করোনা আতঙ্কে ৯০ হাজার কারাবন্দী

5

কাজিরবাজার ডেস্ক :
করোনাভীতি নিয়ে কারা প্রকোষ্ঠে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে দেশের ৬৮ কারাগারে আটক প্রায় ৯০ হাজার বন্দী। বন্দীদের করোনাভাইরাস মুক্ত রাখতে ও সচেতনতা তৈরির জন্য শত রকম চেষ্টা সত্ত্বেও কোনক্রমেই বন্দীদের মাঝে এ আতঙ্ক দূর হচ্ছে না। বন্দী ও তাদের স্বজনদের মনে এক অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে।
এদিকে বন্দীর সঙ্গে স্বজনদের সাক্ষাত সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিযেছে কারা কর্তৃপক্ষ। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বন্দীর সঙ্গে স্বজনদের সাক্ষাত বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছে কারা অধিদফতর। তবে সরাসরি সাক্ষাতের বিকল্প হিসেবে স্বজনদের সঙ্গে নিয়মানুযায়ী প্রতি সপ্তাহে একবার মোবাইল ফোনে কথা বলার পদ্ধতি চালু রেখেছে কর্তৃপক্ষ। করোনাভাইরাসের প্রকোপ বন্ধে কারাভ্যন্তরে বন্দীদের মাঝে আড্ডা দেয়া বন্ধ করা, বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া এক সেল থেকে অন্য সেল বা ওয়ার্ডে বন্দীদের চলাচল করতে না দেয়া, রান্নার সময় সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত হয়ে রান্না করা, ডিউটি শিফটের সময় কারাগারের সকল কারারক্ষী থেকে শুরু করে সকল স্টাফদের হাতে স্যানিটাইজার দিয়ে জীবাণুমুক্ত করা, হ্যান্ড গ্লাভস ব্যবহার করা, নিয়মিত ওষুধ ছিটানো, কারা কর্মকর্তা কর্তৃক নিয়মিত করোনাভাইরাস নিয়ে সচেতনতামূলক আলোচনাসহ নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে কারা কর্তৃপক্ষ। এরপরও অজানা আতঙ্কে কারাভ্যন্তরে দিন কাটাচ্ছে বন্দীরা। তবে এ আতঙ্ক শুধু কারাবন্দীই না তাদের স্বজন ও বন্দীর সার্বিক নিরাপত্তায় নিয়োজিত কারা প্রশাসনেও বিরাজ করতে দেখা গেছে। সর্বশেষ তথ্যমতে, দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক ৪০ বন্দীকে সন্দেহজনকভাবে হোম কোয়ারেন্টাইনে রেখে পর্যবেক্ষণ করছে কারা কর্তৃপক্ষ। এছাড়া পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দীন রোডের একটি বাড়িতে কারারক্ষীরা তাদের পরিবার নিয়ে বসবাস করেন এমন স্থানে করোনা রোগী পাওয়ায় সূত্রমতে ১৪ কারারক্ষীকে সন্দেহজনক বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে পাঠিয়ে দিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। বন্দীর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এসব কারারক্ষী ঐ বাড়িটিতে বসবাস করতেন বলে জানা গেছে। অপরদিকে বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে রাখা কারাবন্দীদের কঠোর পর্যবেক্ষণে রেখেছেন কারা কর্তৃপক্ষ। কারাগারকে করোনাভাইরাসমুক্ত রাখতে প্রতিটি কারাগারে নেয়া হয়েছে নানা ব্যবস্থা।
কারাসূত্র জানায়, এ পর্যন্ত মোট ৪০ বন্দীকে কারাভ্যন্তরে সন্দেহজনক কোয়ারেন্টাইনে রেখেছে কারা কর্তৃপক্ষ। এসবের সঙ্গে কোন বন্দীকেই মিশতে দেয়া হচ্ছে না। এছাড়া সকল বন্দীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সাময়িকভাবে স্বাক্ষাতের বিকল্প মোবাইল ফোনেও কথা বলা বন্ধ রেখেছে কারা কর্তৃপক্ষ। ১৪ দিন পার হওয়ার পর ডাক্তার কর্তৃক নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত ঘোষণার পরই কেবল তাদের অন্য বন্দীদের সঙ্গে মেশার সুযোগ দেয়া হবে বলে জানা গেছে।
এদিকে কারাগারে আটক বন্দীদের বিশেষ প্রয়োজন না হলে বা শারীরিক অবস্থার বেশি অবনতি না হলে কোন বন্দীকে কারাগারের বাইরের হাসপাতালে পাঠাতে চায় না কারা কর্তৃপক্ষ। প্রাথমিকভাবে যে কোন বন্দী রোগীর চিকিৎসায় কারাগারের নিজস্ব ডাক্তারের পরামর্শ প্রদান করতে বলা হয়েছে।
এর বাইরে যদি সম্ভব হয় বন্দীকে কারাভ্যন্তরে রেখেই জেলা সদর বা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে চিকিৎসা প্রদানের কথা বলা হয়েছে। এরপরেও বন্দী সুস্থ না হলে একান্ত প্রয়োজনে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রাজধানীর বিভিন্ন বিশেষায়িত হাসপাতালে ভর্তি করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদানের জন্য উৎসাহিত করছে কারা অধিদফতর।
