কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে তার সরকার কোন নির্দিষ্ট এলাকাকে প্রাধান্য দেয় না। সামগ্রিকভাবে দেশের উন্নয়নের চিন্তা করে তাঁর সরকার পদক্ষেপ নেয়। বৃহস্পতিবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিদ্যুৎ বিভাগের বিভিন্ন প্রকল্প উদ্বোধনের সময় তিনি এ কথা বলেন। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্যুৎ ব্যবহারে জনসাধারণকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, নিজের এবং দেশের স্বার্থে বিদ্যুৎ অপচয় বন্ধ করে ব্যবহারে মিতব্যয়ী হতে হবে।
বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় নিজের এলাকা টুঙ্গিপাড়ায় গেলে কেমন অভিজ্ঞতা হতো, সে কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, হয়ত সারাদিনেও বিদ্যুত পেতাম কিনা সন্দেহ, পেতাম না। জেনারেটর দিয়ে চালাতে হতো বা হারিকেন জ্বালাতে হতো।
তিনি বলেন, দুর্ভাগ্য হলো, যে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকতে বাজেট দেয়ার সময় খুব গালভরা কথা বলত, গোপালগঞ্জের জন্য এটা দেব, ওটা দেব। আর বাজেট দেয়া শেষ হয়ে গেলে টাকাগুলো কেটে নিয়ে চলে যেত।
কিন্তু আমরা যখন উন্নয়ন করি, তখন কিন্তু আমরা এই রকম নির্দিষ্ট কোন জায়গাকে অবহেলা করি না। কাজেই আজকে সেটার একটা দৃষ্টান্ত পাচ্ছেন যে বগুড়া জেলায় (খালেদা জিয়ার নির্বাচনী এলাকা ও শ্বশুরবাড়ি) ১১০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র আমরাই প্রতিষ্ঠা করেছি এবং আমরা আজকে তা উদ্বোধন করছি।
শেখ হাসিনা বলেন, বিদ্যুত উৎপাদনে খরচ কিন্তু অনেক বেশি হয়। এত বেশি খরচের টাকা আমরা কিন্তু এখনও ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছি। অর্থাৎ উৎপাদনের খরচ যেটা হয়, তার থেকে কিন্তু কম পয়সায় গ্রাহকদের আমরা বিদ্যুত সরবরাহ করছি। সেই ক্ষেত্রে আমি গ্রাহকদের কাছে অনুরোধ করব যে আপনারা বিদ্যুত ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই মিতব্যয়ী হবেন, সাশ্রয়ী হবেন। অহেতুক বিদ্যুত আপনারা অপচয় করবেন না। বিদ্যুত ব্যবহারে সচেতন হলে বিদ্যুতের বিল কম আসবে, তাতে গ্রাহকেরই লাভ হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, অন্তত নিজেদের কথা চিন্তা করে বিদ্যুত বিল যাতে কম ওঠে সেদিকে লক্ষ্য রেখে বিদ্যুতটা সবাই ব্যবহার করবেন। অপচয়টা বন্ধ করবেন। এটা আমার বিশেষভাবে অনুরোধ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেক বেশি ভর্তুকি আমাদের দিতে হচ্ছে। কিন্তু এই ভর্তুকি সব সময় দেয়া সম্ভব না। এটা সবাইকে মাথায় রাখতে হবে। তবুও এখন যেহেতু আমরা উন্নয়নের জন্য ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করছি, সেজন্য মানুষের অসুবিধাগুলো আমরা দূর করতে চাচ্ছি। দেশের মানুষের কাছে বিদ্যুত সেবা পৌঁছে দিতে সরকারের নানা উদ্যোগের কথাও অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন তিনি।
২০০৯ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে শতভাগ বিদ্যুতায়নের অঙ্গীকার ছিল আওয়ামী লীগের। বৃহস্পতিবার ১৮ জেলার ৩১ উপজেলায় শতভাগ বিদ্যুতায়ন কার্যক্রমের উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী জানান, এরই মধ্যে দেশের ৯৭ দশমিক পাঁচ শতাংশ মানুষ বিদ্যুতের আওতায় এসেছে।
তিনি বলেন, ২০২০ সালে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনে ব্যাপক কর্মসূচী নেয়া হয়েছিল। ২০২০ সাল থেকে ২০২১ সাল মুজিববর্ষ ঘোষণা করে ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বড় পরিসরে পালনের পরিকল্পনা হয়েছিল। কাজেই ২০২০ থেকে ২০২১Ñ এই বছরের মধ্যে আমরা সমগ্র বাংলাদেশের প্রত্যেকটা ঘরে আলো জ্বালব। শতভাগ বিদ্যুৎ আমরা দিতে পারব। ইতোমধ্যে আমরা ৯৭ দশমিক পাঁচ ভাগ জনগণকে বিদ্যুৎ দিতে সক্ষম হয়েছি এবং আমরা আশা করি, এই ২০২১ সালের মধ্যে আমরা শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ দিতে পারব। সেভাবে আমরা পরিকল্পনাও নিয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে তাঁর সরকার ২০২১ সাল নাগাদ ২৪ হাজার মেগাওয়াট ও ২০৩০ সাল নাগাদ ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ৪১ সাল নাগাদ ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা প্রহণ করেছে। তিনি আরও বলেন, আমরা অধিকতর শিল্পায়নের লক্ষ্যে সারাদেশে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করছি আর এভাবে আরও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছি। এজন্য বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ প্রয়োজন। শেখ হাসিনা বলেন, সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ স্থাপন করেছে। দেশে যত বেশি আইসিটি ব্যবহার বাড়বে, বিদ্যুতের চাহিদাও ততই বৃদ্ধি পাবে।
