সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়ানোর মাস্টারমাইন্ড ১০৩ জন গ্রেফতার, বিদেশে আছে ৬০ জন ॥ ১১২টি ফেসবুক একাউন্ট- ইউটিউব চ্যানেল বন্ধ

22

কাজিরবাজার ডেস্ক :
কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের গুজব। দেশ-বিদেশে সমানতালে চলছে গুজব ছড়ানোর তৎপরতা। বিটিআরসি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সকল শাখায় মনিটরিং ব্যবস্থা থাকলেও থামানো যাচ্ছে না গুজব ও অপপ্রচারের পাগলা ঘোড়া। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেও আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও থামানো যাচ্ছে না বেপরোয়া গুজব সৃষ্টিকারীদের। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, বিষয়টি নিয়ে বিটিআরসির সঙ্গে সমন্বিত কার্যক্রম চালু রয়েছে। মনিটরিংয়ে পাওয়া গুজব প্রচারকারীদের পেইজ বন্ধ করাসহ নানা পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। গ্রেফতারও করা হচ্ছে অনেককে। গুজব ও অপপ্রচার ঠেকাতে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণের কথাও বলছেন তারা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গুজব প্রতিরোধে মনিটরিং ব্যবস্থা আরও জোরদার এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। গুজব সৃষ্টিকারীদের গ্রেফতার করে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান বলেন, সিআইডির সাইবার সিকিউরিটি সেল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ওপর ২৪ ঘণ্টাই মনিটরিং করছে। গুজব ছড়িয়ে দেশে কোনক্রমেই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে দেয়া হবে না। র‌্যাব মহাপরিচালক অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, গুজব ঠেকাতে, গুজব সৃষ্টিকারীদের গ্রেফতারে তারা ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত রেখেছেন। এই অভিযান আরও জোরদার করা হচ্ছে।
দেশের হেন কোন বিষয় নেই, যে ইস্যুতে গুজব ছড়ানো হয়নি। গুজব ছড়ানোর সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে শতাধিক মাস্টারমাইন্ড গ্রেফতার হয়েছে। যাদের অধিকাংশই স্বাধীনতাবিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। তারা পরিকল্পিতভাবে দেশের সকল ইস্যুতে দেশে ও বিদেশে গুজব ছড়ায় বলে স্বীকারও করেছে। তারা ঘন ঘন আইডি পরিবর্তন করে থাকে। অনেকে দেশের বাইরে থেকে গুজব ছড়িয়ে দিচ্ছে। গুজব ছড়িয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সরকার হটানোর পরিকল্পনা করছে তারা।
গুজব ছড়ানোর দায়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে শতাধিক ফেসুবক, ইউটিউব চ্যানেলসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আরও কয়েকটি মাধ্যম। বিদেশে বসে গুজব ছড়ানোর দায়ে ৬০ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। তাদের গ্রেফতার করে দেশে ফেরত আনতে পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোল রেড ওয়ারেন্ট জারি করেছে। তারপরেও গুজবের ডালপালা গজানো থেমে নেই। হালে ধর্ষণ ইস্যুতে গুজব ছড়ানো হচ্ছে।
গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সাইবার মনিটরিং সেলের তথ্য মোতাবেক, এর আগে ২০১২ সালে রামুতে উত্তম বড়ুয়া নামের এক ব্যক্তির ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে গুজব ছড়ানোর ঘটনাটি সবচেয়ে আলোচিত। ওই গুজবের জেরে কক্সবাজারের রামুতে সবচেয়ে বড় হামলার ঘটনাটি ঘটে। বৌদ্ধ মন্দির গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। সরকার বৌদ্ধ মন্দির পুনর্র্নিমাণ করে দেয়। এ ঘটনায় ১৮টি মামলা হয়। যার মধ্যে উত্তম কুমারকেও একটি মামলায় আসামি করা হয়। আজও উত্তম কুমারের হদিস মেলেনি। মামলাগুলোর তদন্ত অনেকটাই হিমাগারে চলে গেছে। সেটি ছিল স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবিরের সুপরিকল্পিত হামলা। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রামুতে মন্দির তৈরি থেকে শুরু করে ক্ষতিগ্রস্তদের সার্বিক সহায়তা করেন।
এরপর রংপুর সদরের বাসিন্দা টিটু রায় নামের একজনের ফেসবুকেও ধর্ম অবমাননার গুজব ছড়ায় স্বাধীনতাবিরোধীরা। এমন গুজবে ঠাকুরপাড়ায় মারাত্মক হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় হিন্দুদের ৩০টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। ২৫টি বাড়িতে লুটপাট ও ভাংচুর করা হয়। হামলাকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে একজন মারা যান। সেই ধারাবাহিকতায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর এবং হবিগঞ্জের মাধবপুরের হিন্দুদের অনেক বাড়ি ও মন্দির ভাংচুর করা হয়। নাসিরনগর সদর থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড়া গ্রামের বাসিন্দা রস রাজের বাড়িতেও হামলা চালানো হয়। রস রাজের ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে সেই হামলা চালানো হয়।
