মোঃ আব্দুল মালিক
বিশ্বের ইতিহাসে বহু যুদ্ধ বিগ্রহ হয়েছে, বহু লোকক্ষয় ও সম্পদহানি হয়েছে, বহু আত্নসমর্úনের ঘটনাও ঘটেছে কিন্তু বাঙালি জাতি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে যে তিনটি বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি করেছে তা দুই দেশের যুদ্ধে কেন ? প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধেও তা হয়নি। বিশ্বের ইতিহাসে বহুদেশ ও জাতি যুদ্ধ করে স্বাধীনতা লাভ করেছে। কিন্তু বাঙালি জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধ বিশ্বের যে কোন স্বাধীনতা যুদ্ধের চাইতে অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিল ও আছে।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বাঙালি জাতি তাদের প্রাণের সংগঠন আওয়ামীলীগকে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ট আসন দান করে। নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী আওয়ামীলীগ তথা বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পাকিস্তানের সরকার গঠন করার কথা। তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী উল্লে¬খ করে ৩রা মার্চ পার্লামেন্টের অধিবেশনও ডেকেছিলেন। কিন্তু বাঙালির হাতে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতা চলে যাবে বাঙালিরা পাকিস্তানের শাসক হবে। এটা হতে পারে না। তাই পর্দার অন্তরালে শুরু হয় নানা ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্রের ফল হিসেবে ১লা মার্চ ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্ট কালের জন্য সংসদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে দশ লক্ষাধিক জনতার সমাবেশে এক জ্বালাময়ী দিকনির্দেশনা মূলক ভাষণ দান করেন। যে ভাষণ জাতি সংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো) বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রামাণ্য ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে ‘মেমোরি অব দ্যা ওয়ার্ল্ড রেজিষ্টারে’ ৪২৭ তম এবং অলিখিত দলিলের মধ্যে প্রথম হিসেবে স্থান দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতি যখন উত্তাল আন্দোলন সংগ্রামে উজ্জীবিত এবং ঐক্যবদ্ধ তখন উপায়ান্তর না দেখে ইয়াহিয়া, ভূট্টো আলোচনার নামে ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ২৫ মার্চ গভীর রাতে নিরস্ত্র, ঘুমন্ত বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার মানসে অপারেশন সার্চলাইট নামে এক গণ হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করে। তাদের ধারণা ছিল কয়েক হাজার বাঙালিকে এলোপাতাড়ি হত্যা করলে, শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করলে বাঙালিরা ঠান্ডা হয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ভুলে যাবে, পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার অভিলাষ ত্যাগ করবে। কিন্তু না বাঙালি জাতি বীরের জাতি, বিজয়ী জাতি। তাদের নেতা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবনের মায়া ত্যাগ করে ২৬ মার্চের উষালগ্নে গ্রেফতার হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। উল্লেখ্য বঙ্গবন্ধু কৌশলে ৭ই মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং বাঙালি জাতিকে তাদের করণীয় সম্পর্কে সংক্ষেপে পূর্ণ দিক নির্দেশনাও দিয়ে রেখেছিলেন।
শুরু হলো বাঙালি জাতির স্বাধীনতার যুদ্ধ, মহান মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজ উদ্দিন আহমদ, কামরুজ্জামান, মনসুর আলী জাতীয় এই চার নেতার নেতৃত্বে অস্থায়ী মুজিব নগর সরকার গঠিত হয়। এই সরকার বঙ্গবীর এম. এ. জি ওসমানীকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য প্রধান সেনাপতি নিয়োগ করে। বঙ্গবীর এম এ জি ওসমানী তাঁর প্রাজ্ঞ অভিজ্ঞতার আলোকে সারা বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টর এবং ৩টি ব্রিগেড ফোর্সে ভাগ করেন ও গেরিলা বাহিনী গঠন করেন। পৃথিবী বিখ্যাত আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত বিশ্বের দুই পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রত্যক্ষ মদদপুষ্ট পাকিস্তানী বাহিনীকে মাত্র আট মাস বিশ দিনের যুদ্ধে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ আত্মসমর্úণ করতে বাধ্য করে। এই আত্মসমর্úনের মধ্যদিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র জন্ম লাভ করে। এই বিজয়ে বাঙালি জাতি ৩টি বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি করে ঃ-
১। মাত্র ৮ মাস ২০ দিন যুদ্ধ করে বিশ্বের ইতিহাসে কোন দেশ বা জাতি স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেনি। একমাত্র বাঙালি জাতি এই বিশ^রেকর্ড সৃষ্টি করেছে।
২। বিশ্বের ইতিহাসে তিরাননব্বই হাজার প্রশিক্ষিত সৈন্য আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত থাকা অবস্থায় কোন কমান্ডার, কোন জেনারেল আত্মসমর্úন করেনি। একমাত্র টাইগার নিয়াজী খ্যাত জেনারেল আমীর আব্দুল্ল¬া নিয়াজী বাঙালি জাতির কাছে বিড়ালের মতো মাথা নত করে আত্মসমর্úন করে ছিলো।
৩। পাকিস্তানি বরর্ব বাহিনী মাত্র ৮ মাস ২০ দিনের যুদ্ধে ৩০ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করে, দু লক্ষের উপরে মা-বোনকে নির্যাতন করে যা বিশ্বের ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় হিটলারের নাৎসী বাহিনী ইহুদী জাতিকে বিশ্ব থেকে নিশ্চিহ্ন করার অভিপ্রায়ে ইহুদি বৃদ্ধ, নারী-শিশু যাকে যেখানে যেভাবে পেয়েছে তাকে সেখানে সেভাবে হত্যা করেছে তারপরও সময়ের সাথে হত্যা-নির্যাতনের অনুপাতিক হার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় পাকিস্তানি হায়েনা বাহিনী এতো কম সময়ে অনেক বেশি সংখ্যক মানুষকে হত্যা-নির্যাতন করেছে।
বাঙালি জাতির বিজয়ের পরও বিশ্বে আরও অনেক যুদ্ধ বিগ্রহ হয়েছে, অনেক জাতি স্বাধীন হয়েছে কিন্তু বাঙালি জাতির এই তিনটি বিশ্ব রেকর্ড এখনও কেউ ভাঙ্গতে পারেনি। অদূর ভবিষ্যতে কেউ পারবে কি না তা ভবিষ্যতই জানে। এই বিজয়ের নায়ক বাঙালি জাতির সূর্য সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে জানাই লাল সালাম।
মুজিব বর্ষে বিজয় দিবসের প্রাক্কালে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি পদ্মা সেতু দৃশ্যমান করে আরোও একটি বিশ^রেকর্ড সৃষ্টি করলো। অন্নদা শংকর রায়ের ভাষায়-
যতকাল রবে পদ্মা, যমুনা, গৌরী, মেঘনা বহমান
ততকাল রবে র্কীতি তোমার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ॥