মৌলভীবাজার থেকে সংবাদদাতা :
নিহত সুভাষ রায়ের পরিবারের বড় মেয়ে প্রিয়াংকা রায়ের বিয়ে ছিলো গত ২২ জানুয়ারি। সোমবার (২৭ জানুয়ারি) ছিলো বৌ-ভাত। আত্মীয়-স্বজনদের সাথে ভাগাভাগি করে নেওয়া বিয়ের আনন্দের রেশ যেন ছিলও শুধু বাকি। কিন্তু সকাল সাড়ে ৯টায় ঘটে যাওয়া এই অগ্নিকান্ডের তাদের পরিবার থেকে কেড়ে নিলো এক শিশুসহ ৫ প্রাণ।
কিছুদিন আগেই আত্মীয়ের বিয়েতে হবিগঞ্জ থেকে স্ব-পরিবারে মৌলভীবাজারে এসেছিলেন দিপা রায় (৩৫)। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে পরিবারের সাথেই হবিগঞ্জে ফিরে যাওয়ার কথা ছিলো আজকালকের মধ্যেই। কিন্তু মেয়েকে নিয়ে আর বাড়ি ফেরা হলোনা দিপা রায়ের। ভয়াবহআকস্মিক আগুনে মা-মেয়ের জীবন কেড়ে নেবে এটা হয়তো ভাবেননি দিপা রায়ের স্বামী সজল রায় এবং তার ছেলে।
আগুনে পুড়ে অন্যান্য স্বজনদের সাথে মারা গেছেন মা-মেয়ে দুজনই। বিয়ের আনন্দের রেশ কাটতে না কাটতেই পরিবারে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। তাদের এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না স্বজনদের কেউই।
নিহতের আত্মীয় কমলপাল জানান, ঘটনায় নিহত দিপা রায় ও তার মেয়ে বৈশাখী রায় আত্মীয়ের বিয়েতে যোগ দিতে মৌলভীবাজারে এসেছিলেন। আগুন লাগার পর বাসার অন্যান্য সদস্যদের মতো দিপা রায়ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে ওই বাসায় আটকা পড়েন। প্রাণ বাঁচাতে আরও অনেকের সাথে তার ছেলে বাসার বাইরে বেরিয়ে আসতে পারলেও ছোট মেয়ে বৈশাখীকে নিয়ে বের হতে পারেননি মা দিপা রায়। ফলে অন্য ৩ জনের সাথে মারা যান তারাও।
দিপা রায়ের আত্মীয় কল্প রায় জানান, কয়েকদিন আগেই আত্মীয়ের বিয়েতে যোগ দিতে সপরিবারে আসেন দিপা রায়। তার গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার উমেদনগরে। তার স্বামী সজল রায়। দিপা রায়ের আরও একজন ছেলে রয়েছে।’
শহরের এম সাইফুর রহমান সড়কের পিংকী সু ষ্টোর নামের একটি জুতার দোকানে মঙ্গলবার ২৮ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ৯টায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের এ সূত্রপাত ঘটে। তখন দোকানের সাঁটার বন্ধ ছিল। মুহূর্তের মধ্যে দোকান থেকে ছড়িয়ে পরে ওপরের দু’তালায় কাঠের ঘরে আগুন। দু’তালায় বসবাস করতেন পরিবার নিয়ে সুভাষ রায় ও তার ভাই প্রণয় রায় মনার পরিবার।
আহত প্রণয় রায় মনাকে প্রথমে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে একটি বে-সরকারী হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়।
যেভাবে আগুনের সূত্রপাত : নিহত সুভাষ রায়ের মামাতো ভাই সুনির্মল কুমার দাস চৌধুরী জানান, পিংকি সু স্টোর এর উপরে বাসা রয়েছে। উপরের তলাটি টিনশেড এর। টিনশেড এর নীচে কাঠের ছাদ রয়েছে। নিচ তলায় জুতার দোকান ছিল। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে প্রথমে দোতলা থেকে বিদ্যুতের সর্ট সার্কিট আগুনের সূত্রপাত হয়। লিকেজ হওয়া গ্যাসের রাইজার ফেটে আগুনের সূত্রপাত পরে আগুন নিচ তলায় জুতার দোকানসহ আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় বাসার সবাই ঘুমিয়ে ছিলেন। এর মধ্যে ধোঁয়ায় তারা শ^াসরুদ্ধ পড়েন। অনেক আকুতি ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউ বের হতে পারেনি।