২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীকে মৃত্যুদন্ড দেয়ার রায়ের পর সাঈদীকে চাঁদে দেখা যাওয়ার গুজব ছড়িয়ে সাতক্ষীরা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, যশোর, বগুড়া, রাজশাহী, নাটোর, জয়পুরহাট, ঝিনাইদহ ও চট্টগ্রামসহ ৩৪ জেলায় ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটায় জামায়াত-শিবির। ওই সহিংসতায় ৭৮ জন মারা যান। পুলিশ ফাঁড়ি ও পুলিশের গাড়িতে আগুন দেয়ার ঘটনাও ঘটে। পরবর্তীতে উচ্চ আদালত তার ফাঁসির দন্ড কমিয়ে মৃত্যুদন্ড দেন। এছাড়া ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সারাদেশে বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের অগ্নিসন্ত্রাস, ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে বাস চাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর ভয়াবহ গুজব ছড়ানোর ঘটনা ঘটে। আন্দোলনে নামায় চার নারী শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের পর নৃশংসভাবে হত্যার পর লাশ ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে রাখা হয়েছে বলে গুজব ছড়ানো হয়েছিল।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে গুজব ছড়ানোর দায়ে এক মডেল এবং ঢাকা এ্যাটাক সিনেমার এক অভিনেত্রী এবং দৃক গ্যালারির প্রতিষ্ঠাতা ও আলোকচিত্রী ড. শহীদুল আলমকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ওই সময় নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের নাম নিয়ে নাশকতামূলক কর্মকা-ে উস্কে দেয়ার দায়ে ছাত্র শিবিরের কর্মী বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কর্মী বুয়েটের মেকানিক্যাল বিভাগের ১৫তম ব্যাচের ছাত্র দাইয়ান, আকতারুজ্জামান টনি (২২), আসাদুল্লাহ আল গালিব (২২) ও মুনইম সরকার (২৩) নামে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র গ্রেফতার হয়।
একইভাবে কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে ছাত্র নিহতের গুজবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবন তছনছ করা হয়। এছাড়া পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা লাগার বলে গুজব ছড়িয়ে সারাদেশে আট জনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীকে অনুরোধ করেন কোন কিছু না জেনে, না বুঝে এবং সত্যতা যাচাই না করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোন কিছু শেয়ার, লাইক ও মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতে। গুজব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে সারাদেশে এখনও মাইকিং করা হয়। প্রতিটি ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এ্যাসেম্বলি ক্লাসের আগে গুজব বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে অভিভাবক ও শিক্ষকদের তরফ থেকে বক্তব্য দেয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ও তার আশপাশের এলাকায় সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা, শুক্রবার জুমার নামাজের খুতবার আগে ইমামের গুজব সংক্রান্ত বয়ান দেয়া, স্থানীয় গণমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে গুজব সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে উঠান বৈঠক করা, গুজবে কান না দিতে সচেতনতা বাড়াতে লিফলেট বিতরণ, দর্শনীয় জায়গায় লিফলেট লাগানো, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা জোরদারের পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতুতে মাথা লাগার গুজবটি ছড়ানো হয়েছিল দুবাই থেকে। স্বাধীনতাবিরোধী এক ব্যক্তি গুজবের প্রথম পোস্টটি দেয়। গুজব ছড়ানোর দায়ে এখন পর্যন্ত ১০৩ জন মাস্টারমাইন্ডকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আর ১১২টি ফেসবুক এ্যাকাউন্ট, ইউটিউব চ্যানেলসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বিদেশ থেকে গুজব ছড়ানোর মাস্টারমাইন্ড হিসেবে ৬০ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের সাইবার সিকিউরিটি সেলের তরফ থেকে মামলা দায়ের করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড ওয়ারেন্ট জারি করা হয়েছে। বিদেশে থাকা এসব মাস্টারমাইন্ডকে গ্রেফতার করে দেশে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে ইন্টারপোল। পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ গুজব সৃষ্টিকারী বা ছড়ানোর সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে এবং তাদের আইনের আওতায় আনার কঠোর নির্দেশনা জারি করেছেন।
পুলিশ ও র‌্যাবের সাইবার বিভাগ বলছে, ভুয়া নামে মোবাইল ফোনের সিম কার্ড তুলে এবং ভুয়া আইডি খুলে গুজব ছড়ানোর ঘটনাগুলো ঘটছে। এজন্য প্রতিটি মোবাইল ফোন অপারেটরকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে সুনির্দিষ্ট তথ্য ব্যতীত কারো মোবাইল ফোনে সিমকার্ড ব্যবহার না করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কোন ব্যক্তি প্রতিটি অপারেটরের একাধিক সিম কিনতে পারবেন বলে, যে শর্ত রয়েছে, সে শর্ত শিথিল করতে বলা হয়েছে। গুজব ঠেকাতে বিটিআরসির (বাংলাদেশ টেলিকম মনিটরিং সেল) সঙ্গে সর্বক্ষণিক যোগাযোগ আছে। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি বিটিআরসিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে।
সিআইডির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, গুজবের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ৭০ জনই স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। গুজব ছড়ানোর দায়ে এখন পর্যন্ত ১১২টি ফেসবুক এ্যাকাউন্ট শনাক্ত করা হয়েছে। এসব এ্যাকাউন্ট অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, লিবিয়া ও সৌদি আবর থেকে ৬০ জন সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধী ব্যক্তি পরিচালনা করছে।