সূত্র জানায়, করোনা আতঙ্কের কারণেই এমন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে কারা কর্তৃপক্ষ। এর ফলে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। এছাড়া কারাবন্দীরাও করোনার এই ভয়াল সময়ে কোন প্রকার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাইরের হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণে রাজি হচ্ছেন না। কিছু বন্দী অতি জরুরী না হওয়ায় বিভিন্ন ছোটখাটো অপারেশন বা ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করোনা সমস্যা সমাধানের পরই করতে আগ্রহ প্রকাশ করছেন বলে বিভিন্ন কারাগার সূত্রে জানা গেছে। সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন কারাগারে বিশেষ ব্যবস্থায় সন্দেহজনকভাবে কোয়ারেন্টাইনে থাকা বন্দীদের মধ্যে এ পর্যন্ত করোনা পজেটিভের কোন লক্ষণ খোঁজে পায়নি কারা অধিদফতর। এরপরও এসব বন্দীকে বিশেষভাবে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
কারা অধিদফতর সূত্র জানায়, করোনা আক্রান্ত হয়েছেন বা লক্ষণ রয়েছে বা বিদেশ ফেরত যে কোন বন্দী কিংবা দেশের যেসব এলাকা লকডাউন বা পূর্বেই শাটডাউন করা হয়েছে এমন এলাকার বন্দীকে কারাগারে প্রবেশের পরপরই প্রাথমিকভাবেই ১৪ দিন আলাদা করে রাখা হচ্ছে। এর বাইরে বিভিন্ন কারাগারের কোয়ারেন্টাইনে থাকা মোট ৪০ বন্দী এখন পর্যন্ত সুস্থ রয়েছেন বলে অধিদফতর সূত্র নিশ্চিত করেছেন। একইসঙ্গে কোন বন্দী নতুন করে সর্দি কাশি জ্বর শরীর বা মাথা ব্যথায় আক্রান্ত হলে সঙ্গে সঙ্গেই তাদের সম্পূর্ণ আলাদা করে চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে। এসব বন্দীকে কোনক্রমেই ওয়ার্ড বা সেল থেকে নির্দিষ্ট সময় চিকিৎসা প্রদান না করা পর্যন্ত বের হতে দেয়া হচ্ছে না। অপরদিকে জেলকোড ও কারাবিধির কঠোরভাবে প্রয়োগের কারণে বন্দীরা হঠাৎ করেই বেশ অস্বস্তিতে পড়ছেন।
করোনার আতঙ্কে কারা কর্তৃপক্ষ দেশের সকল কারাগারের উৎপাদন শাখার (এমডি শাখা) সকল কাজ বন্ধ রেখেছে বলে জানা গেছে। যদিও এতে সশ্রম দন্ডপ্রাপ্ত বন্দীর কাজের চাপ কিছুটা কমেছে। একসঙ্গে কাজ করার ফলে করোনার প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়তে পারে এমন আশঙ্কায় সকল প্রকার কারাপণ্য আপাতত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে অধিদফতর। পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত এ আদেশ বহাল থাকবে বলে জানা গেছে।
কারাসূত্র জানায়, অধিদফতরের নির্দেশে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ও সমন্বয়ের জন্য দেশের প্রতিটি কারাগারে জেল সুপারের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কারাগার বা অধিক বন্দী আটক রয়েছেন এমন কারাগারের ক্ষেত্রে ৫ সদস্য বিশিষ্ট ও ছোট বা জেলা কারাগারের জন্য ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি বিশেষ কমিটি গঠন করেছে। উক্ত কমিটি করোনার প্রাদুর্ভাব কমাতে কাজ করবে ও সব সময়ই যে কোন প্রয়োজনে কারা উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাৎক্ষণিক যোগাযোগ করবে। এছাড়া কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম মোস্তফা কামাল পাশার নেতৃত্বে ও অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল আবরারের সমন্বয়ে দেশের সকল কারা উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন্স) ও জেল সুপার, জেলার সার্বক্ষণিক কাজ করছেন। উক্ত কমিটি করোনা সংশ্লিষ্ট সার্বক্ষণিক তথ্য প্রদান করছেন বলে জানা গেছে। বিশেষ প্রয়োজনে নানা নির্দেশন প্রদান করছে উক্ত কমিটি।
জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন জেলা ও কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক বন্দীদের সঙ্গে তাদের স্বজনদের আপাতত দেখা না করতে কারাগারে না আসার আহ্বান জানাচ্ছে সেনাবাহিনী, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। একইসঙ্গে তারা করোনার ভয়াবহতা রোধে কারা কর্তৃপক্ষকেও অস্থায়ীভাবে সাক্ষাত ব্যবস্থা বন্ধ রাখতে অনুরোধ করেছে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানীগঞ্জের জেলার মাহবুবুল ইসলাম বলেন, করোনার ভয়াবহ প্রকোপ বন্ধ করতে অস্থায়ীভাবে স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাত বন্ধ রাখা হয়েছে। এছাড়া করোনার জন্য গঠিত ৫ সদস্যের টিম ২৪ ঘণ্টাই নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করছে।