নিহতরা হলেন পিংকি সু স্টোরের মালিক সুভাষ রায় (৬৫), সুভাষ রায়ের মেয়ে প্রিয়া রায় (১৯), সুভাষ রায়ের ভাই প্রণয় রায় মনার স্ত্রী দিপ্তী রায় (৪৮), সুভাষ রায়ের শ্যালকের বউ দিপা রায় (৩৫). দিপা রায়ের মেয়ে বৈশাখী রায় (৩)।
এ সময় আহত প্রণয় রায় মনা ও তার দুই ছেলে শুভ রায় (২০) ও সঞ্জয় রায (১৮), পিংকির বড় চাচী। তারা নিচ তলায় থাকায় বেরিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
সুভাষ রায়ের বড় মেয়ে প্রিয়াংকা রায় পিংকি গত বুধবার মৌলভীবাজার শহরের কলিমাবাদ এলাকায় বিবাহ সম্পন্ন হয়। পিংকি উপজেলার বারোহাল সহকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকা। নিহত সুভাষ রায়ের গ্রামের বাড়ি সদর উপজেলা গন্ধর্বপুর গ্রামে জমিদার পরিবারের সন্তান।
খবর পেয়ে মৌলভীবাজার ও শ্রীমঙ্গল ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আড়াই ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে দুপুর ১২টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এরপর দোতলার বাসা থেকে পুলিশ ৫ জনের দগ্ধ লাশ উদ্ধার করে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ পাঠায়।
নিহতের আত্মীয় ইমন রায় জানান, গেল বুধবার নিহত সুভাষ রায়ের মেয়ে প্রিয়াংকা রায় পিংকি বিবাহ সম্পন্ন হয়। বাসায় বিয়ের অনুষ্ঠান উপলক্ষে দূরদূরান্ত থেকে আত্মীয় স্বজন বাসায় ছিল। আর মঙ্গলবার সকালেই এই অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে।
চিকিৎসাধীন প্রণয় রায় মনা জানান, তখন তিনি তাদের দোকানের দ্বিতীয় তলায় ঘুমিয়ে ছিলেন। তার বড় ভাইয়ের স্ত্রী আগুন বলে চিৎকার দিলে তিনি ঘুম থেকে উঠেন। তিনি জানান, কারেন্টের বোর্ড থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়ে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। মুহূর্তে পুরো ঘরে আগুন দাউ দাউ করে জ¦লতে থাকে।
মৌলভীবাজার ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স উপ পরিচালক মো. আব্দুল্লাহ হারুন পাশা জানান, তাদের ধারণা ছিলো বৈদ্যুতিক সর্ট সার্কিট থেকে প্রথমে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হতে পারে। ঘরের ভেতরে একটি গ্যাস রাইজার ছিল, পরে ওই রাইজারে আগুন লাগে। তিনি আরও জানান, দোতলায় এবং পেছনের বাসায় তারা থাকতেন। তাদের বের হওয়ার রাস্তা ছিল দোকানের ভেতর দিয়ে আসা যাওয়া করতো তারা।
মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসন ও পৌরসভার আলাদা আলাদা সাত সদস্য তদন্ত কমিটি গঠন: মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক নাজিয়া শিরিন বিকালে জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে এক জরুরী প্রেস কনফারেন্স আয়োজন করে জেলা প্রশাসন ও পৌরসভা আলাদা দুইটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন মৌলভীবাজার পৌরসভার মেয়র মো.ফজলুর রহমান, উপজেলা চেয়ারম্যান কামাল হোসেন।
