মুকুটহীন সম্রাট আল্লামা ফুলতলী (রহ.)

47

মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক

যুগে যুগে বহু ক্ষণজন্মা মহামানবের আবির্ভাব ঘটে, যারা প্রকৃতিগতভাবেই সমাজে আবির্ভূত হন ধর্মীয়, সামাজিক ও জাতীয় জীবনের অভিভাবক ও দিকনির্দেশক হিসেবে, ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক চিন্তাচেতনা বিকাশের কর্ণধার, ঐক্য ও ভারসাম্যের প্রতীক, জাতীয় সংহতি ও এর ভিত্তিকে সুদৃঢ় করার চিন্তানায়ক হিসেবে। যারা এমন জীবনার্জনে সক্ষম তারাই বেঁচে থাকেন আপন কর্মে। এ সকল মহৎ প্রাণের ব্যক্তিগণ মানুষের মাঝে বেঁচে থাকেন যুগ যুগান্তর। যিনি এমনি এক ব্যক্তিত্ব যার প্রকৃতি থেকে অর্জিত শাশ্বত সত্যের উপলব্ধি থেকে সুন্দর ও শান্তিময় ইসলামি সমাজ গঠনে সমগ্র জীবনভর নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়েছেন- এসকল ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্বে’র মধ্যে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের দিশারী বলিষ্ঠ ও প্রখর মেধার অধিকারী আল্লামা ফুলতলী (রহ.) অন্যতম। ধর্মীয় চেতনায় শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি আধ্যাত্মিক বিশ্বাস ও ইসলামী সংস্কৃতি চর্চায় সুফিবাদী চিন্তা চেতনার প্রকাশ ও প্রচার ঘটেছে উনার হাতে বিস্তর। তিনি আমাদের সমাজ ও জাতীয় জীবনে এমন একজন ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিভা, যিনি ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা, সাহিত্য, সমাজচিন্তা, রাষ্ট্রনীতি, নৈতিকতা, জীবন ঐতিহ্য, বিজ্ঞান ও ইসলামি জ্ঞান এবং কোরআনের শিক্ষা বিস্তার ছাড়াও সাধনার প্রতিটি ক্ষেত্রে ছিলেন এক পূর্ণমহিরূহ ও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব।
আধ্যাত্মিক রাজধানী সিলেটের জমিন’সহ বহিঃবিশ্বে ইসলামের বহুমাত্রিক খেদমতের অন্যতম সিপাহসালার কোরআনের অনন্য খাদেম, বাংলার রূমী নামে খ্যাত আল্লামা ফুলতলী (রহ.)-এর সুদীর্ঘ জীবন সংগ্রাম ও কর্মমুখর প্রাণচঞ্চলতা ছিল বিভিন্ন জীবন্ত উপাখ্যানে পরিপূর্ণ। শতাব্দীর ইসলামী রেনেঁসা আন্দোলনের অন্যতম মর্দে মুজাহিদ। যুগের শ্রেষ্ঠ স্বনামধন্য মুহাদ্দিসগণের কাছ থেকে ইলমে হাদিস, ইলমে তাফসীর, ইলমে আকাইদ ও ফিকহ বিদ্যায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করে মাদরাসা শিক্ষার চুড়ান্ত সনদ লাভ করেন মেধাবী ছাত্র হিসেবে। আল্লামা ফুলতলী (রহ.) ছিলেন বড় মাপের একজন তাফসীর, কিরাত, সীরাত, তাসাউফ ও কাব্য বিষয়ে বহু গ্রন্থে’র প্রণেতা। তিনি যেখানেই হাত দিয়েছেন সেখানেই সোনা ফলেছে। আমৃত্যু তিনি দেশ, জাতি এবং মুসলিম মিল্লাতের কল্যাণ চিন্তায় নিজেকে উৎসর্গ করে যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন, তার তুলনা বিরল। ইসলামের উষালগ্ন থেকেই ইতিহাসের সোনালী পৃষ্ঠায় কীর্তিমানদের সাথে স্থান দখল করে নিয়েছেন। বিরল প্রতিভার অধিকারী প্রথিতযশা এই মহান ব্যক্তি ছিলেন সুযোগ্য সংগঠক, সফল ইসলামি স্কলার। হাজার হাজার আলেমের উস্তাদ, অসংখ্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি গভীর ভাবে উপলব্ধি করেছিলেন ইসলামী জ্ঞান অর্জন ছাড়া মুসলমান কখনো প্রকৃত মুসলমান হতে পারে না। দুনিয়ার জ্ঞান বিজ্ঞানের একমাত্র উৎসই পবিত্র কোরআন। এই কোরআন শিক্ষা দানের জন্য বিশ্বনন্দিত এবং যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সব মানুষের হৃদয়ের আকর্ষণ ও মধ্যমণি তিনি। ৯৫ বছরের সুদীর্ঘ জীবনে তার বহুমুখী প্রতিভা, সৃজনশীল কর্মদক্ষতা, পরমতসহিঞ্চুতা, ধর্মীয় উদার দৃষ্টিভঙ্গি, মানবীয় ব্যক্তিত্ব এবং সর্বোপরি তাঁর সহজ-সরল অনাড়ম্বর, নিরহংকার ও নির্লোভ ধর্মীয় জীবন সাধনায় তাকে খ্যাতির শীর্ষে আরোহণে সহায়তা করেছে। বাল্যকালে যে প্রখর মেধার স্ফুরণ, যৌবনকালে যার স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ, পড়ন্ত বেলায় তার বৈদগ্ধের দ্যুতি ছিল কিংবদন্তিতুল্য। যে কোনো মানুষকে মুহূর্তে আপন করে নেওয়ার গুণ ছিল তাঁর সহজাত প্রকৃতি। তাই নিশ্চিতভাবেই তিনি শ্রদ্ধার সঙ্গে সর্বমহলে স্মরণীয়, হৃদয়-গভীরে বরণীয়।
