কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পঁচাত্তরের ১৫ আগষ্ট তাঁর মা বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব খুনীদের কাছে জীবন ভিক্ষা চাননি উল্লেখ করে বলেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ সঠিকভাবে ধারণ করে তাঁর সঙ্গেই জীবন উৎসর্গ করে গেছেন বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব। তিনি তো নিজে বাঁচতে চাননি। তিনি সাহসের সঙ্গেই সেখানে একথাই বলেছেন, ‘আমার স্বামীকে হত্যা করেছ, আমি তাঁর কাছেই যাব।’ সেখানেই তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। কাজেই জীবনে-মরণে তিনি (বঙ্গমাতা) আমার বাবার (বঙ্গবন্ধু) একজন উপযুক্ত সাথী হিসেবেই চলে গেছেন।
শনিবার বঙ্গবন্ধু শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ৯০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি মিলনায়তনে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে আবেগজড়িত কণ্ঠে তাঁর বড় মেয়ে শেখ হাসিনা বঙ্গমাতার জীবনে সংগ্রাম ও ত্যাগের কথা তুলে ধরে বলেন, ত্যাগের মধ্য দিয়ে একটা সংসারকে সুন্দর করা যায়, একটি প্রতিষ্ঠানকে সুন্দর করা যায়, একটা দেশকে সুন্দর করা যায়। চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে উঠে নিজেকে বিলিয়ে দেয়া এর চেয়ে বড় আর কিছু হয় না। আমার মা সেই দৃষ্টান্তই দেখিয়ে গেছেন।
‘বঙ্গমাতা ত্যাগ ও সুন্দরের সাহসী প্রতীক’ শীর্ষক প্রতিপাদ্য নিয়ে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেছা ইন্দিরার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও সাবেক কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী। আরও বক্তব্য রাখেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মেহের আফরোজ চুমকি ও মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী রওশন আক্তার। অনুষ্ঠানে বঙ্গমাতার কর্মময় জীবনের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র পরিবেশন করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী শিশু একাডেমি ছাড়াও ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে গোপালগঞ্জের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গোপালগঞ্জে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ১০০ মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীকে ল্যাপটপ, দরিদ্র ও অসহায় নারীদের মধ্যে ৩ হাজার ২০০ সেলাই মেশিন এবং এক হাজার দরিদ্র নারীকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে জনপ্রতি ২ হাজার টাকা করে বিতরণ করেন প্রধানমন্ত্রী।
গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসক শাহিদা সুলতানার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্রশিক্ষণ নেয়া ও সেলাই মেশিনপ্রাপ্ত সাবিনা ইয়াসমীন এবং ল্যাপটপ পাওয়া মেধাবী ছাত্রী সামিয়ে রহমান লিসা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বক্তব্য রাখেন। তারা প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং প্রধানমন্ত্রী যেন এভাবেই বাংলার প্রতিটি মানুষকে সহযোগিতা করতে পারেন, সেজন্য তাঁর দীর্ঘায়ুও কামনা করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবন প্রান্তে এ সময় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মোঃ তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যাকান্ডের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, যারা হত্যা করেছে তারা আমাদের চেনা। অনেক সেনা কর্মকর্তা আমাদের বাসায় এসেছে। আমার মায়ের হাতের খাবারও খেয়েছে। আমাদের সেই অভিজ্ঞতা রয়েছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমার বাবাকে গ্রেফতার করতে যখন এসেছিল তখনও কিন্তু তাদের একটা উদ্দেশ্য ছিল হত্যা করা। কিন্তু তারা সেই সাহস দেখায়নি, হত্যা করতে পারেনি।
তিনি বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য যে বাংলাদেশ আমার বাবা নিজে সৃষ্টি করলেন, যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাঁর নিজের হাতে সৃষ্টি। যেখানে পাকিস্তান আমলে কোন সেনাবাহিনীর সদস্যরা মেজরের উপরে কোন প্রমোশন পেত না। আর স্বাধীন বাংলাদেশে যেই মেজরদের তিনি নিজে প্রমোশন দিয়ে মেজর জেনারেল করেছিলেন সেই মেজর জেনারেল জিয়া (জিয়াউর রহমান) থেকে শুরু করে মেজর হুদা, কর্ণেল ফারুক, কর্ণেল রশীদরা। খুনী কর্ণেল ফারুক তো আমাদের বাড়িতে ডিউটিতেই ছিল সিকিউরিটির জন্য। তারাই খুনটা করল। আর ডালিম, তার বউ, তার শাশুড়ি তো সর্বক্ষণ আমাদের বাসায়। এমন কোন দিন নেই তারা না আসত। তাদের দাওয়াত প্রয়োজন হতো না। যখন তখনই আসত। তারপরও বেইমানি মুনাফেকি তারা করেছে এবং কিভাবে? আপনারা একবার চিন্তা করে দেখেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা এ দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম। মুজিববর্ষ আমরা উদযাপন করছি। আমাদের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত দেশ হিসেবে গড়ে উঠবে। কিন্তু এই করোনাভাইরাস আমাদের সব কাজকে বাধাগ্রস্ত করল। এখানে কিছু করার নেই। কারণ বিশ্বব্যাপী এ সমস্যা। তারপরও আমি মনে করি যে, আমরা এই অবস্থা থেকে অবশ্যই উত্তরণ ঘটাব এবং বাংলাদেশকে আমরা জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলব। আমার মায়ের (বঙ্গমাতা) আত্মত্যাগটাও বৃথা যাবে না। লাখো শহীদের আত্মত্যাগ বৃথা যেতে পারে না।
মা বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিবের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, মহীয়সী নারী শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব ছিলেন বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একজন যোগ্য ও বিশ্বস্ত সহচর এবং বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের সহযোদ্ধা। বঙ্গমাতা অসাধারণ বুদ্ধি, সাহস, মনোবল, সর্বসংহা ও দূরদর্শিতার অধিকারী ছিলেন এবং আমৃত্যু দেশ ও জাতি গঠনে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন।
আবেগজড়িত কণ্ঠে সরকারপ্রধান বলেন, আজকে বঙ্গমাতার জন্মদিন। সেই জন্মের পর ৩ বছর থেকেই পিতা-মাতা সব হারিয়ে সারাটা জীবন শুধু সংগ্রামই করে গেছেন। কিন্তু এই দেশের স্বাধীনতা, এই স্বাধীনতার জন্য তিনি যে কত দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন, সেটা আমরা জানি। এই দেশ স্বাধীন হবে, বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি আসবে, বাংলাদেশের মানুষ ভাল থাকবে।
সংসার সামলে প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর সহধর্মিনী সহযোগিতা করতেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিটি কাজে আমার মাকে দেখেছি বাবার পাশে থেকে সহযোগিতা করেছেন। কখনও সংসারের কোন সমস্যা নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বিরক্ত করেননি বা বলেনওনি। বরং বেশির ভাগ সময় তো আমার বাবা কারাগারে ছিলেন। একটানা দুই বছরও তিনি কারাগারের বাইরে থাকেননি। কিন্তু আমার মা যখন কারাগারে দেখা করতে যেতেন তখন নিজেই বঙ্গবন্ধুকে বলতেন- চিন্তার কিছু নেই। তোমার এগুলো দেখা লাগবে না, আমি সব দেখব। ঠিক সেভাবেই করে গেছেন তিনি। যার ফলে আমার বাবা নিজে সম্পূর্ণভাবে একটা দেশের জন্য কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা আরও বলেন, আমাদের মানুষ করার দায়িত্ব আমার মায়ের হাতেই ছিল। তার পাশাপাশি বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ প্রতিটি সংগঠনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল। নির্দেশনা দেয়া বা বাইরের অবস্থা জেলখানায় থাকা আব্বাকে (বঙ্গবন্ধু) জানানো, বাবার নির্দেশনা নিয়ে এসে সেগুলো পৌঁছে দেয়া। এই কাজগুলো বঙ্গমাতা খুব দক্ষতার সঙ্গে করতেন।
