স্টাফ রিপোর্টার :
নগরীর বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে পুলিশী নির্যাতনে রায়হান উদ্দিন আহমদ হত্যার ঘটনায় সমাবেশ, বিক্ষোভ ও মানবন্ধনে এখন উত্তাল সিলেট মহানগরী। নিহত রায়হান হত্যার ২দিন প্রেরিয়ে গেলে এখন পর্যন্ত কোন অপরাধী ধরা পড়েনি। তবে নির্যাতনে রায়হানের মৃত্যু হওয়ার ঘটনার প্রাথমিক সত্যতাও পেয়েছে তদন্ত কমিটি। সিলেট পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরায় ধরা পড়েছে রায়হানকে ফাঁড়িতে আনা নেওয়ার দৃশ্য।
পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের ওই ফুটেজে দেখা যায়, গত শনিবার দিবাগত রাত ৩টা ৯ মিনিট ৩৩ সেকেন্ডে দুটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা বন্দরবাজার ফাঁড়িতে এসে থামে। সামনের অটোরিকশা থেকে ৩ পুলিশ সদস্যের সঙ্গে রায়হানকে নামতে দেখা যায়। তিনি সুস্থভাবেই হেঁটে হেঁটে পুলিশের সঙ্গে ফাঁড়িতে প্রবেশ করেন। এর প্রায় ৩ ঘণ্টা পর সকাল ৬টা ২২ মিনিটে একটি সিএনজিচালিত অটোরিক্সা আসে বন্দর ফাঁড়ির সামনে। এর দুই মিনিট পর ৬টা ২৪ মিনিট ২৪ সেকেন্ডে দুই পুলিশের কাঁধে ভর করে রায়হানকে সেই অটোরিক্সায় তুলতে দেখা যায়।
সূত্র জানায়, দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় বন্দর ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ সে সময় দায়িত্বে থাকা ৭ পুলিশ সদস্যকে। ইনচার্জ আকবর প্রথমে রায়হানকে ফাঁড়িতে নেওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। পরে সিলেট পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে তদন্ত কমিটি। সেই ফুটেজ দেখানোর পর সবাই মুখ খুলতে শুরু করেন। সোমবার বিকাল ৫টা পর্যন্ত তদন্ত কমিটির সামনে হাজির ছিলেন আকবর। তাকে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ (এসএমপি) এলাকা না ছাড়ার জন্য নির্দেশও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, গত রাত থেকে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মূলত গ্রেফতার এড়াতেই তিনি পালিয়ে গেছেন বলে দাবি করা হচ্ছে।
এদিকে, এ ঘটনায় প্রতিদিনই নগরীজুড়ে হচ্ছে বিক্ষোভ সমাবেশ, মানববন্ধন। তপ্ত রোদে দাঁিড়য়ে মানুষ হত্যাকারী পুলিশ সদস্যদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি জানাচ্ছেন। কিন্তু এখনো সেই সব পুলিশ সদস্যদের কাউকেই গ্রেফতার করা হয়নি। শুধু সাময়িক বরখাস্ত ও প্রত্যাহারেই সীমাবদ্ধ রয়েছে প্রশাসনিক এ্যাকশন। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন সিলেটের বিশিষ্টজনেরা।
সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদউল্লাহ শহিদুল ইসলাম শাহীন গণমাধ্যমে বলেন, সাময়িক বরখাস্ত বা প্রত্যাহার কোনো শাস্তি নয়। কিছুদিন পরই আবার তাদের অন্যত্র পদায়ন করা হবে। এই পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এসেছে তা খুবই গুরুতর। তাদের এই মামলায় আসামি করে দ্রুত গ্রেফতার করা প্রয়োজন। না হলে তদন্ত কার্যক্রমই বাধাগ্রস্ত হবে।
হাইকোর্টে রিট: রায়হান মৃত্যুর ঘটনায় স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বিচারপতি মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মহি উদ্দিন শামীমের হাইকোর্ট বেঞ্চে এ রিট দায়ের করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দ ফজলে এলাহী জনস্বার্থে এ রিট দায়ের করেন। রিটে স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশ মহাপরিদর্শক, সিলেটের পুলিশ কমিশনার, সিলেটের ডিসি-এসপিসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়েছে। রিট আবেদনে বিভিন্ন পত্রিকায় এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন সংযুক্ত করা হয়েছে। হাইকোর্টের বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীমের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে রিটটির শুনানি হবে বলে জানিয়েছেন এ আইনজীবী।
মামলা পিবিআইতে: রায়হান হত্যা মামলা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআইতে) স্থানান্তর করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার সিলেট মহানগর পুলিশের মুখপাত্র জ্যোতির্ময় সরকার এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, সকালে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে রায়হান হত্যা মামলা পিবিআইতে স্থানান্তর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পুলিশি নির্যাতনে মৃত্যুর ঘটনা পুলিশের অনুসন্ধানে প্রাথমিকভাবে প্রমাণ হওয়ায় মামলাটি নিরপেক্ষ কোনো তদন্ত সংস্থাকে দিয়ে তদন্তের দাবি ছিল রায়হানের মা সালমা বেগমসহ এলাকাবাসীর।
এর আগে সোমবার রায়হানের মৃত্যুর ঘটনায় সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (উত্তর) শাহরিয়ার আল মামুনকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- কোতোয়ালি থানার সহকারি কমিশনার নির্মল চক্রবর্তী ও এয়ারপোর্ট থানার সহকারী কমিশনার প্রবাস কুমার সিংহ।
বন্দর ফাঁড়ি ঘেরাও: রায়হান হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে সাধারণ ছাত্র জনতার ব্যানারে নগরীতে মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল ও বন্দরবাজার পুলিশ ফাাঁড়ি ঘেরাও হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার সকালে প্রথমে তারা নগরীর চৌহাট্টাস্থ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। পরে একটি বিক্ষোভ মিছিল সহকারে তারা বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ি ঘেরাও করে অবস্থান নেন ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এই ফাঁড়িতেই রায়হানকে ধরে এনে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যার অভিযোগ ওঠেছে। এসময় বিক্ষোভকারীরা রায়হান আহমদ হত্যার সাথে জড়িতদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।
বক্তারা বলেন, রায়হান আহমদ হত্যায় যাদের নাম এসেছে তাদের অনতিবিলম্বে গ্রেফতার করতে হবে। এসময় তারা প্রশ্ন রেখে বলেন, হত্যার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ সত্ত্বেও কেনো অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না। কেনো তাদের মামলার আসামি করা হচ্ছে না। অভিযুক্তরা বাইরে এভাবে ঘুরাঘুরি করতে থাকলে মামলার তদন্ত ব্যাহত হতে পারে।