অবৈধ স্ট্যান্ড উচ্ছেদকে কেন্দ্র করে ॥ চৌহাট্টায় ত্রিমুখী সংঘর্ষে রণক্ষেত্র, গুলিবর্ষণ, আগ্নেয়াস্ত্রসহ আটক ১ ॥ নগরীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে পরিবহন শ্রমিকদের রাস্তা অবরোধ, ধর্মঘটের ডাক

26
চৌহাট্টায় অবৈধ গাড়ী স্ট্যান্ড উচ্ছেদে গেলে পুলিশ ও সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর-শ্রমিকদের মধ্যে সংঘর্ষ ও অস্ত্র সহ আটক পরিবহন শ্রমিক। ছবি- মামুন হোসেন

স্টাফ রিপোর্টার :
মাইক্রোবাস ও প্রাইভেটকারের অবৈধ স্ট্যান্ড উচ্ছেদকে কেন্দ্র করে ত্রিমুখী সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে নগরীর চৌহাট্টা এলাকা। এ সময় মেয়র ও সিলেট সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হামলার মুখে পড়ে কাউন্সিলর-পুলিশ সদস্য, পরিবহন শ্রমিকসহ অন্তত ২০/২৫ জন আহত হন। গতকাল বুধবার দুপুর ১টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ১৬ রাউন্ড ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে আধঘন্টা পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে পুলিশ। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে আগ্নেয়াস্ত্রসহ ফয়সল আহমদ ফাহাদ (৩৮) নামে এক পরিবহন শ্রমিককে আটক করা হয়।

চৌহাট্টায় অবৈধ গাড়ী স্ট্যান্ড উচ্ছেদে গেলে পুলিশ ও সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর-শ্রমিকদের উপর হামলা চালায় পরিবহন শ্রমিকরা। এ সময় বেশ কিছু গাড়ী ভাংচুর করা হয়।

এর পরপর বেলা ২টার দিকে সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের প্রবেশ মুখ দক্ষিণ সুরমার হুমায়ুন চত্বর, চন্ডিপুল ও সিলেট-সুনামগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে সড়ক অবরোধ করে যানবাহন চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে পরিবহন শ্রমিকরা। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েন মানুষ। তবে বিকেল ৪টার দিকে প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের হস্তক্ষেপে অবরোধ তুলে নেন শ্রমিকরা।
সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, চৌহাট্টা-আম্বরখানা সড়কের সংস্কার কাজ চলছে। এই সড়কের চৌহাট্টা- দরগাহ এলাকার ফুটপাত ও সড়কের অনেকাংশ দখল করে অনেকদিন ধরেই অবৈধ স্ট্যান্ড গড়ে তুলে মাইক্রোবাস ও প্রাইভেটকার শ্রমিকরা। প্রতিদিন এখানে শতাধিক গাড়ি পার্কিং করা থাকে। চারদিন আগে এই অবৈধ স্ট্যান্ড উচ্ছেদে যায় সিলেট সিটি করপোরেশন। মেয়রের নেতৃত্বে এই অভিযানে বাধা দেয় পরিবহন শ্রমিকরা। পরে তাদের ৩ দিনের সময় বেঁধে দিয়ে এই সময়ের মধ্যে ফুটপাত ও সড়ক ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন মেয়র।
সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ শাখা জানায়, বুধবার সকালে চৌহাট্টা এলাকায় সড়কের উন্নয়ন কাজ বন্ধ করে দিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে পরিবহন শ্রমিকরা। এ খবর পেয়ে দুপুরে কাউন্সিলর, ম্যাজিস্ট্রেট ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে উন্নয়ন কাজ পরিদর্শনে যান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। এ সময় তিনি দেখতে পান পরিবহন শ্রমিকরা তখনও সড়ক ও ফুটপাত দখল করে গাড়ি পার্কিং করে রেখেছেন। তখণ মেয়রসহ সিসিকের কর্মকর্তারা সড়ক সম্প্রসারণের কাজ শুরু করতে চাইলে বাধা দেন। এনিয়ে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের উপর হামলা চালায় পরিবহন শ্রমিকরা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পরিবহন শ্রমিকদের হামলার পর পর সিটি করপোরেশনের কর্মীরাও পাল্টা হামলা চালায়। একপর্যায়ে দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পরে। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে পুলিশের উপরও হামলা চালায় শ্রমিকরা। এ সময় অর্ধশতাধিক গাড়ি ভাংচুর করা হয় এবং চৌহাট্টা-আম্বরখানা, চৌহাট্টা-রিকাবীবাজার, চৌহাট্টা-জিন্দাবাজার, চৌহাট্টা-মিরবক্সটুলা সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
সিলেট সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা আব্দুল আলিম শাহ বলেন, মেয়র, কাউন্সিলর ও ম্যাজিস্ট্রেটদের সাথে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে পরিবহন শ্রমিকরা আচমকা হামলা চালায়। এ সময় কাউন্সিলরসহ সিসিকের অন্তত ৮ জন আহত হয়েছেন। তিনি বলেন, হামলার একপর্যায়ে বন্দুক নিয়ে একজন মেয়রের দিকে তেড়ে আসে। পুলিশ সাথে সাথে তাকে আটক করেছে। আমাদের আশঙ্কা মেয়রকে হত্যার উদ্দেশ্যই সে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে এসেছিলো।
এই ঘটনার ব্যাপারে পরিবহন শ্রমিকদের কেউ কথা বলতে চাননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন পরিবহন শ্রমিক বলেছেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরেই এই এলাকায় স্ট্যান্ড করে আছি। উচ্ছেদের আগে আমাদের বিকল্প একটি জায়গা প্রদানের জন্য মেয়রের কাছে অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু তিনি তা না শুনে গতকাল বুধবার সকালে দলবল নিয়ে এসে আমাদের উপর হামলা করেন ও গাড়ি ভাংচুর করেন। সংঘর্ষে পরিবহন শ্রমিদকের ৫/৬ জন আহত হয়েছেন বলে জানান তিনি।
কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম আবু ফরহাদ বলেন, পুলিশ আধঘন্টা চেষ্টা চালিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এসময় ১৬ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোঁড়া হয়। তিনি বলেন, ঘটনাস্থল থেকে আগ্নেয়াস্ত্রসহ ফয়সল আহমদ ফাহাদ (৩৮) নামে এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে।
মহানগর পুলিশের উপ কমিশনার (ট্রাফিক) ফয়সল মাহমুদ বলেন, সরকারি রাস্তা দখল করে যানবাহন রাখা হচ্ছে দীর্ঘদিন থেকে। কিন্তু সম্প্রতি সিসিকের উন্নয়ন কাজ শুরু হওয়ায় চৌহাট্টাস্থ এলাকার অবৈধ পরিবহন স্ট্যান্ড সরানোর জন্য বলা হলেও শ্রমিকরা যানবাহন না সরিয়ে বিভিন্ন দাবি জানিয়ে আন্দোলন শুরু করে। এক পর্যায়ে সিসিকের কর্মী ও পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
এ ব্যাপারে সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, চৌহাট্টায় সিসিকের উন্নয়ন কাজ শুরু করার পূর্বে ফুটপাত দখল করে যারা স্ট্যান্ড করেছেন তাদের সাথে একাধিকবার বৈঠক হয়। তারা উন্নয়ন কাজের স্বার্থে স্ট্যান্ড ছাড়ার কথা দিয়ে ৩দিনের সময় নেয়। কিন্তু এই সময়ে মধ্যে তারা স্ট্যান্ড সরিয়ে নেয়নি। বরং শ্রমিকদের কাজ না করতে উল্টো হুমকি দেয়া হয়। তিনি আরও বলেন, বুধবার সকালে সিসিকের কর্মীরা কাজ শুরু করতে গেলে পরিবহন শ্রমিকদের কয়েকজন তাদের যানবাহন সরিয়ে নিলে কাজ শুরু করে সিসিক। এরপর পরিবহন শ্রমিকদের একজন নেতা পূনরায় গাড়িগুলো স্ট্যান্ডে নিয়ে আসার জন্য নির্দেশ দিলে শ্রমিকরা গাড়ি নিয়ে আসে। সাথে সাথে বিষয়টি আমি পুলিশসহ প্রশাসনের ঊধর্বতন কর্মকর্তাদেরকে জানালে তারা ঘটনাস্থলে এসে পরিবহন শ্রমিকদেরকে অবৈধ স্ট্যান্ড সম্পর্কে বুঝাতে শুরু করেন। খবর পেয়ে সিসিকের কয়েকজন কাউন্সিলর ঘটনাস্থলে গেলে শ্রমিকরা উত্তেজিত হয়ে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা শুরু করে। এ সময় সিসিকের কয়েকজন শ্রমিক আহত হন। তিনি আরও বলেন, পরিবহন শ্রমিকরা যাতে যানবাহন রাখতে পারে সেজন্য আমরা তাদের জন্য জায়গা খোঁজছি। তারাও জায়গা খোঁজতেছেন। কিন্তু তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে সিসিকের উন্নয়ন কাজ বন্ধ করার পায়াতারা শুরু করেন।
এদিকে, এর জের ধরে গতকাল বুধবার বেলা ২টার দিকে সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের দক্ষিণ সুরমার হুমায়ুন চত্বর ও চন্ডিপুলে সড়ক ২ ঘন্টা অবরোধ করে রাখে মাইক্রোবাস শ্রমিকরা। এতে পণ্যবাহী, রোগীবাহী এ্যাম্বুলেন্স ও বাসসহ আটকে চরম দুর্ভোগে পড়েন মানুষ। তবে বিকেল ৪টার দিকে প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের হস্তক্ষেপে অবরোধ তুলে নেন শ্রমিকরা।
বিক্ষোভকারী শ্রমিকদের দাবি, চৌহাট্টায় সিলেট সিটি করপোরেশনের শ্রমিকরা তাদের উপর হামলা ও গাড়ি ভাংচুর করেছে। এ ভাংচুরের ক্ষতিপূরণ ও নির্দিষ্ট স্থানে তাদের স্ট্যান্ড করে দেওয়ার জন্যে এ আন্দোলন।
এ ব্যাপারে দক্ষিণ সুরমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুল ইসলাম বলেন, নগরীর চৌহাট্টার ঘটনাকে কেন্দ্র করে হুমায়ুন রশীদ চত্বর ও চন্ডিপুল এলাকায় মাইক্রোবাসের শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করেন। তবে শ্রমিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা বলে আমরা পরিস্থিত নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছি। এখন গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে।
অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘটের ডাক: আগামী ২২ ফেব্রুয়ারি সোমবার থেকে সিলেটে অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট ডেকেছে সিলেট জেলা বাস মিনিবাস মাইক্রোবাস শ্রমিক ইউনিয়ন। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় সিলেট জেলা বাস মিনিবাস মাইক্রোবাস শ্রমিক ইউনিয়ন (১৪১৮) কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ ঘোষণা দেন সিলেট জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের নবনির্বাচিত সভাপতি ময়নুল ইসলাম।
সিলেট জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের নবনির্বাচিত সভাপতি ময়নুল ইসলাম বলেন, চৌহাট্টার স্ট্যান্ড সরাতে আমরা সিটি মেয়রের কাছে কিছুটা সময় চেয়েছিলাম। তিনি আমাদের কথায় রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু দুপুরে অতর্কিতে লোকজন নিয়ে এসে তিনি আমাদের উপর হামলা চালান। এতে আমাদের অনেক শ্রমিক আহত হয়েছে।
তিনি বলেন, শ্রমিকদের উপর হামলার প্রতিবাদ ও উচ্ছেদের আগে আমাদের স্ট্যান্ডের জন্য জায়গা নির্ধারণ করে দেয়ার দাবিতে সোমবার সকাল ৬টা থেকে সিলেট জেলায় অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট কর্মসূচি পালন করা হবে।