জেলা প্রশাসক বেগম নাজিয়া শিরিন বলেন, মৌলভীবাজারে অগ্নিকান্ডে ৫ জন নিহতের ঘটনায় কারণ ও প্রতিকারের সুপারিশসহ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়।
জেলা প্রশাসক বেগম নাজিয়া শিরিন জানান, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তানিয়া সুলতান এর নেতৃত্বে জেলা প্রশাসকের তদন্ত কমিটির অন্যান্যরা হলেন, পুলিশ সুপারের প্রতিনিধি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) জিয়াউর রহমান, পিডিবির প্রতিনিধি, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির প্রতিনিধি, পৌরসভার প্রতিনিধি কাউন্সিলর মনবির রায় মনজু, মৌলভীবাজার চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রিজ এর প্রতিনিধি ও বিজনেস ফোরামের প্রতিনিধি। এই কমিটি চাইলে সংশ্লিষ্ট স্টেক হোল্ডার প্রতিনিধি সংযোজন করতে পারবেন।
তিনি বলেন, কারণ উদঘাটন করে এই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে পরবর্তীতে এই ধরণের ঘটনা যাতে না ঘটে, সে গুলো ব্যবস্থা নেবে।
অপর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন মেয়র মো. ফজলুর রহমান। তিনি জানান, পৌরসভার মেয়র কমিটির আহবায়ক হলেন কাউন্সিলর জালাল আহমদ। কমিটির সদস্যরা হলেন- কাউন্সিলার ফয়ছল আহমদ, কাউন্সিলর স্বাগত কিশোর দাস চৌধুরী, পৌরসভার সচিব, মৌলভীবাজার চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রিজ এর প্রতিনিধি, বিজনেস ফোরামের প্রতিনিধি ও পৌরসভার বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিনিধিসহ অন্যান্যরা।
এ ঘটনায় পুলিশের সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি কামরুল আহসান বিপিএম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এছাড়াও জেলা প্রশাসক বেগম নাজিয়া শিরিন, পুলিশ সুপার মো. মো.ফারুক আহমেদ পিপিএম (বার), পৌরসভার মেয়র মো. ফজলুর রহমান, চেম্বার সভাপতি মো. কামাল হোসেন, বিজনেস ফোরামের সভাপতি নুরুল ইসলাম কামরানসহ প্রশাসনের পদস্থ কর্মকর্তারা।
মৌলভীবাজার মডেল থানার ওসি আলমগীর হোসেন ও সিআইডি ইন্সপেক্টর বিকাশ দাশ জানান, ঘটনার পর পরই পুলিশের সাথে সাথে সিআইডির পুরো টিম ঘটনাস্থলে এসে উদ্ধার অভিযানে যোগদেন। তারা জানান, প্রাথমিক ভাবে তারা জানতে পারেন সর্ট সার্কিট থেকে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত। পরে গ্যাসের রাইজার বিস্ফোরিত হয়ে আগুন ছড়িয়ে পরে। তবে তদন্ত সাপেক্ষে পুরো বিষয়টি জানা যাবে। লাশ উদ্ধার শেষে মৌলভীবাজার হাসপাতালের মর্গে নিয়ে ময়নাতদন্ত সম্পূর্ণ করা হয়েছে। রাতে শহরের সৈয়ারপুরস্থ পৌর শ্মশানঘাটে দাহ করা হয়েছে।
এদিকে অগ্নিকান্ডের ৫ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুতে পরিবেশ ও বন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন ও সদর আসনের সাংসদ নেছার আহমদ, এবং অনুমিত হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা উপাধ্যক্ষ ড. আব্দুস শহীদ এমপি গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। মন্ত্রী এবং এমপি শোকবার্তায় নিহতদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।