আল্লামা ফুলতলী (রহ.)-এর জীবন শুধু জ্ঞান সাধনায়ই ভাস্বর ছিল না, কর্মসাধনায়ও ছিল সদা তৎপর। যার আপাদমস্তক ছিল রাসূল (সা.)-এর আদর্শে উদ্ভাসিত। নির্যাতিত, নিপীড়িত, অবহেলিত এবং মজলুম মানুষের পক্ষে সু-উচ্চ কন্ঠস্বর। তিনি ছিলেন জালিম ও রাসূল (সা.)-এর শত্রুদের বিরুদ্ধে সোচ্চার। অবিভক্ত বাংলার রাজনৈতিক ঘটনাগুলোর ঐতিহাসিক সাক্ষ্যপুরুষ। তিনি আমাদের সুদীর্ঘ গৌরবময় ধর্মীয় ও জাতীয় ঐতিহ্যের সত্যান্বেষী কালজয়ী ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন বিংশ শতাব্দীর দীপ্তিমান ইতিহাস ও জীবন্ত বিশ্বকোষ হিসেবে স্বীকৃত। এ দেশের শিক্ষা আন্দোলনেও তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। বিশেষ করে ইলমে কিরাতের জগতে সুবিজ্ঞ বিশারদ হিসেবে সর্বমহলে অর্জন করেছেন ঈর্ষণীয় খ্যাতি ও গ্রহণযোগ্যতা। কোরআনের এমন অসাধারণ খেদমত তাকে মর্যাদা ও শ্রদ্ধার উচ্চাসনে করেছে সমাসীন। যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন তা সত্যিই প্রশংসার দাবী রাখে। জ্ঞানবিজ্ঞান, সমাজ-সভ্যতা, ধর্ম-দর্শন, মূল্যবোধ ও ধর্মীয় বিশ্বাস প্রভৃতি ক্ষেত্রে তাঁর বিচরণ ছিল স্বাচ্ছন্দ্যময় ও সাবলীল।
রাসূল (সা.)-এর আদর্শের প্রশ্নেও তিনি ছিলেন সারা জীবন অটল অবিচল। এ জাতির প্রতিটি সংকট সন্ধিক্ষণে তিনি ছিলেন সাহস সঞ্চারী এক অকুতোভয় ব্যক্তিত্ব। মুসলিম উম্মাহর মাঝে সম্প্রীতি এবং সৌহার্দ বজায় রাখতে তাঁর সাহসী ভুমিকা ছিল অনবদ্য। স্থানীয় এবং জাতীয় বিভিন্ন ইস্যুসহ প্রতিটি দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে তিনি কখনও প্রত্যক্ষ, কখনও পরোক্ষ সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন। তখন তাঁর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে জাতির বিবেক। যখনই ইসলাম ও মুসলমানদের ওপর আঘাত এসেছে, তখনই তিনি প্রতিবাদ করেছেন। প্রয়োজনে গড়ে তুলেছেন তীব্র গণআন্দোলন। জীবনের শেষদিকে বয়োবৃদ্ধ অবস্থায়ও দেশের মাদরাসা শিক্ষা ধ্বংসের অপকৌশলের বিরুদ্ধে, ফাজিলকে ডিগ্রি ও কামিলকে মাস্টার্সের মান প্রদান এবং স্বতন্ত্র ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে সিলেট থেকে সহস্রাধিক গাড়ি বহর নিয়ে তিনি এক ব্যতিক্রমধর্মী লংমার্চ পরিচালনা করেন। তৎকালীন সরকার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তে ফাজিল ও কামিল মাদরাসাগুলোকে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হয়। তাঁর এ সাহসী ভূমিকায় ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য আজকে’র আরবি বিশ্ববিদ্যালয়।
আল্লামা ফুলতলী (রহ.) মানুষের আধ্যাত্মিক, নৈতিক, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক তথা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যাবতীয় কর্মকান্ডে এবং এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। এ সাধনায় তিনি যে ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়েছেন; তাতে রয়েছে দুনিয়ার সব মানুষের জন্য, সব ধর্মাবলম্বীর জন্য সম্প্রতি ও উদারতার শিক্ষা। একজন সত্যিকার মোমিন তার চিন্তাকর্মে, আচরণে সব সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে দুনিয়ার সব মানুষকে তাঁর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করতে পারেন বলেই তিনি সবার প্রিয়, সবার শ্রদ্ধেয় কিংবদন্তি মানব। প্রতি বছর ১৬ জানুয়ারি বাঁধ ভাঙ্গা জনস্রোতে ‘বালাই হাওর’ যেন পরিপূর্ণ হয়। লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের উপস্থিতিতে আল্লামা ফুলতলী (রহ.) ঈছালে ছাওয়াব মাহফিল-এতো ভক্তবৃন্দ এবং এ অঞ্চলের ইসলাম প্রিয়দের বিশাল এক মিলন মেলা বসে। প্রতি বছর ১৬ জানুয়ারি ‘বালাই হাওর’ নতুন সাজে সজ্জিত হয়, আলোকিত হয়। কিন্তু এবার করোনা মহামারির জন্য সে মিলন মেলা অবলোকন করা যাবেনা। একজন প্রকৃত আলেমের মৃত্যু একটি জাহানের মৃত্যুর সমান। মুকুটহীন সম্রাট আল্লামা ফুলতলী (রহ.) আজ শুধু একটি ব্যক্তিত্বের নাম নয়, একটি সংকল্পের, একটি সংগ্রামের, একটি আদর্শের, একটি সোনালী অধ্যায়ের নাম।