শোষিত বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজীবন সংগ্রামের কথা অনুষ্ঠানে তুলে ধরে তাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনাও স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে হত্যার পর থেকে হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়। মিলিটারি ডিক্টেটররা মার্শাল ল জারি করে এদেশের শাসনভার হাতে নেয় এবং তারা স্বাভাবিকভাবেই অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে সেই ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য স্বজনপ্রীতি, তোষামোদি এবং দুর্নীতিকে তারা স্থায়ী রূপ দিয়ে যায়। দেশের উন্নয়ন না করলেও তাদের ভাগ্যের উন্নয়ন হয়। কিছু লোককে তারা অর্থশালী, সম্পদশালী করে দেয়, যাদের শক্তিতে তারা ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু দেশের মানুষের ভাগ্য, সেই ভাগ্য বিড়ম্বিতই থেকে যায়। দেশের মানুষ শোষিত বঞ্চিতই থেকে যায়। এটাই হচ্ছে সব থেকে দুর্ভাগ্য। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর ছয় বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে সারা বাংলাদেশ ঘুরে মানুষের হাহাকার, দুঃখ আর দুর্দশার চিত্র দেখার অভিজ্ঞতাও অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।
দেশবাসী আওয়ামী লীগকে নির্বাচিত করে জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণের সুযোগ দেয়া বাংলার মানুষের কাছে তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
বৃহস্পতিবার গণভবন থেকে দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ১১টি গ্রিড উপকেন্দ্র, ছয়টি সঞ্চালন লাইন এবং ৩১টি উপজেলায় শতভাগ বিদ্যুতায়ন কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন তিনি।
উদ্বোধন হওয়া দুই কেন্দ্র হচ্ছে বগুড়ায় কনফিডেন্স পাওয়ার কোম্পানির ১১০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুত কেন্দ্র এবং নোয়াখালীতে এইচএফ পাওয়ার কোম্পানির ১১৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার নতুন কেন্দ্র উদ্বোধন করেন।
এছাড়া মহাস্থানগড়, রাজশাহী (উত্তর), চৌদ্দগ্রাম, ভালুকা, বেনাপোল, শরীয়তপুর, শ্যামপুর, শেরপুর (বগুড়া), কুড়িগ্রম, নড়াইল ও রাজেন্দ্রপুরে ১১টি গ্রিড উপকেন্দ্র এবং পটুয়াখালী (পায়রা)-গোপালগঞ্জ ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন (প্রথম সার্কিট), যশোর-বেনাপোল ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইন, শরীয়তপুর-মাদারীপুর ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইন, তিস্তা-কুড়িগ্রাম ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইন, মাগুরা-নড়াইল ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইন ও পটুয়াখালী-পায়রা ২৩০ কেভি সঞ্চালন লাইনেরও উদ্বোধন হয় বৃহস্পতিবার।
বাংলাাদেশের বিদ্যুৎ খাত : বঙ্গবন্ধু থেকে বঙ্গবন্ধু কন্যা শীর্ষক এক উপস্থাপনায় বিদ্যুত বিভাগের সচিব ড. সুলতান আহমেদ বলেন, বঙ্গবন্ধু তার স্বল্পকালীন শাসনামলে গ্রামীণ জনপদে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়ে ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়ন করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ড. সুলতান ১৯৭৫ সালে প্রকৌশলীদের এক সম্মেলনে জাতির পিতার ভাষণকে উদ্ধৃত করে বলেন, বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন শতকরা ১৫ ভাগ মানুষ যেখানে বসবাস করে শুধু সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে উন্নয়ন হবে না। এজন্য ৮৫ ভাগ অধিবাসীর গ্রামে বিদ্যুত সরবরাহ করতে হবে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হলে আমাদের আর বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করতে হবে না বলে ১৯৭৫-এ উল্লেখ করেন জাতির পিতা। জাতির পিতা এই স্বল্পকালীন সময়ে আশুগঞ্জ, ঘোড়াশাল এবং সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার হাব গড়ে রেখে যান। এই পাওয়ার হাবের জ্বালানি সরবরাহের জন্য তিনি পাঁচটি গ্যাস ক্ষেত্র কিনে রেখে যান। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে মেগাবিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণ করেছেন তা তুলে ধরেন। এখন দেশে ৯৭ দশমিক ৫ ভাগ মানুষ বিদ্যুত পাচ্ছে। শীঘ্রই শতভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুত পৌঁছে যাবে।
অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিমসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।