বঙ্গমাতার মধ্যে কোন অহমিকা বোধ ছিল না জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার বাবা যখন প্রধানমন্ত্রী হয়ে ফিরে এলেন তখনও কিন্তু আমার মায়ের মধ্যে এই অহমিকা বোধ কখনও ছিল না। তিনি কখনও সরকারী বাসভবনে বসবাস করেননি। কাজের জন্য আমার বাবা সকালে চলে আসতেন। বাড়ি থেকে নাস্তা করে চলে আসতেন। আবার দুপুরে আমার মা নিজের হাতে রান্না করে টিফিন ক্যারিয়ারে করে বঙ্গবন্ধুর কাছে পাঠিয়ে দিতেন। রান্নাটা সব সময় নিজের হাতেই মা করতেন। তিনি যে প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী পাকের ঘরে গিয়ে রান্না করবেন সেসব চিন্তা তাঁর কখনও ছিল না।’নিজের মায়ের রান্না খুব সুস্বাধু ছিল জানিয়ে তাঁর বড় কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, আমার মায়ের রান্না খুবই সুস্বাধু ছিল।
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা সন্তানদের মাটির দিকে চেয়ে চলতে শিখিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা শিক্ষা পেয়েছি বাবা-মায়ের কাছ থেকে মাটির দিকে তাকিয়ে চলার। অন্তত তোমার চেয়ে খারাপ অবস্থায় কে আছে তাকে দেখো। উপরের দিকে না, তোমার চেয়ে কে ভাল আছে সেটা তোমার চেয়ে খারাপ যারা আছে তাদের দিকে দেখনো এবং সেটাই উপলব্ধি করো। কখনো নিজের দৈন্যতার কথা বলতেন না। কখনও কোন চাহিদা ছিল না। নিজে কোনদিন কিছু চাননি। সব সময় তিনি দিয়ে গেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার মা গণভবনে বা সরকারী বাসভবনে থাকেননি। কারণটা হচ্ছে তিনি বলতেন-‘আমার ছেলে-মেয়েকে নিয়ে সরকারী বাসভবন বা শানশওকতে থাকব না। তাঁরা বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত হোক সেটা আমি চাই না। বিলাসিতায় আমরা যেন গা না ভাসাই সেটার ব্যাপারে তিনি (বঙ্গমাতা) যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। তিনি সব সময় আমাদের সেই শিক্ষায় দিয়েছেন।’
বেগম ফজিলাতুন নেছার জীবন ও কর্ম থেকে রসদ নিয়ে নিজেদের গড়ে তুলতে বর্তমান প্রজন্মের নারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকা অবস্থায় বেগম মুজিব একদিকে সংসার সামলাতেন আর অন্যদিকে দলীয় নেতাকর্মীদের খোঁজ-খবর খবর রাখতেন। পাশাপাশি দক্ষতার সঙ্গে সংগঠন পরিচালনা করে সঠিক সিদ্ধান্তও দিতেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে বঙ্গমাতার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তিনি (বঙ্গমাতা) যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। বিশেষ করে আত্মত্যাগী, লাঞ্ছিত মা-বোনদের সহযোগিতা করা, তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করাসহ ব্যক্তিগতভাবে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সান্ত্বনা দেন এবং সামাজিকভাবে তাদের প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নেন।
তিনি বলেন, একজন সাধারণ বাঙালি নারীর মতো স্বামী-সংসার, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও বাংলাদেশের মহাসংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার পর দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গমাতা অনন্য ভূমিকা রেখে গেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রাজনৈতিক সাফল্যেও বঙ্গমাতা উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। জাতির পিতা রাজনৈতিক কারণে প্রায়শই কারাগারে বন্দী থাকতেন। এই দুঃসহ সময়ে তিনি হিমালয়ের মতো অবিচল থেকে একদিকে স্বামীর কারা মুক্তিসহ আওয়ামী লীগ পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সবচেয়ে বড় কথা, রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভিন্ন সময় যখন একটা কঠিন সিদ্ধান্তের বিষয়। সেখানে আমি দেখেছি, আমাকে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আমাদের অনেক বড় বড় অভিজ্ঞ নেতারাও যেখানে সঠিক সিদ্ধান্তটা নিতে পারেননি। হয়তো বা একটা ভুল সিদ্ধান্ত দিতে গেছেন। সেখানে আমার মা ঠিক সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তটাই নিয়েছেন।