বীরাঙ্গনাদের তালিকা

19

১৯৭১ সালের মার্চ থেকে শুরু স্বাধীনতা সংগ্রামের নিরন্তর অভিযাত্রা শেষ অবধি চূড়ান্ত বিজয় নিশান উড়ায় ১৬ ডিসেম্বর। নয় মাসের জীবন-মরণ লড়াই, দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের অবিস্মরণীয় কাল পর্বে সিংহভাগ বাঙালির নিঃশর্ত সমর্পণ ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। সম্মুখ সমরের রক্তস্নাত প্লাবনে ৩০ লাখ বীর বাঙালির অকাতরে আত্মদান জাতিকে যে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়, তার অনবদ্য স্বীকৃতি যতখানি প্রয়োজন ছিল ততটা হয়েছে কিনা অর্ধশত বছর ধরে তেমন হিসাব নিকাশ প্রশ্নবিদ্ধই থেকে গেছে। আর দুই লাখ নারীকে সম্ভ্রমহীনতার গ্লানি বহন করে যে দুর্বিষহ যাত্রাপথ পাড়ি দিতে হয়েছে তেমন পর্যায়ও সুখকর কিংবা গৌরবময় ছিল না। যুদ্ধোত্তর সদ্য স্বাধীন একটি দেশে বিজয়ের আনন্দমিছিল যখন সারা বাংলা দ্যুতিময় করে তোলে, তেমন সন্ধিক্ষণে দুই লাখ মা বোনের যে কি দুর্গতি বহন করতে হয়েছে সেটাও সময়ের নিরন্তর গতি প্রবাহের এক অন্ধকার বলয়।
বিজয়ের ২ দিন আগে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের নিধনযজ্ঞ স্বাধীনতার লাল সূর্যকে বিষণ্ন করে দেয়। সেই বেদনাঘন, কষ্টকর অনুভূতি আরও দুঃসহ অবস্থায় পৌঁছে অগণিত নির্যাতিত নারীর তীব্র যন্ত্রণায়। বঙ্গবন্ধু কালক্ষেপণ না করে তাদের সম্মানিত করলেন গৌরবের শীর্ষে। অকুতভয় বীরের মর্যাদায়। বীরাঙ্গনায় অভিষিক্ত করে তাদেরও জাতীয় বীরের শ্রেষ্ঠতম আসনটি দিতে এতটুকুও ভাবেননি। তাদের জন্য তৈরি হলো পুনর্বাসন কেন্দ্র। পিতা-মাতা-স্বামী পরিত্যক্তা এসব নিপীড়িত নারীর সম্ভ্রম হারানোর আর্তনাদের চাইতে বেশি কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল পরিবার ও সমাজচ্যুত হওয়ার মতো আশঙ্কায় পতিত হয়ে। সিংহভাগ বীরাঙ্গনা নারীর ভাগ্যে তেমন দুর্দশাই তাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নেয়। আজ অবধি পাক হানাদার বাহিনী ও দেশীয় দালালদের দ্বারা নিগৃহীত এসব নারীর যথার্থ তালিকা প্রস্তুত করা হয়নি। অনাদরে, অবহেলায়, অপমানে প্রতিদিনের জীবন হরেক রকম বিপন্নতায় অভিশপ্ত ছিল তাদের। এ ছাড়াও তাদের সন্তানদেরও তেমন মর্যাদায় নিজ দেশে বড় করা সম্ভব হয়নি। অনেকেই বিদেশে পাড়ি দেয় সেখানকার অন্য কারও দত্তক পরিচয়ে। সে সব যুদ্ধ শিশু আজও তাদের মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে বাংলাদেশে এসে। পরিচয়হীন এসব সন্তানের পিতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু সদ্য স্বাধীন একটি দেশে সগর্বে, অহঙ্কারে নিজের নামটাই ঘোষণা করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্ব হারানো এসব বীরাঙ্গনাকে দেশের মর্যাদাপূর্ণ বীরের আসনে বসাতে জাতির জনক নিজের সিদ্ধান্তকে অকপটে তুলে ধরেছিলেন। স্বাধীনতার ৫০তম বিজয় দিবসে মুক্তিযুদ্ধের বীরাঙ্গনাদের খুঁজে বের করে তালিকাভুক্ত করাও এক তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। যেভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় শনাক্ত করে তাদের তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে এবং হয়েছে, সেভাবে বীরাঙ্গনাদের চিহ্নিত করে তালিকাভুক্ত করা সময়ের দাবী।