কাজিরবাজার ডেস্ক :
অবশেষে ৪৭ বছরের সম্পর্ক ভেঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বেরিয়ে গেল ব্রিটেন। গণভোটের পর তিনবছর সীমাহীন চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অবশেষে পূর্ব নির্ধারিত ৩১ জানুয়ারি শুক্রবারই কার্যকর হলো ব্রেক্সিট। যদিও চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত অন্তর্ববর্তী ব্যবস্থা হিসেবে ইইউ-ব্রিটেনের বাণিজ্যিক ও অন্যান্য সম্পর্ক প্রায় একই থাকবে। তবে এই সময়ের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোন প্রশাসনিক কাজ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারবে না ব্রিটেন। উল্লেখ্য, ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি ব্রিটেন ইউরোপিয়ান ইকোনমিক কমিউনিটিতে (ইইসি) যুক্ত হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৩ সালে এটি ইইউ হিসেবে নতুনভাবে গঠিত হয়।
শুক্রবার স্থানীয় সময় মধ্যরাতে (১১টা ৪০ মিনিট) আর (বাংলাদেশ সময় শনিবার ভোর পাঁচটায়) আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হয় ব্রেক্সিট। এর আগে বুধবার স্থানীয় সময় বিকেলে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে ঐতিহাসিক ভোটে অনুমোদন পায় ব্রেক্সিট চুক্তি। মূলত এই অনুমোদনই স্পষ্ট করে দিয়েছে ব্রেক্সিটের পথ। অবশ্য ইউরোপীয় পার্লামেন্ট যে বিপুল ভোটে চুক্তি অনুমোদন দেবে, সেটা আগে থেকেই ধারণা করেছিলেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা। এদিকে, এই দিনটি ব্রিটেনের ‘নতুন যুগের উদয়’ বলে স্বাগত জানিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। তিনি বলেন, ৪৭ বছর পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগের জন্য প্রস্তত ব্রিটেন। আর এটা ব্রিটেনের জন্য শেষ নয়, বরং শুরু। এসময় তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার বিষয়টি ‘একটি সত্যিকারের পুনরুদ্ধার এবং পরিবর্তনের মুহূর্ত’ হিসেবে বর্ণনা করেন। এছাড়া ব্রিটেনের উত্তরণের সময় শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কিছু পরিবর্তন আসবে বলে প্রত্যাশ্যা প্রকাশ করছেন জনসন।
ইইউ থেকে যুক্তরাজ্য আনুষ্ঠানিকভাবে বেরিয়ে গেলেও দুই পক্ষের মধ্যকার এতদিনের বেশিরভাগ চুক্তিই আরও কিছুদিন বহাল থাকবে। ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত একটি ‘রূপান্তর কাল’ চলবে, এ সময়ের মধ্যে যুক্তরাজ্য ও ইইউ তাদের ভবিষ্যত সম্পর্কের রূপরেখা ঠিক করে নেবে; সুযোগ থাকবে আগের সকল চুক্তি পর্যালোচনা ও পরিবর্তনের। এ সময়কালের ভেতরই যুক্তরাজ্য ইউরোপের জোটটির সঙ্গে একটি স্থায়ী অবাধ বাণিজ্য চুক্তিতে উপনীত হওয়ার চেষ্টা চালাবে। নতুন চুক্তি না হওয়া পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে ইইউর আগের আইনগুলোই বহাল থাকবে। এসব আইনের মধ্যে জোটের ভেতরকার সদস্য রাষ্ট্রের নাগরিকদের অবাধ চলাচলের বিষয়টিও রয়েছে।
লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন এক বিবৃতিতে ইউরোপের জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর যুক্তরাজ্য যেন ‘অন্তর্মুখী’ না হয়ে ‘সত্যিকারের আন্তর্জাতিকতাবাদী, বৈচিত্র্যময় এবং বহির্মুখী’ দেশে পরিণত হয় তা নিশ্চিত করতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ২০১৬ সালের গণভোটে ৫২ শতাংশ জনগণ ব্রেক্সিটের পক্ষে রায় দেয়ার পর ব্রিটিশ পার্লামেন্ট প্রথমে ২০১৯ সালের ৩১ মার্চের মধ্যে বিচ্ছেদ সম্পন্নের তারিখ ঠিক করেছিল। কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে’র সঙ্গে ইইউর চুক্তি পার্লামেন্টে কয়েক দফা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর ব্রেক্সিট কার্যকরের এ সময়সীমা বাড়ানো হয়।
মে পরে দায়িত্ব ছেড়ে দিলে জনসন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন; কট্টর ব্রেক্সিটপন্থী হিসেবে পরিচিত এ টোরি নেতা কয়েক মাসের মধ্যে নতুন নির্বাচন ডাকেন। ডিসেম্বরের ভোটে বিপুল জনসমর্থন লাভের পর তার সঙ্গে ইইউর চুক্তিটিও ব্রিটিশ পার্লামেন্টে অনুমোদিত হয়। এদিকে ইইউ জোটকে ‘আবেগঘন বিদায়’ জানাতে শুক্রবার স্থানীয় সময় বিকেল ৩টায় হোয়াইটহলের সামনে ব্রেক্সিটবিরোধীরা কর্মসূচী পালন করে। পরে ব্রেক্সিটপন্থীরা পার্লামেন্ট চত্বরে একত্রিত হয়ে ‘বন্ধনমুক্তি’ উদ্ করে। হোয়াইটহলের আশপাশের ভবনগুলোকে আলোকসজ্জা ও পার্লামেন্ট চত্বরের প্রতিটি খুঁটিতে খুঁটিতে ছিল ইউনিয়ন জ্যাক। এছাড়া যুক্তরাজ্যের ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়াকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রকাশ করা হয়েছে ৫০ পয়সার বিশেষ কয়েন। ব্রেক্সিটের নির্ধারিত সময়ের পরপরই ব্রাসেলসের ইইউ প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে যুক্তরাজ্যের পতাকা নামিয়ে ফেলা হয়। যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ ব্রাসেলসের গ্রান্ডে প্লেস আলোকিত হবে লাল, সাদা ও নীল রঙে। ২০১৬ সালের গণভোটে জোটে থাকার পক্ষে রায় দেয়া স্কটল্যান্ডের বিভিন্ন শহরে মোমবাতি প্রজ্বালন করা হয়।
ব্রেক্সিটের ফলে যা হারাবে ব্রিটেন : ব্রেক্সিটের ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে ব্রিটেন। এর মধ্যে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যপদ হারাবেন যুক্তরাজ্যের এমপিরা। নাইজেল ফারাজ এবং অ্যান উইড্ডেকমবের মতো পরিচিত মুখগুলোসহ যুক্তরাজ্য থেকে ৭৩ জন সদস্য ছিলেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টে। ব্রেক্সিট কার্যকর হওয়ার ফলে তারা তাদের সদস্যপদ হারাবেন। ভবিষ্যতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কাউন্সিল সামিটে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন অংশ নিতে চাইলে বিশেষ তার জন্য বিশেষ আমন্ত্রণ প্রয়োজন হবে। ব্রিটিশ মন্ত্রীরাও এখন থেকে আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিয়মিত বৈঠকগুলোতে অংশ নিতে পারবেন না। ত্রিশ বছর পর দেশটিতে আবার ফিরে আসবে নীল রংয়ের পাসপোর্ট। ২০১৭ সালে এ পরিবর্তনের কথা ঘোষণা দিয়ে তখন অভিবাসনমন্ত্রী ব্রান্ডন লুইস দেশটির ঐতিহ্যবাহী নীল ও সোনালি ডিজাইনের পাসপোর্ট আবার ফিরিয়ে আনার কথা বলেছিলেন। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের যে বিভাগ আলোচনা চালিয়েছিল সেই বিভাগটি বন্ধ হয়ে যাবে। পাশাপাশি সন্দেহভাজন অপরাধী যদি কেউ যুক্তরাজ্য থেকে পালিয়ে গিয়ে জার্মানিতে আশ্রয় নেয় তাহলে তাকে ফেরত পাবে না যুক্তরাজ্য। কারণ সংবিধান অনুযায়ী, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ ছাড়া অন্য কোন দেশের নাগরিককে প্রত্যর্পণের সুযোগ নেই।