিতে লে. কর্ণেল এম. আর. চৌধুরী সহ হাজার বাঙালি- সৈনিককে ২০তম বেলুচের একটি ক্ষুদ্র ইউনিট কর্তৃক আক্রমণ করে বিনা বাঁধায় হত্যা, তাঁদের পারিবারিক বাসস্থানে আক্রমণ, অগ্নিসংযোগ, রাত ১টায় পাকিস্তানী কমান্ডারের নির্দেশে জিয়ার অস্ত্র খালাসের জন্য বন্দরের দিকে হন হন করে চলে যাওয়া, ইবিআরসির আক্রান্ত বাঙালি সৈনিকদের সাহায্যার্থে ৮ম ইস্ট বেঙ্গলের না যাওয়া, পশ্চিম পাকিস্তানীদের তুলনায় ৪/৫গুন বেশি ইবিআরআরসি, ৮ম ইস্ট বেঙ্গল ও ইপিআরের বাঙালি সৈনিক থাকা সত্ত্বেও চট্টগ্রাম শহর বন্দর নিজেদের দখলে রাখার চেষ্ঠা না করে পটিয়ার দিকে চলে যাওয়াই কী প্রমাণ করে না ইবিআর সি ও ৮ম ইস্ট বেঙ্গলের কোন পূর্ব পরিকল্পনা ছিল না। পরিকল্পনা ছিল বলেই ক্যাপ্টেন রফিক ও ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া সীমিত সৈন্য নিয়েই কয়েকদিন চট্টগ্রাম শহর তাঁদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছিলেন। আর ইবিআরসি ও ৮ম ইস্ট বেঙ্গলের পরিকল্পনা ছিল না বলেই ২০ বালুচ রেজিমেন্ট ২৫ মার্চ রাতে এতবড় অঘটন ঘটাতে পারল।
১৯৭১ সালে সামরিক বাহিনীর কারা, কিভাবে, কোন পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁর একটি বিভাজন করেছেন মেজর অব. রফিক তাঁর লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বইতে। তিনি লিখেছেন-
(১) স্বাধীনতার চেতনায় অনুপ্রাণিত এবং আক্রান্ত হবার আগেই পাকিস্তানীদের ওপর আক্রমণ করার মানসিক ও দৈহিক প্রস্তুতি ছিল এমন নিবেদিত ব্যক্তিগন প্রথম পর্যায়ভুক্ত। তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রথম অবস্থাতেই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
(২) দ্বিতীয় দলটি স্বাধীনতার চেতনায় অনুপ্রাণিত দল। কিন্তু তাঁদের পাকিস্তানীদের প্রাথমিক আক্রমনের ব্যাপারে ততখানি সজাগ এবং প্রস্তুতি ছিল না। তবুও যে মুহূর্তে এটা তাঁদের নিকট স্পষ্ট হয়ে উঠে যে শুধুমাত্র চাকরি নয় তাঁদের জীবনও বিপন্ন তখনই তাঁরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে।
(৩) আর যারা জীবনের ঝুঁকি নেয়া তো দূরের কথা, কর্মজীবনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে এমন পদক্ষেপ সম্পর্কে বিরূপ মনোভাবাপন্ন ছিল তাঁদেরকে তৃতীয় পর্যায়ভূক্ত করা যায়। তাঁদের কাছে স্বাধীন বাংলাদেশ কী ? অবিচ্ছিন্ন পাকিস্তানই কী ? ব্যক্তিগত কর্মজীবন ও নিজের ভবিষ্যতই ছিল তাঁদের কাছে মূল বিবেচনার বিষয়। স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধা ও শত্রু পাকিস্তানী দুপক্ষের সাথে এরা অত্যন্ত সুকৌশলে সমান সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। যাতে যে পক্ষই যুদ্ধে বিজয়ী হোক না কেন তাঁদের যেন কোন অসুবিধা না হয়। এই দলভূক্তরা তখনই যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে বাধ্য হয়, যখন তারা বুঝতে পারেন, তাদের জীবনের উপর কিছুটা হুমকির সম্ভাবনা আছে। তাই এই দল স্বাধীনতা যুদ্ধে পরিস্থিতির চাপে পড়েই অংশগ্রহণ করে, স্বেচ্ছায় নয়।
(৪) চতুর্থদলে রয়েছে অতি নগণ্য সংখ্যক ব্যক্তি, যারা তাদের পাকিস্তানী প্রভূদের অনুগত দাস ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিল তাদের কাছে অর্থহীন।
মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার ও ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সেই সময়কার ভূমিকা ও তৎপরবর্তী কার্যাবলী পাকিস্তানী লেখক মেজর সিদ্দিক সালিকের ভাষায় সম্মানজনক ব্যতিক্রমের আওতায় পড়ে কী না ? বা মেজর রফিকের সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ২ ও ৩নং বিভাজনের অন্তর্ভূক্ত কী না ? তা গবেষণার দাবী রাখে।
পলাশীর যুদ্ধে মীরজাফরের যুদ্ধ না করা ছিল স্পষ্টতই ষড়যন্ত্র, কিন্তু আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম শহর ও ক্যান্টনমেন্ট অরক্ষিত রেখে মেজর জিয়ার পটিয়ার দিকে চলে যাওয়া-যার ফলে পাকিস্তানী বাহিনী বন্দরের বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ সহজে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয় সেটা ষড়যন্ত্র ছিল, না জিয়ার সামরিক ভূল সিদ্ধান্ত ছিল ? কেন তিনি নিজেকে হেড অব দ্যা স্টেট ঘোষণা করলেন ? কেন তিনি জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত সেক্টর কমান্ডারদের সম্মেলনে কর্নেল ওসমানীকে সরিয়ে ওয়ার কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব করেন ? কেন রাষ্ট্রপতি জিয়া স্বাধীনতা বিরোধীদের স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন, কেন গোলাম আজমকে দেশে আনলেন ? কেন রাজাকার শাহ্ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী করলেন ? কেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করে পূর্ণবাসিত করলেন। কেন বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে চাকুরী দিয়ে পুরস্কৃত করলেন। সে গবেষণা এখনো হয়নি, ভবিষ্যতে হলে হয়তো প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার সঠিক ইতিহাস জানাতে অবিলম্বে গবেষকদের এদিকে মনোযোগী হওয়া দরকার।